ডাক্তার হয়ে হাজার হাজার ফুট থেকে লাফ! ভারতের প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার আজও আড়ালেই
India’s first female paratrooper: ১৯৫৯ সালে বিমান বাহিনীর সকল ডাক্তারদের জন্য ডেকে পাঠানো হয় প্যারাট্রুপিংয়ের জন্য। সেই ডাকে বহু পুরুষও ভয়ে এগিয়ে আসেননি।
হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে! হাজার ফুট উচ্চতা অবধি শব্দগুলো ঠিকঠাক কানে আসছে না। তবে ব্যর্থ হলে চলবে না। ঝাঁপ দিতেই হবে। ভারতীয় বিমাবাহিনীর একটি ডাকোটা প্লেনের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এমনটাই আউড়ে যাচ্ছিলেন গীতা। বাঙালি চনমনে তরুণী প্যারাট্রুপার গীতা চন্দ্র। জীবনে প্রথম এত উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দিতে চলেছেন তিনি। তাঁর সামনেই রয়েছেন আরও তিনজন প্রশিক্ষক প্যারাট্রুপার। নীচে বিপুল জনতার ভিড় সাক্ষী হতে চলেছে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাসের।
সাল ১৯৫৯, ১৭ জুলাই। রোগা, পাতলা, শ্যাম বর্ণের মেয়েটি ভয় ও উত্তেজনায় একপ্রকার গুটিয়ে গেলেও নতুন ইতিহাস গড়তে চলেছেন। হাজার হাজার মানুষের প্রত্যাশাকে বুকে বেঁধে সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে তীব্র একাগ্রতার নিয়ে প্লেন থেকে ঝাঁপ দিলেন গীতা।
ব্যাস! শূন্যে পড়তেই কিছু সেকেন্ড সব নিশ্চুপ! বোধশক্তিও যেন কিছুটা কমে এল। ধীরে ধীরে প্যারাসুট খুলতেই নীচে নেমে এলেন গীতা। এ একপ্রকার বিশ্ব জয়! ভারতের প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার গীতা লিখলেন আকাশ জয়ের গল্প, ভয় জয়ের আখ্যান! তবে গল্প শুনতে যতটা আকর্ষণীয় বাস্তবে তা মোটেই তেমন ছিল না। কোনও দেশের কোনও মহিলাই তখনও অবধি এই প্রায় দুঃসাধ্য কাজটি করে উঠতে পারেননি, গীতা পেরেছিলেন। ছোট থেকে অদম্য সাহসী, ডানপিটে গীতা কিন্তু আসলে পেশায় ডাক্তার। ১৯৫৭ সালে প্রথম ভারতীয় বিমান বাহিনীতে ডাক্তার হিসেবেই যোগদান করেন তিনি। ছোটবেলা কেটেছে অধুনা বাংলাদেশের রংপুরে। বাবা ছিলেন কলেজের অধ্যাপক। সাইকেল চালানো থেকে গাছে ওঠা- কিশোরী গীতার কাছে এসব ‘অ্যাডভেঞ্চার’ ছিল নেহাতই মামুলি খেলা।
আরও পড়ুন- বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকুতি! বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে লাইফ জ্যাকেটের এই পাহাড়!
