সাড়ে ৪৫ হাজার বছরের পুরনো ভাইরাস ডেকে আনছে সর্বনাশ! আবার ঘনাবে মহামারীর কালো ছায়া?

Zombie Virus: এই ভাইরাস যে মেরু অঞ্চলের বরফের গলনের ফলে আবারও যে মাথাচাড়া দিতে পারে, সেই ভয়টাই বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে পাচ্ছিলেন।

রাশিয়ার পার্মাফ্রস্ট অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী বরফের স্তর থেকে পাওয়া গেল সাড়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার বছরের পুরনো ভাইরাস। আর তার জন্য দায়ী কিন্তু সেই বিশ্ব উষ্ণায়ন। যার জন্য হু হু করে গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য মাইক্রোবসরা মেরু অঞ্চলের বরফের গলনের ফলে আবারও যে মাথাচাড়া দিতে পারে, সেই ভয়টাই বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে পাচ্ছিলেন এবং সেই ভয়টাই এবার সত্যি হলো।

ফ্রান্স, জার্মানি এবং রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রস্টের সাতটি আলাদা আলাদা নমুনা থেকে ইতিমধ্যেই তেরোটি ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছেন। আরও দু'টি ভাইরাসের একটি পেয়েছেন লিনা রিভার এবং অপরটি কামচাটকা ক্রায়োসল থেকে। সাম্প্রতিক এই গবেষণাটি প্রি-প্রিন্টের আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'বায়োআর্কাইভ'-এ। প্রকাশিত গবেষণার পিয়ার-রিভিউ এখনও বাকি।

গবেষকরা জানিয়েছেন যে, ভাইরাসগুলি পাওয়া গেছে, সেগুলি প্যান্ডোরাভাইরাস, সেড্র্যাটভাইরাস, মেগাভাইরাস, প্যাকম্যানভাইরাস এবং পিথোভাইরাস– এই পাঁচটি ভিন্ন 'ক্লেড'-এর অন্তর্গত। এর 'ক্লেড'-গুলির একটিও এর আগে কখনও পার্মাফ্রস্ট থেকে অন্তত উদ্ধার হয়নি। এবং এই পাঁচটি ক্লেডের প্রতিটি ভাইরাস অ্যাকান্থামিবাকে আক্রমণ করে। এরা প্রত্যেকেই ইউক্যারিওটিক ডিএনএ ভাইরাস।

আরও পড়ুন: শুকোচ্ছে ফুসফুস, আয়ু কমছে কলকাতার! অতিবৃষ্টিতে জল জমা নিয়ে ভয়াবহ তথ্য

মেরু অঞ্চলে তৈরি হওয়া পার্মাফ্রস্ট কয়েকশো বা হাজার নয়, এরা অন্তত কয়েক মিলিয়ন বছরের পুরনো। আর সেই অতিপ্রাচীন বরফের স্তরেই চাপা পড়ে ছিল সাড়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার বছরের পুরনো এই ভাইরাসগুলি। সুদীর্ঘকাল যাবৎ সুপ্ত অবস্থায় চাপা পড়ে থাকায় এদের বলা হয় 'Zombie' ভাইরাস। অনেকেই 'Zombie' ভাইরাসকে নেহাৎ নিরীহ বা রোগসৃষ্টির ক্ষমতাহীন বলে মনে করলেও, সব 'Zombie' ভাইরাস কিন্তু তা নয়। সাম্প্রতিককালে প্রি-প্রিন্টের আকারে প্রকাশিত এই গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সাড়ে সাড়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর ধরে এই প্রাগৈতিহাসিক ভাইরাসগুলি পার্মাফ্রস্টের মোটা বরফের আস্তরণে চাপা পড়ে থাকলেও, রোগসৃষ্টির ক্ষমতা এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। সুযোগ পেলেই তারা অ্যাকান্থামিবাকে আক্রমণ করতে পারে।

এই ভাইরাসগুলির মধ্যে অন্যতম হলো, Cedratvirus Kamchatka, Cedratvirus lena, Pandoravirus lena, Pandoravirus talik, Cedratvirus duvanny, Pandoravirus duvanny, Pandoravirus yedoma, Pandoravirus mammoth, Megavirus mammoth, Pithovirus mammoth, Pandoravirus mammoth, Pandoravirus lupus, এবং Pacmanvirus lupus

