বীর সাভারকার কি সত্যিই ছিলেন ‘বীর’?

Veer Savarkar: সাভারকার লেখেন, “আমি সমস্ত ধরনের চরমপন্থী কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করি এবং আমি আইন-শৃঙ্খলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবসময় কাজ করে যাব"।

গত ২৮ মে ভারতে পালিত হয় বিনায়ক দামোদর সাভারকর এর ১৩৩ তম জন্ম জয়ন্তী। ভারতীয় জনতা পার্টির তরফ থেকে এই নেতাকে স্মরণ করা হয় তার জন্ম দিবসে। বিজেপির তরফ থেকে এই নেতার গরিমা, তার বীরত্ব এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের কাহিনী বর্ণনা করা হয়। বিজেপির কাছে বিনায়ক দামোদর সাভারকার বীর সাভারকার হিসেবেই পরিচিত। বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে এবং ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে হঠাৎ করেই আবার উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার, ওরফে বীর সাভারকার। কিন্তু বীর সাভারকার কি সত্যি ততটা বীর? নাকি তাকে এই বীরের তকমা দেওয়া যুক্তিগ্রাহ্য নয়? তুল্যমূল্য আলোচনায় তাই আজকের মূল আলোচ্য বিষয় বীর সাভারকারের বীরত্ব।

৮৩ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। তার জীবনকালে তিনি নাকি তিনজন ব্রিটিশ আধিকারিককে হত্যা করেছিলেন। ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ৩ জন ব্রিটিশ অফিসরকে হত্যা করার ঘটনা বেশ গর্বের সঙ্গে আলোচনা করা রয়েছে। কিন্তু, বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সঙ্গে আরও বেশ কিছু কথা জড়িয়ে রয়েছে যা কিছু ক্ষেত্রে তার বীরত্বকে কিছুটা কম করে।

 অভিযোগ, বিনায়ক দামোদর সাভারকার সরাসরি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মহাত্মার হত্যা করার অপরাধে চার্জশিট ফাইল করা হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সাভারকারের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার জড়িয়ে থাকার বিষয়টি বছরের পর বছর ধরে আলোচিত হয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন- দূরদর্শনে মোদির স্তুতিতে তথ্যচিত্র! ঐতিহ্যের নামে বাদ পড়ল ভারতে প্রকৃত ইতিহাসই?

শুধু তাই নয়, তিনজন ব্রিটিশ অধিকারিককে হত্যার ঘটনাতেও তার পদক্ষেপ অত্যন্ত সন্দেহজনক। অনেকে বলেন, তিনি নাকি নিজের অনুগতদের ভুল পথে চালিত করে এই ব্রিটিশদের হত্যা করেছিলেন। তারপর এই হত্যাকাণ্ডের থেকে নিজের সমস্ত প্রমাণ মুছে ফেলে তিনি পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে যান। তার ভক্তদের সঙ্গে প্রতারণা করতে তার একবারও খারাপ লাগেনি। বরং তিনি বারংবার একই জিনিস করে এসেছেন। তিনি নাথুরাম গডসের সঙ্গেও একইভাবে প্রতারণা করেছেন। কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি মুখপত্রে (সম্ভবত কংগ্রেসের), যার নাম ছিল, ‘বীর সাভারকার কিতনে বীর’, দাবি করা হয়েছে, নাথুরামের সঙ্গে বীর সাভারকারের নাকি সমকামিতার সম্পর্ক ছিল। যদিও এই কথাটির কোনও প্রমাণ নেই। আন্দামানের জেলে বিনায়ক দামোদর সাভারকার বেশ কিছুদিন বন্দি ছিলেন। শোনা যায় তিনি নাকি ব্রিটিশদের কাছে মুক্তির আর্জি রেখেছিলেন, দেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান খুব একটা বেশি নয়। তবে ওই ৩টি হত্যা এখনও পর্যন্ত বিনায়ক দামোদর সাভারকরের গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে।

 বিনায়ক দামোদর সাভারকরের মূল তিনটি রাজনৈতিক খুনের জন্য তাকে এখনও পর্যন্ত মনে রাখা হয়। প্রথমটি হলো, স্যার উইলিয়াম কার্জন উইলির খুন। এক্ষেত্রে, ১৯০৯ সালের পহেলা জুলাই মদন লাল ধিংরা তাকে হত্যা করেন লন্ডনে। এর আগেও ধিংরা ভাইসরয় লর্ড কার্জনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

