হিন্দু গৃহস্থবাড়িতে নিষিদ্ধ মাংস খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিবেকানন্দ

হিন্দু ধর্মে মুরগির মাংস গৃহস্থে ঢোকা যখন অনাচার, তখন তা খেয়ে ও খাইয়ে কুসংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, সমাজে বইয়ে দিয়েছেন মুক্তচিন্তার স্রোত, তাই তো তিনি যুগোত্তীর্ণ যুগপুরুষ।

 

কে রে ওরে দিগম্বরা এসেছে কুটিরঘরে...

হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটে হাজির হলেন স্বামীজি। নৌকো থেকে নেমেই গলায় ঝুলিয়ে নিলেন খোল। উদাত্ত কণ্ঠে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন গিরিশ ঘোষের লেখা এই গান। সঙ্গে গলা মেলালেন অন্যান্য সন্ন্যাসীরা।

দিনটা ১৮৯৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। মাঘী পূর্ণিমা তিথি। আলমবাজার মঠ থেকে ৩টি নৌকোয় ১৫ জন সন্ন্যাসীকে নিয়ে হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটে হাজির হলেন তরুণ স্বামীজি। তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখতে হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটে সেদিন রীতিমতো ভিড় জমে গিয়েছিল। তাঁদের দিকে নজর না দিয়ে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চললেন স্বামী বিবেকানন্দ। চললেন রামকৃষ্ণপুরের নবগোপাল ঘোষের বাড়িতে।

কিছুক্ষণ পর ঘোষবাড়ির ঠাকুরঘরে অবতাররূপে গুরুদেবের পুজো করেন তিনি। তারপর বাড়ির গিন্নির হাতে তুলে দেন এক অপরূপ উপহার। নিজের পাগড়ি। প্রায় ১২৩ বছর আগের কথা। স্বামী বিবেকানন্দ মানেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাগড়িপরা সৌম্যকান্তি এক তরুণ সন্ন্যাসীর ছবি। অথচ সন্ন্যাসজীবন প্রথমে তাঁর সঙ্গী ছিল না। ১৮৯১ সালে রাজস্তানের ক্ষেত্রির মহারাজা অজিত সিংহর অনুরোধে প্রথম তিনি এই পাগড়ি পরেন। সেই বেশেই শিকাগো ধর্মসম্মলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন স্বামীজি। এই ঘটনা তার কিছু পরে।

আরও পড়ুন: পছন্দ ছিল না কালীর রুদ্ররূপ, রামকৃষ্ণকেও সহজভাবে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ

নবগোপালবাবু ছিলেন তৎকালীন একটি মার্চেন্ট ফার্মের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট। শ্রীরামকৃষ্ণর গৃহী ভক্তদের মধ্যে অন্যতম। ১ জানুয়ারি, ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ 'কল্পতরু’ হলে নবগোপালকে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বলেন। সেই কারণে নবগোপালের মুখে লেগে থাকত 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি। নবগোপালবাবু সপরিবারে রাজাবাজারের কাছে বাদুড়বাগানে থাকতেন। নবগোপালের বাদুড়বাগানের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি পড়েছিল। ১৮৯০ সালের শেষের দিকে নবগোপালবাবু হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে নতুন বাড়ি করে চলে আসেন। সেই বাড়িতে রামকৃষ্ণ মঠের অনেক সন্ন্যাসীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অনেক সন্ন্যাসী গেলেও বহুদিন সেখানে পদধূলি পড়েনি স্বামীজির। শিকাগো ধর্মসম্মেলনের পর স্বামীজি দেশে ফিরলে তাঁর বাড়িতে স্বামীজিকে শ্রীরামকৃষ্ণর মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরোধ করেন। স্বামীজি নবগোপালের বাড়িতে প্রতিষ্ঠার জন্য বার্লিন থেকে আনা পোর্সিলিনের তৈরি শ্রীরামকৃষ্ণর একটি মূর্তি এনেছিলেন। সেই মূর্তিটি মাথায় করে স্বামী প্রকাশানন্দজী গঙ্গার ঘাট থেকে নবগোপালবাবুর বাড়িতে নিয়ে যান। সেইদিন থেকে স্বামীজির রচিত প্রণামমন্ত্রে এখানে আজও পূজিত হন শ্রীরামকৃষ্ণ।

