খসে গেছে কত মুখ! স্মৃতিতে আজও অক্ষয় মহিষাদলের এই নিজস্ব কার্নিভাল!

Durga Puja 2023 : নন্দঢাকি একপ্রকার আমাদের অগোচরে চলে গেছিলেন। তারপর একদিন খবর এল নন্দঢাকি মারা গেছেন।

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মহিষাদলে। বাড়ির খুব কাছেই একটা সাদামাটা পুজো হয়। এই পুজো আমার ছোটবেলার পুজো। আমার কিশোরী বেলার পুজো। যে ক'টা দিন বাড়ির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে ছিলাম, সেই ক'টা দিনের পুজো। আমাদের এই পুজো বাড়ি ফেরার গল্প। বাড়ি না ফেরারও গল্প। চিরবিচ্ছেদের গল্প। ফিরে আসা ও ছেড়ে চলে যাওয়ার গল্প। এ পুজো যেন আমাদের নিজস্ব 'অক্ষয় মালবেরি'।

আমাদের পুজোয় তথাকথিত কোনও থিম নেই। পুরনো ক'টা চেনা মুখের সঙ্গে দেখা হবে। সমস্ত দূরত্ব ঠেলে যখন পরবাস থেকে বাড়ি ফিরব, সেই ক'টা চেনা মুখ জিজ্ঞাসা করবে কবে এলাম, কতদিন আছি। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে ক'টা মানুষ পুজো দিতে আসবে। পাড়ভাঙা শাড়ি আর সিঁদুরের টিপ পরে ঠাকুরকে গড় করবে। তারপর ঠাকুরের সামনে নাক মুলবে, কান মুলবে। পরিবারের মঙ্গলকামনা করবে। হয়তো এটাই আমাদের পুজোর 'থিম'।

আমাদের পুজোয় উমার সামনে দাঁড়িয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ বামুন অভিযোগ-অনুযোগও জানাতে পারেন। মায়ের কাছে সন্তান নালিশ জানাবে, এ আর কী এমন বড় কথা! আবার তাঁর দিকে আঙুল তুলে, ধমক-ধামকও দেন বৃদ্ধ। সন্তানকে স্নেহের বশে যেমনটা করেন মা-বাবা। তারপর নালিশ কিংবা শাসনের পর্ব শেষ হলে, আবার আনন্দে মৃদুচালে কোমর দুলিয়ে দেবীর আরতিতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন তিনি। আর বিসর্জনের আগে চোখের কোণ মুছে উমাকে জানাবেন, হয়তো পরের বছর থেকে আর উমার সঙ্গে দেখা হবে না তাঁর। উমার পুজো, তাঁকে ভক্তিজ্ঞাপন যেন এই বৃদ্ধের কাছে এখনও এক কার্নিভাল। এখানে কোনও কড়া অনুশাসন নেই। কিন্তু আনন্দ আছে। আছে গ্রাম্য সারল্য। আছে মা আর সন্তানের মধ্যে অমোঘ কোন পিছুটান।

আরও পড়ুন- সর্বজয়া নয়, আসলে ইন্দির ঠাকরুনেরই সন্তান দুর্গা…

মহিষাদল জায়গাটা এখন মফসসলে পরিণত হলেও (মতান্তরে জনপদ), আমি যখন জন্মেছিলাম তখন জায়গাটা ধ্যাড়ধেড়ে গ্রাম। টিমটিম করে হাতে গোনা কয়েকটা পুজো হতো। এখন অবশ্য পুজোর সংখ্যা বেড়েছে। বেশ কিছু জায়গায় আবার 'থিমপুজোর' কনসেপ্টও এসেছে। কিন্তু থিম পুজো বাদ দিলে, যে ক'টা খুব সাধারণ পুজো এখনও হয়, তাদের মধ্যে আমাদের এই পুজো একটি।

থিম দূরের কথা, কয়েকজন লোক মিলে চাঁদা তুলে এই পুজোর আয়োজন করেন। তারপর পুজোর ক'টা দিন নিজেরাই খেটেখুটে পুজোর নিয়ম-কানুন, আনন্দ, হাসি-ঠাট্টা জিইয়ে রাখেন। কোনও এক বছর তো নিন্দুকে রটাল, আমাদের পুজোটাই নাকি উঠে যাচ্ছে।

তা দুগগা দুগগা করে এ বছরও আমাদের দুগগা পুজোটা হচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতোই। শুধু প্রতি দশমীতে যে বৃদ্ধরা আগামী বছর পুজোটা আদৌ হবে কিনা, তাই ভেবে চিন্তা করতেন, কিংবা শুকনো গলায় বলতেন হয়তো এই পুজোই তাঁদের জীবনের শেষ পুজো, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু মুখ আর নেই।

আমাদের এই পুজোরই এক সদস্য, পুজোর ওই ক'টা দিন দিন-রাত এক করে পুজোর প্রতিটা রীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। তাঁর একটু 'রাম'-নামের অভ্যেস ছিল (মতান্তরে বদঅভ্যেস)। পুজোর দিনগুলোও বাদ যেত না। আর আমাদের 'বাঙালি ভার্সনের' শক্তিরূপিণীদের যেহেতু মদ-মাংসে কোনওদিনই বিশেষ আপত্তি ছিল না, আমি তাঁকে 'রামনামের' জন্য কীভাবেই বা কাঠগোড়ায় তুলতে পারি? 