দুর্ভাগ্যবশত লর্ড কার্জন মিটিং সেরে বেরিয়ে যাবার পরে মদন লাল ধিংরা সেখানে পৌঁছন। উইলির খুনের মামলায় মদন লাল ধিংরাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তারপর তার ফাঁসি হয়। কিন্তু এই মামলা থেকে সরাসরি বেরিয়ে পড়েন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। তার বিরুদ্ধে কোনও সঠিক প্রমাণ ছিল না, যার মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হতো।

দ্বিতীয়টি হল এমটি জ্যাকসনের হত্যাকাণ্ড। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন নাসিকের ম্যাজিস্ট্রেট। তবে এই খুনের মামলায় একটি কাহিনি রয়েছে নেপথ্যে। ব্রিটেনে আইন নিয়ে পড়তে যাওয়ার আগে বিনায়ক দামোদর সাভারকার একটি  গুপ্ত সংস্থা মিত্র মেলার সদস্য ছিলেন। সেই সংস্থা পরবর্তীতে অভিনব ভারত হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে। এই সংস্থা মূলত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং চরমপন্থী মনোভাব পোষণ করত। বিনায়ক দামোদর সাভারকরের বড় ভাই গণেশ সাভারকার এই গোষ্ঠীর একজন বড় সদস্য ছিলেন। বড় সংখ্যক বোমা নিয়ে পুলিশ গণেশ সাভারকারকে গ্রেফতার করে। তারপরে, ১৯০৯ সালের ৮ জুন তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কিন্তু, এই ঘটনার পরেই গণেশ সাভারকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বন্ধু অনন্ত কাহারে নাসিকের তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এএমটি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি যখন তিনি মারাঠি একটি নাটক দেখছিলেন সেই সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জ্যাকসন গণেশ সাভারকারের ট্রায়ালের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেই কারণে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সাভারকারের সঙ্গীরা।

কিন্তু তার পরেই হঠাৎ করে জড়িত হয়ে যান বিনায়ক দামোদর সাভারকার। অনন্ত কাহারের সঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় বেশ কিছু চিঠিপত্র যেগুলো ছিল বিনায়ক দামোদর সাভারকরের। এছাড়াও উদ্ধার হয় একটি ব্রাউনিং পিস্তল যেটি সরাসরিভাবে খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল। অন্যদিকে বিনায়ক দামোদর সাভারকার এইরকম ২০টি অস্ত্র ইংল্যান্ড থেকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, যখন তিনি আইন নিয়ে পড়ার জন্য ব্রিটেনে গেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের খপ্পরে পড়েন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। ১৯১০ সালে মার্চ ১৩, বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে নিয়ে আসা হয় ভারতে। তারপরে তার বিরুদ্ধে মামলা চলে। জ্যাকসন এর হত্যাকাণ্ড এবং ব্রিটেনের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা- দু'টি মামলা নিয়ে তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে ব্রিটেন সরকার। আন্দামানের সেলুলার জেলে তাকে নির্বাসন দেওয়া হয়।

কিন্তু এরপরে আসে সেই পর্যায়টি, যার জন্য বিনায়ক দামোদর সাভারকার অনেকের কাছে অপরাধী। আন্দামানের সেলুলার জেলে অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। জেলে থাকার সময় সাভারকারকে তেলের মিলে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু জানা যায়, এই তেলের মিলে কাজ করার সময় তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

সাভারকারের ক্ষমা পর্ব –

১৯১১ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য একটি আবেদন পত্র প্রদান করেন। এখনও পর্যন্ত সেই আবেদন পত্রের কপি কোথাও না পাওয়া গেলেও ১৪ নভেম্বর ১৯১৩ সালের আবেদনপত্র তিনি আগের আবেদনপত্রের উল্লেখ করেছিলেন।

