১০ দিন ধরে সুড়ঙ্গে আটকে ৪০ শ্রমিক! উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় মনে করাচ্ছে প্রিন্স উদ্ধারের ঘটনা

Uttarakhand Tunnel Rescue : ড্রিলিং মেশিনকে উপর থেকে টানেল অবধি পৌঁছনো গেছে। যন্ত্রটিকে ঘটনাস্থলে আনতেই ১৩ ঘণ্টা এবং তিনটি গাড়ি লেগেছে।

১২ নভেম্বর। সুড়ঙ্গের মধ্যে আটকা পড়েন কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকরা। ১০ দিন অতিক্রান্ত। এখনও ৪১ জন আটকে পড়া শ্রমিককে মাটির গভীর থেকে তুলে আনতে পারল না এনডিএমএ বা জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এই ১০ দিন পর মুখ দেখা গেছে শ্রমিকদের, কথা শোনা গেছে। তবু উদ্ধার করা যায়নি। উত্তরাখণ্ডের ওই টানেলে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারে এখন নতুন পাঁচ-দফা উদ্ধার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে এনডিএমএ। আড়াআড়ি ড্রিলিংয়ের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে কবের মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব, কিছুতেই তা জানাচ্ছে না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।

সুড়ঙ্গের ভিতরে পর্যাপ্ত জল এবং অক্সিজেন রয়েছে। বিদ্যুৎ এবং খাবারদাবারও পাঠানো হয়েছে পাইপে করে। সুড়ঙ্গের ভিতরে পর্যাপ্ত জায়গাও রয়েছে, প্রায় ২ কিমি। তবে ৪০ জন মানুষ একটি সুড়ঙ্গে সারা দিন সারা রাত কাটালে কতখানি সেই জায়গা থাকার উপযুক্ত থাকে তা সহজেই অনুমেয়। একটি ৪ ইঞ্চির পাইপের মাধ্যমে, বেঁচে থাকার জন্য খাবার 'পুশ' করে পাঠানো হয়েছে। শ্রমিকদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে কয়েকজন শ্রমিকের পরিবারকেও ওই স্থানে ডেকে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় এলাকায় হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রমিকদের পরিবারগুলির। কয়েকজনের সঙ্গে শ্রমিকদের কথাও হয়েছে। এত কিছু করা হচ্ছে, অথচ শ্রমিকদের বের করা যাচ্ছে না কেন এতদিন পরেও?

আরও পড়ুন- নিরাপদ নয় দার্জিলিংও! কীভাবে জোশীমঠের মতোই তলিয়ে যাওয়ার পথে পাহাড়ের রানি?

আটকা পড়া শ্রমিকদের কাছে একটি ক্যামেরা পাঠিয়ে তারা কেমন আছেন তা দেখা গিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে ঢোকানো যে পাইপের মধ্য দিয়ে খাবার পাঠানো হয়েছে, সেই পাইপের মাধ্যমেই এন্ডোস্কোপিক ফ্লেক্সি ক্যামেরা পাঠিয়ে ছবি তোলা হয়। এক শ্রমিকের ভাই বিক্রম সিং জানাচ্ছেন, তাঁর দাদা পুষ্কর সিং প্রায় আড়াই মাস ধরে ওই সুড়ঙ্গে কাজ করছিলেন। দুর্ঘটনার খবর তারা জানতে পারেন ঘটনার চার দিন পর। পুষ্করের অন্য বন্ধুরা তাঁদের ফোন করে খবর দেয়। উদ্ধারকর্মীরা ওয়াকি টকি বা রেডিও হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এই বিষয়টিকে উদ্ধার অভিযানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে মনে করা হচ্ছে।