তা কোনও এক বছর ভরপেট 'রামনাম' করে তিনি বসলেন সন্ধিপুজোতে। হাত লাগালেন একশো আটটা পদ্মের কুঁড়িকে ফুটিয়ে তোলার কাজে। কিন্তু মুশকিল হলো তিনি কিছুতেই আর বুঝতে পারেন না, ফুলগুলো সোজা না উলটো। এক-একটা ফুল হাতে নিয়ে একবার সোজা, তো একবার উলটো করে ধরে দেখতে লাগলেন। এ সবের মাঝেই, তাঁর হঠাৎ মনে হলো আস্ত দেবীঘটটাই উলটো করে বসানো। তিনি রওনা দিলেন দেবীঘট সোজা করতে। কোনও রকমে ক্ষান্ত করা হলো তাঁকে। তখন সম্ভবত আমি স্কুলের গণ্ডি পেরোব পেরোব করছি। কিংবা সেই বছরেই কলেজে উঠেছি। এসবের মাঝেও কিন্তু তিনি নিজের দায়িত্ব থেকে একচুলও নড়েননি কোনওদিনই।

তারপর অনেকটা বছর কেটে গেছে। গত পুজোয় জানতে পারলাম সেই ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। অশৌচের কারণে তাঁর পরিবারের কেউই পুজোয় আসতে পারেননি। সে বছর পুজোয় থিম ছিল না বটে, তবে বেখাপ্পা মণ্ডপসজ্জা আর অনাবশ্যক চকমকি আলোরও কমতি ছিল না। কিন্তু এত কিছুর পরেও কেমন খাঁ-খাঁ করছিল সবটা। একজন অন্য পরিবারের লোক, যার সঙ্গে আমার পুজোর ওই ক'টা দিনই সকাল-বিকেল দেখা হয়, পুজোয় তাঁকে না দেখতে পেয়ে মনে হয়েছিল আমার ছোটবেলার পুজো থেকে কী যেন একটা খসে পড়েছে৷ হারিয়ে গেছে চিরতরে। সে সব আর ফিরে আসবে না।

আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়

আমি যখন আরেকটু ছোট ছিলাম, তখন নন্দঢাকি আমাদের পুজোয় ঢাক বাজাতেন। বিসর্জনের পরে দেখতাম কাঁধে ঢাক তুলে, মোরামের লাল রাস্তা ধরে নিজের গ্রামের পানে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। গাছপালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে শরৎ-সূর্যের বিষণ্ণ রোদ তাঁর উপর হেলে পড়ছে। বুক-চিনচিনে মৃদু উত্তরে বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর সারা শরীর। শুকনো পাতা গাছ থেকে খসে পড়ছে পায়ের কাছে। আর নন্দঢাকি ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছেন অনেক দূরে।

নন্দঢাকি একপ্রকার আমাদের অগোচরে চলে গেছিলেন। তারপর একদিন খবর এল নন্দঢাকি মারা গেছেন।

তারপরও বহু মুখ অগোচরে চলে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। কত স্মৃতি, কত হাসি, কত আনন্দ-অভিমান। শরৎ এসে সে সব মনে করিয়ে দেয়। আমরা যারা ঘর-বাড়ি-স্বজনকে ছেড়ে চিরতরে নিরুদ্দেশের পানে পাড়ি দিয়েছিলাম, পাড়ি দেওয়ার আগে সেসব অক্ষয়-স্মৃতি কাঁধে তুলে একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে গেছিলাম, নন্দঢাকির মতই।

"সামান্য এই চলে যাওয়া নিয়ে মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আজ জানি, ওই চলে যাওয়াটা ছিল ঠিক মৃত্যুর মতো। মৃত্যুকালে কেউ কি বোঝে, এই যে চলে যাচ্ছে, আর ফিরবে না! তাকে বারবার সবাই বলছে, আবার জন্মাবি, আবার ফিরে আসবি। এই বাড়ি ঘর নদী নক্ষত্র সব তো রইল তোর।"

More Articles