আদৌ কোনও বাইকে চড়েননি উত্তম-সুচিত্রা! কীভাবে শ্যুটিং হয়েছিল সপ্তপদী ছবির বিখ্যাত দৃশ্য?
Uttam Kumar-Suchitra Sen : ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানে আদৌ কোনও বাইকে চড়েননি উত্তম-সুচিত্রা! অবাক করবে আসল রহস্য
দুজনেই আজ না ফেরার দেশে, অথচ “পথ শেষ না হলে ঠিক কেমন হতো”, সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আজও খুঁজছে বাংলা সিনেমার দর্শক। আজকের যুগে অবশ্য বাইকে প্রেম, এমন ছবি হামেশাই দেখা যায়। তবে সে যুগে বিরল। বাঙালি প্রেমিকের ছবিটাই যেন মুহূর্তে বদলে দিয়েছিলেন পরিচালক অজয় কর। এমনিতেই ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির সেই সংলাপ বুঝেই দেয়, ঘরে ঘরে সকল প্রেমিকরাই একবার অন্তত উত্তম কুমার হতে চান। চিন্ময় রায়ের লিপে তাই সেই আকুতি ফুটে ওঠে, “একবার বলো তুমি উত্তম কুমার”!
কিন্তু বাইকে বসে যে প্রেমের দৃশ্য আলোড়ন সৃষ্টি করল বাংলা ছবির জগতে, যে দৃশ্য নতুন করে চিনিয়ে দিল উত্তম সুচিত্রা জুটির রসায়নকে, জানেন কি সেই দৃশ্যের নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে অজানা গল্প! যে বাইকে চড়ে প্রেম নিয়ে এতো আলোচনা, আদতে সেই দৃশ্যে নাকি কোনও বাইকে চড়েননি উত্তম সুচিত্রা! হ্যাঁ ক্যামেরার কারিগরি ঠিক এতটাই বোকা বানিয়েছে সে যুগে! আজও যখন সেই দৃশ্য আমরা দেখি, সুচিত্রা উত্তমের একে অপরকে “তুমি বলো” বলতে শুনি, মোহিত হয়ে পড়ি, আমরা ভাবতেও পারি না বাইকে আদৌ ছিলেন না তাঁরা!
আরও পড়ুন - কী এমন ভয়? কেন সাবিত্রীর বাড়ির বাথরুমে গিয়ে লুকোলেন উত্তম কুমার?
কালের স্রোতে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে ঠিকই, কেবল বদলায়নি উত্তম সুচিত্রার কেমিস্ট্রি! পর্দা বনাম বাস্তবের লড়াই ছিল কিনা সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাই প্রয়োজনই পড়ে না। এতটাই সাবলীল এই জুটি! ‘রমা না থাকলে উত্তম কুমার হতো না’, স্বয়ং উত্তম কুমার নিজেই স্বীকার করেছেন এ কথা। আর সেই সময়ে উত্তম সুচিত্রার ছবি মানেই ছিল বক্স অফিসে হিট। তার ওপর বাইকে চড়ে নায়ক নায়িকার প্রেম! এ তো শুধু বাংলা সিনেমা নয়, ভারতীয় সিনেমাতেও বিরল!
পরিচালক অজয় কর অবশ্য এই দৃশ্যকে সাজিয়েছিলেন সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবনায়। চেয়েছিলেন বাঙালি দর্শককে তাক লাগিয়ে দিতে। উত্তম সুচিত্রা জুটির তীব্র আকর্ষণ তো ছিলই, তার সঙ্গে আবার যোগ হল বাইক রোমান্স! গানের “লা লা লাআআআ...” বলে যখন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে বাইক তখনও উত্তর খুঁজেছে দর্শক। আর ক্যামেরায় চলেছে এক্কেবারে অন্য দৃশ্যায়ন।
বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র সমালোচক স্বপন কুমার মল্লিক তাঁর ‘মহানায়ক রিভিজিটেড: দ্য ওয়ার্ল্ড অফ উত্তম কুমার’ বইতে বিখ্যাত এই দৃশ্যের আবরণ উন্মোচন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, পরিচালক অজয় কর ক্লোজ আপ শটে ম্যানিপুলেট করে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-এর বাইক দৃশ্য শ্যুট করেছিলেন। আর লং শটে ব্যবহার করা হয়েছিল একাধিক ডামিকে। আর যে বিএমডব্লিউ বাইক নিয়ে এতো আলোচনা, তাতে মোটেও চড়েননি উত্তম-সুচিত্রা।
আরও পড়ুন - আনা হয় সাদা পদ্ম, কেন আজও ‘উত্তম’ পুজো করা হয় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে?
শুধু স্বপন বাবুর বইয়ে ফুট নোটে নয়, পরবর্তীতে একটি সাক্ষাৎকারে উত্তম কুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়ও এই রহস্য ভেদ করেছিলেন। গ্রামের একটি লম্বা রাস্তাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সামনে বসানো হয়েছিল সেই বিখ্যাত বিএমডব্লিউ বাইক। তারপর ডামিরা একে একে সেই বাইকে চড়ে কিংবদন্তি দৃশ্যের শ্যুটিং করেছেন। অথচ পর্দায় দর্শক দেখেছেন প্রিয় উত্তম সুচিত্রা জুটিকেই। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্য প্রাপ্য পরিচালক এবং ক্যামেরাম্যানের। আজ এতগুলো বছর পরও যখন সেই দৃশ্য দেখি তখনও কোথাও কোনও অসংগতি নজরে পড়ে না। একবারের জন্যও মনে হয় না বাইকে উত্তম সুচিত্রা আদৌ নেই।
আর দৃশ্যের সেই বিখ্যাত বাইকটি কিন্তু আজও অমর হয়ে রয়েছে বাঙালির মননে। স্বপনবাবুর হয় থেকেই জানা যায় ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানে দেখানো কিংবদন্তি বাইকটি খুঁজে পাওয়া গেছিল দক্ষিণ কলকাতার একটা গ্যারেজ থেকে। বাইকটি অবশ্য দেশীয় নয়, কলকাতায় এই বাইক প্রথম এসেছিল কোনও এক জার্মান নাগরিকের হাত ধরে। তাঁর কাছ থেকে কলকাতার কেউ বাইকটি কিনে নিয়েছিলেন। স্বপনবাবুর বইতে এও জানা গিয়েছে যে, ২০০৮ অবধি বাইকটি ব্যবহার করা হয়েছে। তারপর সেটিকে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করার ভাবনাও ছিল। বাইকের অতীত নিয়ে আজও সন্দিহান মানুষ, অথচ ভবিষ্যতটা ঠিক কেমন হল এই প্রশ্নের উত্তর অধরা।