ম্যাজিক সংখ্যা পেরিয়ে হোয়াইট হাউজের পথে ট্রাম্প, যা যা বললেন বিজয়ভাষণে

US Presidential Election 2024: বুথ ফেরত সমীক্ষার মুখে কার্যত চুণকালি দিয়েই হোয়াইট হাউজের দরজা ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি। পাঁচ প্রদেশের ভোটগণনা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্প পেরিয়ে গিয়েছেন ম্যাজিক সংখ্যা।

মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের দিকে এতদিন ধরে তাকিয়েছিল গোটা বিশ্ব। অবশেষে দেশের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট বেছে নিয়েছে আমেরিকা। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষেই রায় দিয়েছে আমেরিকাবাসী।  বুথ ফেরত সমীক্ষার মুখে কার্যত চুণকালি দিয়েই হোয়াইট হাউজের দরজা ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি। পাঁচ প্রদেশের ভোটগণনা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্প পেরিয়ে গিয়েছেন ম্যাজিক সংখ্যা। হারের আভাস পেয়েই যখন তিনি নির্বাচনী রাতের ভাষণ বাতিল করেছেন, তখন ট্রাম্পকে দেখা গেল অন্য় মেজাজে। বুধবার ভোটের ফলাফল পুরোপুরি হাতে আসার আগেই ফ্লোরিডার পাম বিচে বিজয়-ভাষণ রেখে ফেললেন তিনি। মার্কিন মুলুকের দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটাকে তার প্রথম বিজয়-ভাষণ বললে ভুল হবে না। একা নয়, সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আমেরিকার হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও। সেই বিজয়ভাষণের মঞ্চ থেকে ফের আমেরিকাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে নিয়ে যাওয়ার কথাই শোনা গেল ট্রাম্পের মুখে। আর কী কী বললেন তিনি সেই জয়ভাষণে?

২০১৬ সাল নাগাদ ভোটে জিতে প্রথম বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ট্রাম্প। সেবার তিনি পেয়েছিল ৩০৬টি ইলেক্টোরাল ভোট। ২০২০ সালে বাজি মেরে যায় ডেমোক্র্যাটরা। সেবারও রিপাবলিকানদের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সফল হননি। তার পর ২০২৪ ভোট। এই ভোটের জন্য গোড়া থেকে কষে কোমর বেঁধেছিলেন ট্রাম্প। কম কাণ্ডকারখানা হয়নি আমেরিকায় ট্রাম্পের নির্বাচনী সভা ঘিরে। একবার তো তাঁর কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায় আততায়ীর গুলি। তার পর আরেকবার তাঁর উপর হামলার চেষ্টা হয়। শোনা গিয়েছে, এই ভোটে ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য নাকি ব্যাপক অর্থ বিলিয়েছেন ধনকুবের এলন মাস্ক। ডেমোক্র্যাটদের হাতে আমেরিকার ডেমোক্রেসি অর্থাৎ গণতন্ত্র বিপন্ন বলেও ব্যাপক হল্লা তোলেন মাস্ক। আমেরিকার নাগরিকেরা যাতে বুঝেশুনে তাঁদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে, এই মর্মে ব্যাপক প্রচারও চলেছে আমেরিকা জুড়ে। এদিকে, প্রায় শেষ মুহূর্তে বয়স ও শারীরিক সমস্যার জন্য ভোট থেকে সরে দাঁড়ান বর্তমান প্রেসিডেন্ট তথা ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তাঁর জায়গায় প্রার্থী হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস।

আরও পড়ুন: প্রথা ভেঙে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট? নাকি ‘আব কি বার’ ট্রাম্প সরকারেই ঝুঁকছে আমেরিকা?