১৯৫৯ সালে বিমান বাহিনীর সকল ডাক্তারদের জন্য ডেকে পাঠানো হয় প্যারাট্রুপিংয়ের জন্য। সেই ডাকে বহু পুরুষও ভয়ে এগিয়ে আসেননি। কোনও কিছু না ভেবেই এগিয়ে এসেছিলেন সাহসী গীতা। তবে মহিলা হওয়ার দরুণ তাঁর এহেন ইচ্ছেকে বহু উপায়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কর্তৃপক্ষ। বলা বাহুল্য, সে সময় (আজও প্রায় একই) সকলেরই ধারণা ছিল এসব কাজ শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য, সাহস শব্দের উপর অধিকার, দাবি কেবলই পুরুষের! স্বাভাবিকভাবেই গীতাকেও সে কথা পরিষ্কারভাবে জানানো হয়। গীতা কোনওকালেই দমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। যত বাধা দেওয়া হয় তত যেন প্যারাট্রুপিংয়ের ইচ্ছে আরও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে! সহকর্মীদের বিরূপ মনোভাব যেন তাঁর সংকল্পকে শত গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবেই লড়াইটা গীতা চন্দ্রের একার পক্ষে হয়তো সম্ভবও হতো না যদি না সেই সময় তাঁর পাশে থাকতেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সুব্রত ছিলেন একজন এয়ার মার্শাল এবং সেই সময় বিমান বাহিনীর অধিনায়ক। তাঁর সম্মতিতেই ১৯৫৯ সালে প্যারাট্রুপিংয়ের স্কুলে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন গীতা।
বর্ষার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সারা বছরই প্যারাট্রুপিং স্কুলে ট্রেনিং চলে। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছিল সেই বছর। মাত্র একজন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে স্কুল চলেছিল বর্ষাকালেও। প্রায় মাস দেড়েক ধরে পিটি, প্যারেড, দৌড় সবেতেই নিয়মিত ঘাম ঝরাতে লাগলেন গীতাকে। সকালে ঘুম ভাঙার পর তাঁর প্রথম কাজই ছিল পাঁচ মাইল দৌড়। প্যারাট্রুপিং চাট্টিখানি কথা তো নয়। যেমন প্রয়োজন মানসিক শক্তি তেমনই প্রয়োজন শারীরিক শক্তি এবং কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতার। যেকোনও প্রশিক্ষণার্থীর সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ এই সময়টাই। প্রতিবারই মনে হয়, এই বুঝি হেরে গেলাম! তারপরেও একবার শেষ চেষ্টার প্রত্যাশা।
দেড় দু’মাস এভাবে চলার পর শুরু হয় গ্রাউন্ড ট্রেনিং। প্যারাসুট নিয়ে নামার বিভিন্ন কলা কৌশল, শরীরের অঙ্গভঙ্গি এবং নিরাপদে মাটিতে নামার কৌশল শেখানো হয় এই সময়।
আরও পড়ুন- জন্ম থেকেই নেই দু’হাত, পায়ে চালান বিমান! চাইলেই হয় অসাধ্যসাধন, প্রমাণ করেছেন তিনি
১৭ জুলাইয়ের মাত্র আট দিন পরেই দ্বিতীয়বার প্যারাট্রুপিং করেন গীতা। তবে প্রথম দিনের মতোন তা মোটেই সহজ ছিল না। একটি সাক্ষাৎকারে গীতা বলেছিলেন, “দ্বিতীয় বার ঝাঁপ দেওয়ার পরই প্যারাসুটটা দড়ির সঙ্গে জট বেঁধে গিয়েছিল। যেকোনও মুহূর্তে সাংঘাতিক বিপদও ঘটতে পারত। তবে কথাতেই তো আছে মেয়েদের কই মাছের প্রাণ, তেমনই একপ্রকার বেঁচে ফিরেছি।”
বাকিটা ইতিহাস! শুরুর পর থেকে আর থেমে থাকেননি গীতা। দিনের আলোয় তো বটেই, রাতের গহিন অন্ধকারেও তাঁকে তাড়া করেছে প্যারাট্রুপিংয়ের নেশা। মাঝরাতেও ট্রেনিং করতেন তিনি। দেড় মাসের মাথায় অগাস্টে শেষ হয় তাঁর এই কঠিন প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে সুব্রত মুখোপাধ্যায় নিজের হাতে ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছিলেন গীতাকে। রংপুরের ডাক্তারি পড়া কন্যা বাংলায় এক অদ্ভুত ইতিহাস রচনা করে গেলেন নিরুচ্চারে। এতটাই শব্দহীন সেই উড়ান যে গীতা চন্দ্রের নাম ইতিহাসে আজও প্রায় অধরাই রয়ে গেল।