নতুন আবেদন পত্রে তিনি আরও একবার ক্ষমা চেয়ে ছিলেন এবং সেখানে তিনি অনুরোধ করেছিলেন যেন তাকে ভারতের কোন একটি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি তার বক্তব্যে লিখেছিলেন, “আমাদের ভাগ্য বিধাতা যদি একটু ক্ষমাশীল হন, তাহলে এই হতভাগ্য ছেলে তার কাছে ক্ষমা চাইতে চায়" এবং আর্জি জানান যেন সরকারের কাছে সে যেতে পারে।"এই পত্রটি আসার পরেই রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়ায়। এই পত্রে সাভারকার সরাসরি লিখেছিলেন তিনি সরকারকে সাহায্য করতে চান। এছাড়াও তিনি স্বীকার করেন, তিনি আর হিংসার পথ অবলম্বন করবেন না। ব্রিটিশ সরকার এতে তেমন ভাবে খুশি না হলেও, তার এই আবেদনপত্র তার দুর্দশাকে কিছুটা ঘোচাতে পেরেছিল। আন্দামানের জেলেও তিনি এবং তার ভাই অন্যদের উস্কে দিয়ে নিজেরা সেখান থেকে সরে যান। ঐতিহাসিক আরসি মজুমদার লিখেছিলেন, সেলুলার জেলে সাভারকারের সঙ্গী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গেও তিনি কিছুটা এরকম করেছিলেন। মজুমদার লিখেছিলেন, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী সঙ্গে একটি কথোপকথনে জানা গিয়েছিল বিনায়ক সভারকার তাদেরকে আমরণ অনশন করতে বলে উদ্বুদ্ধ করার পরেও না তিনি, এবং না তার ভাই এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৃদ্ধরাও যেখানে অনশনে বসে গিয়েছিলেন, সেখানে বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে দেখা যায়নি।

ভারতে ফিরে এসে পুনের ইয়েরওয়াড়া জেলে ঠাঁই হয় বিনায়ক দামোদর সাভারকরের। ১৯২১ এর মে মাসে বারংবার আবেদনপত্র দেওয়ার পরে ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে বিনায়ক দামোদর সাভারকর এর কাছে কিছু শর্ত দেওয়া হয়। জানানো হয় সেই শর্তগুলি পালন করলে তাকে ইয়েরওয়ারা জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

এই শর্তগুলো ছিল - দামোদর সাভারকারকে শুধুমাত্র রত্নগিরি এলাকায় থাকতে হবে। তিনি সেই এলাকা থেকে বের হতে পারবেন না। ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সর্বসমক্ষে তিনি কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারবেন না। প্রত্যেক ৫ বছর অন্তর শর্ত আবারও রিনিউ করাতে আসতে হবে। সাভারকার এই সমস্ত শর্তগুলিকে মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করতে চান। বিনায়ক দামোদর সাভারকার লেখেন, “আমি সমস্ত ধরনের চরমপন্থী কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করি এবং আমি আইন-শৃঙ্খলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবসময় কাজ করে যাব"।

১৯২৫ সালে রঙ্গিলা রসুল যৌন যে হিন্দু-মুসলিম বিদ্রোহ লেগেছিলো সেখানে নবী মোহাম্মদের একটি ভয়াবহ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। পঞ্জাবের বেশ কিছু জায়গায় এই ভয়াবহ পত্রিকা ছড়িয়ে পড়ে। তার পরিপ্রেক্ষিতে, মাহরাট্টা পত্রিকায় একটি বিদ্রোহী কলাম রচনা করেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে, তাকে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয় এইরকম লেখা প্রকাশ করা যাবে না।

আরও পড়ুন- “আমার নাম সাভারকর নয়…”, সাংসদ পদ খারিজের পর সাংবাদিক বৈঠক, কী বললেন রাহুল গান্ধী?

এরপর আসছে তার তৃতীয় রাজনৈতিক খুনের ঘটনা। এই ঘটনায় ২২ জুলাই ১৯৩১ সালে ভিবি গোগাতে মুম্বাইয়ের তৎকালীন অ্যাক্টিং গভর্নর অর্ণস্ট হোস্টনকে গুলি করে হত্যা করেন পুনের ফার্গুসন কলেজের সামনে। কিন্তু, সৌভাগ্যবশত হোস্টন বেঁচে যান। এই ঘটনায়, কোনভাবেই সন্দেহের তীর যাচ্ছিল না বীর সাভারকারের দিকে। কিন্তু, ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়, বিনায়ক দামোদর সাভারকর এর একজন খুব কাছের মানুষ ছিলেন এই গোগাতে। এবং কোথা কিছুদিন আগে তিনি বীর সাভারকারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সম্ভাবনা আছে বীর সাভারকার তাকে হোস্টনকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

কিন্তু বিনায়ক দামোদর সাভারকার এর সঙ্গে জড়িত সবথেকে বিতর্কিত ঘটনাটি হল মহাত্মা গান্ধী হত্যা। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে নাথুরাম গডসে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে ৫ ফেব্রুয়ারি বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপরে আরও একটি ক্ষমাপত্র। তাতে পরিষ্কার করে লেখা রয়েছে,

“আমাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয় তাহলে সরকারের সঙ্গে কাজ করে আমি তাদের কথা মতো চলব এবং তারা যত দিন চাইবেন ততদিন পর্যন্ত আমি কোনও রকম রাজনৈতিক এবং বিতর্কিত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকব না"।