প্রায় সব ক'টি বুথ ফেরত সমীক্ষা কমলা হ্যারিসকে এগিয়ে রাখলেও আসল ভোটগণনায় অঙ্ক গিয়েছে গুলিয়ে। কার্যত ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্রমশ ম্যাজিক নম্বরের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন ট্রাম্প। শুধু এগিয়েছেন, তাই নয়। ছুঁয়েও ফেলেছেন জয়ের ট্রফি। কমলা যেখানে ২২৪-এই থমকে গিয়েছেন, ট্রাম্প সেখানে ২৭৭ পেরিয়ে জিতে নিয়েছেন হোয়াইট হাউসের টিকিট। তবে তার আগেই তিনি সেরে ফেলেছেন তাঁর জয়ভাষণ। সেখানে প্রথমেই আমেরিকাবাসীকে এই বিপুল সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “সমালোচকদের ভুল প্রমাণিত করে আমরা জয়ী হতে চলেছি। আমেরিকা অভূতপূর্ব এবং শক্তিশালী রায় দিয়েছে।” আর তার পরেই জগৎসভায় আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠ করে তোলার কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। তাঁর ভাষণ চলাকালীন সমর্থকদের ‘আমেরিকা-আমেরিকা’ স্লোগানে ভেসেছে চারপাশ। সেই জনগণের সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সব সমস্যা সমাধান ও আমেরিকার সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারপর্বেই আমেরিকাবাসীর সামনে একাধিক প্রতিশ্রুতির খুঁড়োর কল ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্ভবত অভিবাসন নীতি। বরাবরই অভিবাসন প্রসঙ্গে বেশ কড়া অবস্থান প্রকাশ করে আসছেন ট্রাম্প। এবারও হোয়াইট হাউজের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুপ্রবেশ বন্ধের চেনা আশ্বাস শোনা গেল হবু প্রেসিডেন্টের গলায়। মঞ্চ থেকে জানালেন, “আমরা সীমান্ত বন্ধ করব। অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে।” নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে জানিয়ে খানিক আবেগতাড়িত হয়েই ট্রাম্প বলেন, “আমি প্রতিটি দিন আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য এবং আপনার ভবিষ্যতের জন্য লড়়াই করব। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমি আপনাদের হয়ে লড়াই করব।” এর পর প্রথা মেনে এই জয়ের জন্য, তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য নিজের পরিবারকে ধন্যবাদ জানান তিনি। বিশেষত ধন্যবাদ জানান স্ত্রী মেলানিয়াকে। এর আগের দফায় ট্রাম্প-মেলানিয়ার সেসব অম্লমধুর সমীকরণের গল্প এখন জ্বলজ্বল করছে বিশ্ববাসীর চোখে। আরও একবার সেই সব দৃশ্যের ফের সাক্ষী হতে চলেছে দুনিয়া।

আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টই সে দেশের সর্বময় কর্তা। সাধারণ ভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশাল সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন দেশের সর্বময় কর্তা হিসেবে। সেসব ফের পেতে চলেছেন ট্রাম্পও। তাঁর বেতন থেকে শুরু করে পাওয়া যাবতীয় সুযোগসুবিধাই তাই অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং বলাই বাহুল্য বিপুলও। যেখানে আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের গড় বার্ষিক বেতন ভারতীয় মুদ্রায় ৩৭.৪১ লক্ষ টাকা, সেখানে প্রেসিডেন্টের বার্ষিক বেতন কোটিতে। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় তিন কোটি ৩৬ লক্ষ। তার উপর রয়েছে আলাদা ভাত। তার সঙ্গে বিনোদন ও ভ্রমণের জন্য আলাদা করে অর্থ ব্যয়িত হয় প্রেসিডেন্টের জন্য। সেই অঙ্কটা ভারতীয় মুদ্রায় কম নয়। প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প বার্ষিক অন্যান্য খরচ বাবদ পাবেন ৪২ লক্ষ টাকা। বিনোদন এবং ভ্রমণের জন্য খরচ বাবদ পাবেন যথাক্রমে ৮৪ লক্ষ এবং ১৬ লক্ষ টাকা। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের জন্য আমেরিকার কোষাগার থেকে বরাদ্দ করা হবে বছরে ৪ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা। বিজ়নেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর হোয়াইট হাউসকে নিজের পছন্দ মতো সাজানোর জন্য প্রায় ৮৪ লক্ষ টাকা পাবেন। তবে বারাক ওবামার মতো অনেকেই সেই অর্থ ব্যয় করেননি। তার পরিবর্তে নিজের তহবিল থেকে খরচ করে হোয়াইট হাউস সাজিয়েছিলেন। যাতায়াতের জন্য পাবেন বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি। লিমুজ়িন, মেরিন ওয়ান, এয়ার ফোর্স ওয়ান, দ্য বিস্টের মতো গাড়ি ও বিমানের ব্যবস্থা থাকবে। নিরাপত্তার দিক থেকে যা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ বলেই গণ্য হয়। বার্ষিক পেনশন হিসাবে বছরে দেড় কোটি টাকার বেশি পেয়ে থাকেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাছাড়াও রয়েছে আজীবনের স্বাস্থ্য পরিষেবা।

