বাঁধভাঙা আবেগে গৌরীপ্রসন্নকে জড়িয়ে ধরলেন বঙ্গবন্ধু, অদেখা আলোয় বাঙালির চেনা নেতা
ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের কালে দেশকালের সীমা অতিক্রম করে হানাদার পাকিস্থানের পাশবিকতা এবং তার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামরত বাঙালি আর তার নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে গান লিখে ( শোনো একটি মুজিবরের থেকে) যিনি গোটা বাঙালি জাতিকে উন্মাদনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই অসামান্য কবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা করতে এসেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সঙ্গে আছেন গৌরীর বিশিষ্ট বন্ধু তথা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা নাট্যব্যক্তিত্ব, বাচিক শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম। গৌরীপ্রসন্ন বঙ্গবন্ধুর ঘরে ঢোকা মাত্রই মুখের চেহারা বদলে গেল হাজার বছরের সেরা বাঙালির। ভেতো বাঙালিকে যিনি ইতিহাসের বুকে শৌর্যবান বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন , সেই মানুষটি আবেগে জড়িয়ে ধরলেন গৌরীপ্রসন্নের হাতদু'খানি। 'আপনি আমাকে নিয়ে কী লিখেছেন, আমি কি তার যোগ্য?'- কন্ঠ যেন একটু কেঁপে গেল আবেগে বঙ্গবন্ধুর। আবেগে তখন চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না গৌরীপ্রসন্নও। গৌরীর সামান্য উচ্চারণের ত্রুটি ছিল। 'দ' উচ্চারণ জিভের সমস্যার জন্যে করতে পারতেন না গৌরীপ্রসন্ন। 'দ' কে উচ্চারণ করতেন ' ড'। বঙ্গবন্ধুর মতো অমন আন্তর্জাতিকস্তরে খ্যাতিমান মানুষের সামনে একটু যেন তালগোল পাকিয়ে গেল গৌরীপ্রসন্নের কথাগুলো, বললেন, 'ডাডা, কী ইই যে এএ বলেন।' বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন কবি গৌরীপ্রসন্নকে। আলিঙ্গনবদ্ধ ভাবেই বঙ্গবন্ধু বললেন; 'বলেন, কী করতে পারি আপনার জন্যে?' বঙ্গবন্ধু তখন যেন একেবারে কল্পতরু।
গৌরীপ্রসন্ন যদি বাংলাদেশের রাজমুকুট চেয়ে বসতেন, হয়তো বাঙালি আবেগের চিরন্তন আধার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সে মুকুটও দরাজ হাসি হেসে পরিয়ে দিতেন কবির মাথায়। একটু ধাতস্থ হয়ে গৌরীপ্রসন্ন বললেন, তিনি পাবনার সন্তান। জন্মভূমি পাবনাকে একবার দেখতে চান। শ্রীরামকৃষ্ণের গর্ভধারিণী চন্দ্রামণি দেবীকে কিছু দিতে চেয়েছিলেন রানি রাসমণির জামাই, তাঁর এস্টেটের ' সেজবাবু' মথুরামোহন বিশ্বাস। বারবার পীড়াপীড়িতে চন্দ্রামণি , মথুরবাবুর কাছে এক পয়সার দোক্তা চেয়েছিলেন। গৌরীপ্রসন্নের বঙ্গবন্ধুর কাছে চাওয়াটাও যেন অনেকটা সেই রকমই ছিল। কবির কথা শুনে তৎক্ষণাৎ আধিকারিকদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গৌরীপ্রসন্নকে পাবনায় তাঁর পূর্বপুরুষের মাটিতে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই রাজকীয় আতিথেয়তায় জন্মভূমি, জন্মভিটে আবার দেখার গল্প শেষদিন পর্যন্ত খুব গর্বের সঙ্গে করতেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সত্তাকে কখনও কখনও ছাপিয়ে যেত বাঙালি আবেগের চিরন্তন জোয়ার। অথচ হানাদার পাকিস্তান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে, পরে , এমনকী তাঁর সপরিবারে শাহাদাত বরণের পরেও ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুব রাজনৈতিক এবং ব্যক্তি আক্রমণপ্রবণ , ধৈর্যহীন, ক্ষমাহীন ,আক্রোশমূলক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখিয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু কিন্তু তাঁর একটি পদক্ষেপের ভিতরেও কোনও ব্যক্তিগত অসূয়াকে কখনও ঠাঁই দেননি। খুনি মেজর চক্র তাঁকে হত্যা করবার অব্যবহিত পরে যাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসায়, সেই খুনি খোন্দকার মোশতাক যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই কলকাতায় বসে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল, আমেরিকার সাহায্যে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন তৈরির ও চেষ্টা করেছিল-- এগুলোর কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। মোশতাক সম্পর্কে অনেকে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক ও করেছিল। কিন্তু, বাঙালি তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে, বাঙালি তাঁকে, তাঁর শিশুপুত্র রাসেল-সহ হত্যা করতে পারে- এটা কখনোই বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতে পারেননি। তাই মোশতাক সম্পর্কে ঘনিষ্ঠবৃত্তের পরামর্শকেও একবারের জন্যেও তিনি কানেই তোলেননি।
বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার অল্প কিছুকাল আগে তাঁর দেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনেন। বাকশাল-এর প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করেন। কারও কারও অভিমত, এই কাজ বঙ্গবন্ধু করেছিলেন সোভিয়েত লবির চাপে। কারণ, চিন বঙ্গবন্ধুর জীবিতাবস্থায় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি। চিনপন্থী যারা ছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের কালে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করেছিলেন।সেইসময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েটের যেহেতু সুসম্পর্ক ছিল, তাই চিনের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল পাকিস্থানের। ফলে মুক্তিযুদ্ধের কালে, বাংলাদেশে যারা চিনপন্থী রাজনীতি করতেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। অনেকের অনুমান, সিপিবি, হাজং বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেতা মণি সিং প্রমুখের একটা বড় প্রভাব ছিল বঙ্গবন্ধুর '৭২ এর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের কালে যাঁরা জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই ' বাকশাল' মানতে পারেন নি। এঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুফিয়া কামাল কে নিজের বড় দিদি হিসেবে দেখতেন। বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিব ননদ সুলভ অভিভাবিকা মনে করতেন সুফিয়া কামালকে ।বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজও নিজের পিসিমার সম্মান ও মর্যাদা দেন সুফিয়া কামালকে। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম একাত্তরের শেষের দিকে। গোটা বাংলাদেশ তখন পাক হানাদারেরা অবরুদ্ধ করে রাখে। বেগম মুজিব তখন তাঁর কন্যা হাসিনা, রেহানা, শিশুপুত্র শেখ রাসেল-সহ ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে অন্তরীণ অবস্থায়। হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন হাসিনা। তাঁর পরিবারের কাউকে হাসপাতালে যেতে দিচ্ছে না পাক সেনাবাহিনী। সব বাঁধা উপেক্ষা করে , কার্যত প্রাণ হাতে করে হাসপাতালে স্নেহের হাসু আর তাঁর সদ্যোজাত পুত্রকে দেখতে গেলেন সুফিয়া কামাল।' জয় বাংলা'র ' জয়' ই নাম রাখলেন নাতির সুফিয়া। জয়ের কন্যার নাম শেখ হাসিনা রেখেছেন, 'সোফিয়া রেহানা'। শেখ হাসিনার নিজের কথায়,' তবু ও ফুফুর নামটা থাকুক।'
পাকিস্থান আমলে যে স্কুলে শেখ হাসিনা পড়তেন, কেবলমাত্র 'শেখ মুজিবের মেয়ে' বলে, সেই স্কুল হাসিনাকে আর রাখতে চাইল না। বেগম মুজিব খবর পাঠালেন সুফিয়া কামালের কাছে। সুফিয়া কামালই হাসিনাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন লীলা রায় প্রতিষ্ঠাত নারী শিক্ষামন্দিরে। সেই সুফিয়া কামাল কিন্তু সমর্থন করতে পারলেন না সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। তীব্র আপত্তি জানালেন । বঙ্গবন্ধুর কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা নিয়ে অনেকেরই অনেক আশঙ্কা।যদিও সুফিয়া কামাল নির্বাকার। শেখ কামালের বিয়ে। যথারীতি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন সুফিয়া কামাল। সঙ্গে তাঁর মেজমেয়ে সুলতানা কামাল, শেখ হাসিনার বাল্যবন্ধু। বত্রিশ নম্বরের গাড়ি বারান্দায় বিদেশি দূতাবাসের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন বঙ্গবন্ধু। সকন্যা সুফিয়া কামালকে সদর দরজায় নামতে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিলেন; 'কুমাল , তোর ফুফু এসেছেন। শিগগির যা।' বলেই নিজে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলেন দিদি সুফিয়াকে রিসিভ করতে । কোথায় পড়ে রইলেন বিদেশি দূতাবাসের হোমরাচোমড়ারা। কোথায় ভেসে গেল বাকশাল ঘিরে বিতর্ক।