উৎপলেন্দুর ছবি সরাসরি রাজনৈতিক কর্মের সম্প্রসারণ...
Utpalendu Chakrabarty: তাঁর প্রধান চিত্রমালা, অন্তত 'চোখ’, 'ময়নাতদন্ত' আর 'দেবশিশু' প্রত্যক্ষভাবেই রাজনৈতিক ছবি।
ইতিহাসের কী অপার কৌতুক যে, প্রায় ২৫ বছর পর 'ময়নাতদন্ত' শব্দটি জনপরিসরে সত্যিই তদন্ত দাবি করছে। স্বরচিত এই 'ময়নাতদন্ত' গল্পটি নিয়েই ১৯৭৪ সালে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী মৃণাল সেনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁর ৪-ই মতিলাল নেহেরু রোডের বাড়িতে তখন আমাদের নিত্য যাতায়াত। আলাপ হয়েছিল উৎপলেন্দুর সঙ্গে। আমার থেকে বছর তিন-চারেকের বড় কিন্তু আমরা সবাই ৭০ দশকের। উৎপলেন্দুকে তখন আগুনের বাসিন্দা মনে হয়েছিল। সে মৃণালদাকে আরেকটি খসড়া চিত্রনাট্যও দেখায়, 'প্রসব' নামে। যেখানে একজন গ্রাম্য রমণী শেষ পর্যন্ত প্রসব করে রাইফেল ও রেডবুক! গোর্কির 'মানুষের জন্ম' গল্পটির অনুসরণে লেখা এই চিত্রনাট্য মৃণাল সেনের মনে ধরেনি। তিনি 'ময়নাতদন্ত' নিয়ে কিছুটা এগিয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী আইকে গুজরাল জানান, অনশনে মৃত্যু এখনও সংবিধানসম্মত নয়, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পাওয়া যাবে না। ফলে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। উৎপলেন্দু নিজেই তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র হিসেবে আশির দশকের শুরুতে ছবিটি বানান। সময়ের পাতা খুলে যাচ্ছে। সিনে ক্লাব অফ আসানসোলের একটি আলোচনায় উৎপলেন্দু যা বলেন তা ওই ফিল্ম সোসাইটির মুখপত্র সেলুলয়েড-এর প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়। সেখানে নকশালপন্থী উৎপলেন্দু সরাসরি জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দাক্ষিণ্য ও অর্থের জোগান না থাকলে তিনি এই ছবি বানাতে পারতেন না। তিন বছর বাদে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার আবার তাঁর প্রতি সদয় হয় এবং 'চোখ' নির্মিত হয়। তৃতীয় ছবি 'দেবশিশু' অবশ্য এনএফডিসির অনুদান।
আমরা এগিয়ে গিয়েছি কিন্তু ফিরে দেখলে মনে হবে উৎপলেন্দু আমার মতো অজ্ঞাতকুলশীল নয়। ছিন্নমূল রচয়িতা ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত সাহিত্যকর্মী স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁর মামা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজির সুখ্যাত অধ্যাপক দীপেন্দু চক্রবর্তী তাঁর দাদা। সুতরাং উৎপলেন্দু যে সাহিত্য করবে তা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। সিনেমায় তাঁর প্রথম অবদান 'মুক্তি চাই' (১৯৭৭)। তখন বামফ্রন্ট সরকার সবে ক্ষমতায় এসেছে। বন্দিমুক্তির দাবিতে তোলা এই ছবি দেখাতে সে আমাকে নিউ সেক্রেটারিয়েটের চত্বরে নিয়ে যায়। বস্তুত এই ছবি সদ্য ভূমিষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারকে অনেক সাহায্য করেছিল বন্দিমুক্তির বিষয়ে একটি খসড়া তৈরি করতে। সেই সূত্রেই তৎকালীন তথ্য সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। উৎপলেন্দু কত বড় শিল্পী ছিল তা নিয়ে তর্ক তোলা যায়, কিন্তু তাঁর ছবি সরাসরি রাজনৈতিক কর্মের সম্প্রসারণ। উৎপলেন্দু কোনওক্রমেই অরাজনৈতিক ছিলেন না। তাঁর প্রধান চিত্রমালা, অন্তত 'চোখ’, 'ময়নাতদন্ত' আর 'দেবশিশু' প্রত্যক্ষভাবেই রাজনৈতিক ছবি। এতটাই রাজনীতির যে তাঁকে উত্তর-ঋত্বিক, উত্তর-মৃণাল পর্বের সূচনা বলা যায় বাংলা ছবিতে। এই সময়েই বিপ্লব রায়চৌধুরীর 'শোধ', বুদ্ধদেবের 'নিম অন্নপূর্ণা', উৎপলেন্দুর 'চোখ' এবং গৌতম ঘোষের 'হাংরি অটাম' ও 'দখল' প্রকৃতই বাংলা ছবিতে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির রঙ লাগিয়ে দিয়েছিল। উৎপলেন্দু ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু তাঁর মূল ভালো লাগা সত্যজিৎ রায়। 'পথের পাঁচালি' ও পরবর্তীকালে 'সদগতি' থেকে তিনি কখনই মুক্তি পাননি। বস্তুত, 'চোখ' ছবিতে ওম পুরী ও শ্রীলা মজুমদারের অভিনয় দেখলেই বোঝা যায় তিনি হাত পাতছেন সদগতির ওম পুরী ও স্মিতা পাতিলের কাছে।
আরও পড়ুন- তরুণ মজুমদার জানতেন, রাজনীতির চেয়ে মনুষ্যত্বর বয়স বেশি
তথ্যচিত্রের প্রতি উৎপলেন্দুর একটা আগ্রহ ছিলই। ১৯৮৩ আর ১৯৮৪-তে দেবব্রত বিশ্বাস আর সত্যজিৎ রায়ের সংগীত নিয়ে দু'টি ছবি তুলেছিলেন তিনি যা আমাদের সংস্কৃতি চর্চার উজ্জ্বল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। পরে 'সুনীল সাগরে' নাম দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরও একটি ছবি তুলেছিলেন। যদিও সেই ছবি আমি দেখিনি।
এই তো বছর চার-পাঁচ আগে উৎপলেন্দুর সঙ্গে আমার দেখা। আমাকে সরাসরি অভিযোগ করে বললেন, "আপনি বলেন অনেক কিছু, কিন্তু আমার সম্বন্ধে তো কিছু বলেন না বা লেখেন না?” আমি ঈষৎ লজ্জিত হয়ে বলেছিলাম, সবসময় তো সুযোগ পাওয়া যায় না! সুযোগ এল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমি তাঁদের বলি, উৎপলেন্দু এক্ষেত্রে অনেক উপযুক্ত ব্যক্তি, তাঁকে অনুরোধ জানাও। ছাত্ররা আমার নাম করে তাঁকে অনুরোধ জানায়। তিনি আসেন। বক্তৃতাও দেন। আর সবচেয়ে আশ্চর্য, সারাদিন ছাত্রদের সঙ্গে বসে থেকে সব ছবিগুলো দেখেন। ছাত্ররা আমাকে বলেছিল, "স্যার উনি গভীর তৃপ্তিতে আমাদের জড়িয়ে ধরেছেন, তারপর ট্যাক্সিতে উঠেছেন।" আমাদের সত্তর দশক সত্যিই যৌবনের ছিল। নবারুণ বলতেন, সত্তর দশক ছাড়া আমরা কেউই কিছু হতাম না। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। দুঃখ শুধু এটাই, আমি উৎপলেন্দুকে নিয়ে কিথা বললাম কিন্তু সে আর শুনতেই পেল না।