'Zombie' ভাইরাস ভয়াবহ রোগসৃষ্টির ক্ষমতাই শুধু রাখে না, নতুন আরেকটি মহামারী বা অতিমারীর জন্ম দেওয়ার মতো ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। জানাচ্ছেন এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা। তবে উদ্ধার হওয়া ভাইরাসগুলি যদি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী, এমনকী গাছের শরীরেও রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রাখত, তাহলে ভয়াবহ ফল হতে পারত।

এই গবেষকদের একাংশই ঠিক ২০১৪ সালে রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের পার্মাফ্রস্টে অস্বাভাবিক বড় আকারের পিথোভাইরাসের সন্ধান পেয়েছিলেন। এই পিথোভাইরাসগুলি ছিল তিরিশ হাজার বছরের পুরনো। এবং এত পুরনো পিথোভাইরাসকে গবেষকরা আবারও সক্রিয় করতে পেরেছিলেন। সেখান থেকেই এই গবেষকদের আশঙ্কা দানা বাঁধে যে, এত পুরনো ভাইরাসগুলি নিশ্চুপে বরফের মোটা চাদরের নিচে সুপ্ত থাকলেও, সেই বরফ গলতে শুরু করলে ভাইরাসগুলি মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না। এবং সেই সময়, অর্থাৎ ২০১৪ সালেই মেরু অঞ্চলের খননকর্মীদের সাবধান করা হয়।

গবেষকরা জানাচ্ছেন, বিশ্বউষ্ণায়নের ফলে ক্রান্তীয় অঞ্চলে যত তাপমাত্রা বাড়ে, মেরু অঞ্চল বা তুন্দ্রা অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ে তার দ্বিগুণ। আর গ্রীষ্মকাল হলে তো আর কথাই নেই। ফলে বেলাগামভাবে গলছে সুপ্রাচীন বরফের স্তরও।

এর আগে পার্মাফ্রস্টের গভীর স্তরে ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাক্সের সন্ধানও অন্যান্য গবেষকরা পেয়েছিলেন। তবে তাও পার্মাফ্রস্ট খুঁড়ে কষ্ট করে বের করতে হয়নি। বিশ্বউষ্ণায়ন-জনিত কারণে পার্মাফ্রস্টের গলনই সেই ভয়কে যেন প্রাগৈতিহাসিক কবর খুঁড়ে বের কর এনেছিল।

আরও পড়ুন- আমাদের শরীরে লুকিয়ে প্রাচীন ভাইরাসের জিন! নতুন গবেষণায় তোলপাড় বিশ্বজুড়ে

ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাক্স, সেই মারণ ব্যকটেরিয়া যা অ্যানথ্রাক্স নামে সারা বিশ্বে পরিচিত, এবং এক সময়ে যা 'বায়োওয়েপন' বা জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে রোগ ছড়াতে তো বটেই এবং রোগ ও মৃত্যুর আতঙ্ক সৃষ্টি করতে তখন অ্যানথ্রাক্সের জুড়ি মেলা ভার। তবে শুধু অ্যানথ্রাক্স না। আর্কটিক লেকের মাটির স্তরে পাওয়া গেছে পক্স ভাইরাস, হার্পিস ভাইরাস, এবং আসফার ভাইরাসও। এরা যে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ভয়াবহ রোগের কারণ, তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, পার্মাফ্রস্টে যে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়, সেগুলির কোশে ইতিমধ্যেই পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিন রয়েছে। অর্থাৎ, একাধিক ব্রড স্পেক্ট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও যে এদের আটকানো যাবে না, সেকথা অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিনের উপস্থিতি-ই স্পষ্ট করে দেয়।

সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ এবং লাগামহীন ব্যবহারেই ব্যকটেরিয়া নিজেদের অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে তোলে। তাদের জিনগুলি দ্রুত মিউটেট করে ব্যকটেরিয়াগুলিকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য গড়েপিটে নেয় খুব দ্রুত। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কালে যখন অ্যান্টিবায়োটিকের ধারণা মানুষের মধ্যে ছিল না, অথচ প্রাগৈতিহাসিক ব্যাকটেরিয়া সেখানে দাঁড়িয়ে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিন শরীরে রেখে আগেই সাবধানী ঢাল সাজিয়ে বসে থাকে, অবাক তো সেখানে হতেই হয়!

ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়, যে রোগভয়কে আমরা কবরচাপা দিয়ে একদিন নিশ্চিন্ত ঘুম দিয়েছিলাম, কেবল আমাদের কৃতকর্মের ফলে কবর, থুড়ি পার্মাফ্রস্ট খুঁড়েই আমরা সেই আতঙ্ককে বের করে আনছি।

More Articles