তারপর থেকেই সন্দেহের তির যেতে শুরু করে, হয়তো গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রী এই বিনায়ক দামোদর সাভারকার। কিন্তু বুদ্ধির জোরে তিনি আবারও বেঁচে যান, এবারেও আদালতে তার ভূমিকা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তার অনুগামীরা, তার মৃত্যুর পরে বিভিন্ন তথ্য উদঘাটন করতে শুরু করেন তখন থেকে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসতে থাকে, যার মাধ্যমে সম্ভাবনা তৈরি হয় গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হয়তো বিনায়ক দামোদর সাভারকার জড়িত।

বীর সাভারকার কি সত্যিই ছিলেন ‘বীর’?

নরেদ্র মোদির শ্রদ্ধার্ঘ । ছবি সৌজন্যে: Google

ভারতের হিন্দুত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে গিয়েছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। এছাড়াও ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থানে এবং তাদের কাজকর্মের সঙ্গে বিনায়ক দামোদর সাভারকার বেশ কিছুটা জড়িত। বিরোধী নেতারা তার আদর্শে খুব একটা বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু বেশ কিছু জায়গাতে বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে একজন হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। তবে, সেখানেও বিনায়ক দামোদর সাভারকার কে কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে হিসেবে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বরং সেই সমস্ত জায়গায় তাকে একজন সামাজিক বিপ্লবী হিসেবেই সামনে রাখা হয়েছে।

 

 জনপ্রিয় লেখক ধনঞ্জয় কির তাকে সরাসরি একজন সামাজিক বিপ্লবী হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন। অস্পৃশ্যতা নিয়ে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের যে লড়াই সেটা ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকী অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তার আন্দোলনে নাকি মুগ্ধ হয়েছিলেন আম্বেদকরও। সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী, নাৎসি এবং হিটলারের প্রতি মর্মস্পর্শী এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর তথা সামাজিক বিপ্লবীর জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। বিদেশি লেখক-লেখিকারাও তার কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছেন। তবে তার সব থেকে বড় অবদান ছিল ভারতে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়েই। হিন্দুত্বের সঙ্গে পাশ্চাত্য রীতিনীতির একটা মিলন ঘটিয়েছিলেন তিনি। তিনি মনে করতেন নাৎসি এবং ফ্যাসিবাদী নীতিগুলি জার্মানি এবং ইতালিতে অন্যভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে তিনি কোথাও হিটলারকে সমর্থন করেন না। তার মতে বলশেভিক এবং গণতন্ত্র এই দু'টি নীতিও দুনিয়ায় সব থেকে বেশি জনপ্রিয় চারটি রাজনৈতিক রীতিনীতির মধ্যে অন্যতম। ভারতের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বিষয় নিয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন। সে দিক থেকেই তিনি হিটলারের প্রতি কিছুটা মর্মস্পর্শী। কিন্তু কখনোই, এটা মনে করতেন না যে ভারতে হিটলারের নীতি কার্যকর করতে হবে।

আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা কেন বিশ্বের সবার থেকে আলাদা- ঠিক এরকমই একটি নীতি প্রচার করতে এসেছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। তিনি বলতেন, “কোনও রাজনৈতিক পন্থা কোনও একটি দেশের সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এটা সম্ভব নয়। কিছু মানুষ পাশে থাকবেন, আবার কিছু মানুষ বিরোধিতা করবেন। কিন্তু ভারতের বিদেশনীতি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করবে আমাদের জাতীয় রীতিনীতি এবং আমাদের পছন্দের উপর। কোনও সরকারকে অনুসরণ করে নয়, বরং আমাদের দেশে আমাদের সরকার চলবে। আমাদের আলাদা সিকিউরিটি পলিসি থাকবে।"

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নিজেও ভারতের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বাস্তববাদী চিন্তা ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারত আজ যা ভাববে, কাল সেটাই হবে। কিন্তু বিনায়ক দামোদর সাভারকারের নীতি সকলে খুব একটা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি, নেপথ্যে তার হিন্দুত্বের চিন্তাভাবনা। ভারতীয় জনতা পার্টির ক্ষেত্রে এই চিন্তা ভাবনা ভবিষ্যতের অক্সিজেন। মানুষটির চিন্তা ভাবনা নিয়ে এখনও অনেক কিছু জানা বাকি। স্বাধীনতা সংগ্রামে হোক, কিংবা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ভূমিকা এখনও বেশ ধোঁয়াশা মাখাই।

More Articles