উদ্ধারকারীরা জানাচ্ছেন, ড্রিলিং মেশিনকে উপর থেকে টানেল অবধি পৌঁছনো গেছে। যন্ত্রটিকে ঘটনাস্থলে আনতেই ১৩ ঘণ্টা এবং তিনটি গাড়ি লেগেছে। উদ্ধারকারী দল এবং আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৪০ মিটার পুরু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের মাটি দুর্বল। ভূসংস্থান এবং মাটির প্রকৃতি সহ বিভিন্ন কারণের আবারও নতুন করে কোনও খনন করে সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে শ্রমিকদের বের করে আনা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১২,০০০ কোটি টাকার চারধাম হাইওয়ে প্রকল্প ২০১৬ সাল থেকেই বিতর্কের মুখে পড়েছে। এই বছরের দীপাবলির ধসটি সেই বিতর্ক ফের তুলে এনেছে। এই বছরই বর্ষাকালে এই প্রকল্পের অন্য অংশে, বদ্রীনাথ মহাসড়কের কিছু জায়গা ধসে পড়ার কারণে কয়েকদিন বন্ধ ছিল যাতায়াত। উত্তরাখণ্ডের এই টানেলটি কেন্দ্র সরকারের চার ধাম প্রকল্পের অংশ। উত্তরাখণ্ডের সিল্কিয়ারা এবং দান্দলগাঁওয়ের মধ্যে অবস্থিত এই টানেলটি উত্তরকাশী এবং যমুনোত্রীকে সংযুক্ত করছে। সরকার বারেবারেই জানিয়েছে, এই টানেল তৈরি হলে তীর্থযাত্রীদের ব্যাপক উপকার হবে। সব ধরনের আবহাওয়াতেই এই টানেল কার্যকরী থাকবে এবং NH-134 (ধারাসু-বারকোট-যমুনোত্রী সড়ক)-এর যে ২৫.৬ কিলোমিটারবরফ ঢাকা রাস্তা পেরোতে হয় সেই সফরের দৈর্ঘ্য কমে হবে ৪.৫ কিলোমিটার। যাত্রীদের ৫০ মিনিটের পথ কমে হবে ৫ মিনিটের রাস্তা।

আরও পড়ুন- ৭০ ঘণ্টা ধরে টানেলে আটকে ৪০ শ্রমিক! কেন বিতর্কিত উত্তরাখণ্ডের ৮৫৩ কোটির এই সুড়ঙ্গ?

২০০৪ সালে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র গ্রামে চার বছর বয়সি শিশু প্রিন্স ৫৩ ফুট গভীর এবং ৯ ইঞ্চি চওড়া গর্তে পড়ে যায়। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং শ্রমসাধ্য উদ্ধার অভিযান ছিল প্রিন্সকে উদ্ধার করার ঘটনাটিই। গ্রামবাসীরা প্রিন্সকে বের করার জন্য দড়ি নামিয়ে দিয়েছিল গর্তে। প্রিন্স তা বেয়ে উঠেত চেষ্টাও করে কিন্তু ২৫ ফুট এসেই ফের হাত ছেড়ে দেয়। গ্রামবাসীরাই পাশে আরেকটি বড় গর্ত খুঁড়তে থাকে। ২০ ফুট গভীর ছিলই সেই গর্ত, তা আরও ১৫ ফুট খুঁড়ে ফেলেন গ্রামবাসীরা। পরে সেনাবাহিনী এসে বিশাল সামরিক ক্রেন দিয়ে গর্ত খননের প্রক্রিয়াটিকে দ্রুততর করে। সেই গর্ত দিয়ে সমান্তরাল সুড়ঙ্গ কেটে প্রিন্সের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন সকলে। ৫০ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার অভিযানের পর প্রিন্সকে তার জন্মদিনেই বের করে নিয়ে আসা হয় গর্ত থেকে।

তবে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্ধারকাজ ছিল ২০১৪ সালের জার্মানির রাইজিং গুহায়। ২০১৪ সালের জুন মাসে স্পেলিওলজিস্ট জোহান ওয়েস্টহাউজার তাঁর দুই সহকর্মীর সঙ্গে জার্মানির রাইজিং গুহায় একটি অভিযান শুরু করেন। সে দেশের সবচেয়ে গভীর এবং দীর্ঘতম পিট গুহা হিসাবে বিখ্যাত এটি। গুহার মধ্যে আটকা পড়েন তারা। ১০০০ মিটার গভীরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে ওয়েস্টহাউসার মস্তিষ্কে আঘাত পান। কোনও যোগাযোগ সম্ভব ছিল না বহির্বিশ্বের সঙ্গে। এক সহকর্মী সাহায্য চাইতে ১০ ঘণ্টা ধরে গুহার মুখে ফেরার চেষ্টা করেন, সম্ভব হয় না। পরে উদ্ধারকারীদের তিনটি দল গুহায় ঢুকে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করে। ১১ দিন ধরে ৭০০-রও বেশি বহুজাতিক গুহা উদ্ধারকারী মিলে উদ্ধার কাজ চালায় এবং তিনজনকে বের করে আনে।

More Articles