২০২০ সালে এই সমস্ত ঐশ্বর্য ছেড়ে হোয়াইট হাইজ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। সেই সময় তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগও ওঠে। সেসব ধুলো-কাদা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে ফের মসদনে ফিরলেন রিপাবলিকান ট্রাম্প। আবার হোয়াইট হাউজে উঠল লাল পতাকা। এদিন ট্রাম্পের বিজয়ভাষণের পরেই মঞ্চে বক্তব্য রাখতে ওঠেন তাঁর তাঁর ‘রানিং মেট’ তথা হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স। তিনি জানান, এই ধরনের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন প্রায় বিরল। তা বোধহয় খুব ভুল বলেননি। আমেরিকার সাতটি সুইং স্টেট সেখানকার ভোটের বিরাট ফ্যাক্টর বললে ভুল হয় না। সেই সাতটি প্রদেশে কেমন ফল করেন ট্রাম্প, তা নিয়ে উদ্বেগ ও উত্তেজনা দু'টোই ছিল সমানতালে। শেষপর্যন্ত দেখা গেল, সেই সাতটি প্রদেশেই এগিয়ে গেলেন ট্রাম্প। শুধু এগোলেনই না, পাঁচ প্রদেশের ভোটগণনা বাকি থাকতেই জাদুসংখ্যাও পেরিয়ে গেলেন তিনি।

আরও পড়ুন: ভোটারদের কোটি কোটি টাকা ‘পুরস্কার’! কেন ট্রাম্পের হয়ে সালিশি করছেন এলন মাস্ক?

জয়ের পরেই 'বন্ধু' মোদির কাছ থেকে ট্রাম্পের কাছে পৌঁছলো শুভেচ্ছাবার্তা। ভোটগণনা চলাকালীনই ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, আমেরিকার মসনদে যে-ই আসুক না কেন, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে তার কোনও প্রভাব পড়বে না। বরং উত্তরোত্তর তা ভালোর দিকেই এগোবে। মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বন্ধুত্বের গল্প অজানা নয় কারওরই। সেই 'বন্ধু' ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হতে না হতেই শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নিজের এক্স হ্যান্ডেলে দুই 'বন্ধু'-র একগুচ্ছ ছবি পোস্ট করে ঐতিহাসিক জয়ের জন্য জানালেন অভিনন্দন। মোদী লেখেন, “নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়ের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আন্তরিক অভিনন্দন। আশা করব আপনার আগের মেয়াদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার হবে। আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার সেই ধারা ফিরিয়ে আনার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি। আসুন একসঙ্গে আমাদের জনগণের উন্নতির জন্য এবং বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করি।”

 

আমেরিকাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ করে তোলার যে প্রতিশ্রুতি-স্লোগানকে ভোটময়দানে হাতিয়ার বানিয়েছিলেন ট্রাম্প, সেই অস্ত্রে ভর করেই এদিনও বিজয়ভাষণে আমেরিকাবাসীর মন টানলেন তিনি। তার ব্যতিক্রম হতে দেখা গেল না ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফাতেও। আমেরিকায় ফের শুরু ট্রাম্প-জমানা। বিশ্ব জুড়ে একাধিক যুদ্ধের আবহে কীভাবে সব দিক সামলে চলেন দেশের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট, বিশ্ব-রাজনীতিতে কোন ভূমিকায় পদার্পণ করেন ট্রাম্প, সেদিকেই নজর থাকবে গোটা বিশ্বের।

More Articles