এই দিন স্বামীজি আরও একটি কাজ করলেন, সারদা মায়ের নামে সংকল্প করে পুজো শুরু করলেন। পুজো-শেষে হঠাৎ নবগোপালবাবুর স্ত্রী নিস্তারিণী দেবীর কাছে রামপাখির মাংস খাওয়ানোর অনুরোধ করে বসেন স্বামীজি। সেযুগে মুরগিকে রামপাখি বলা হতো। তাঁর রাঁধা মুরগির মাংসর পোলাও স্বামীজি বেশ তৃপ্তি করে খেলেন। ফেরার সময় নিস্তারাণীদেবীকে কাছে ডেকে বলেন, "আমি সন্ন্যাসী মানুষ। আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তবে আমার এই পাগড়িটি সামান্য উপহার হিসেবে দিচ্ছি।"

নবগোপালবাবুর বাড়িই সেই বাড়ি, যেখানে প্রথম ঠাকুরের প্রণামমন্ত্র রচিত হয়। আজ তা সারা বিশ্বে ভক্তদের মুখে উচ্চারিত হয়। একই সঙ্গে সেই পুজোর সংকল্প হয় মা সারদার নামে। অর্থাৎ, সেইদিন স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে ইতিহাস জন্ম নিয়েছিল নবগোপালবাবুর বাড়িতে। সেই ইতিহাস আজও বহন করে চলেছেন উত্তরাধিকারীরা। আজও এখানে সব পুজো মা সারদার নামে সংকল্প করে শুরু করা হয়।

অর্থাৎ, একই ঘরে তৈরি হয়েছিল একাধিক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। পুজোর পর নবগোপালবাবুর স্ত্রী হাতে রান্না খেয়েও ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন সপার্ষদ স্বামীজি। গুরুভাইয়ের স্ত্রীর রান্না খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভোজনরসিক বিবেকানন্দ। খাবার খেয়ে তৃপ্ত স্বামীজি নিস্তারিণী দেবীর হাতে ক্ষেত্রির মহারাজের দেওয়া যে পাগড়ি তুলে দেন, তা আজও তাঁরা আদর-যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। নবগোপাল ভবনে সংরক্ষিত রয়েছে স্বামীজির পাগড়ি। বিশেষ দিন এই পাগড়ি দেখার সুযোগ পান স্বামীজির ভক্তরা।

স্বামীজির মাংসপ্রীতির কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। নবগোপালবাবুর বাড়িতে তার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। মাংসের নানা পদ ছিল তাঁর প্রিয়। মুরগির মাংস খেতে তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন। সেসময় মুরগির মাংস গৃহস্থ ঘরে ঢোকা ঘোর অনাচার বলে মনে করা হতো। স্বামীজি ছিলেন এই সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে। স্বামীজির মুরগির মাংসের প্রীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। স্বামীজি নানা হোটেলে গিয়ে যথেচ্ছ পরিমাণে মাংস ভক্ষণ করতেন। এক সময় শ্রীরামকৃষ্ণের এক শিষ্য স্বামীজির নামে তাঁর কাছে অভিযোগ জানান। ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, "খেয়েছে তো কী হয়েছে, তুই যদি রোজ হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি রোজ হোটেলে মাংস খায়, তাহলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।"

শোনা যায়, তিনি কালীঘাটের মায়ের মন্দিরের পাঁঠাবলির মাংস অনেক সময় বেলুড় মঠে এনে রান্না করে খেতেন এবং গুরুভাইদের খাওয়াতেন। বিবেকানন্দর মাংসপ্রীতি সম্পর্কে স্বামী অভেদানন্দ লিখেছিলেন,

সে দিন নরেন বলিল, আজ তোদের কুসংস্কার ভাঙিয়া দিই...। সন্ধ্যার সময় কাশীপুরের বাগান হইতে আমরা নরেনের সঙ্গে বিডন স্ট্রিটে, বর্তমানে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার, তাহার নিকটে পীরুর দোকানে উপস্থিত হইলাম। নরেন ফাউলকারি অর্ডার দিল। রাত্রে কাশীপুরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, কোথায় গিয়েছিলি? আমি বলিলাম কলকাতায় বিডন স্ট্রিটে। জানতে চাইলেন কী খেলি? আমি বলিলাম মুরগির ডালনা। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, বেশ করেছিস।

খাদ্যপ্রিয় স্বামীজির পছন্দের তালিকায় ছিল কই মাছের ঝাল। চায়ের নেশাও ছিল তাঁর। আমিষ খাবার তিনি এতটাই পছন্দ করতেন যে, মঠ-মিশনে থাকার সময়ও তিনি আমিষ খেতেন। মৃত্যুর দিনেও তিনি দুপুরে পেটপুরে ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল খেয়েছিলেন। একবার নাকি তিনি রসগোল্লার লোভে সিমলা থেকে পায়ে হেঁটে দক্ষিণেশ্বর এসেছিলেন।

হিন্দু ধর্মে মুরগির মাংস গৃহস্থে ঢোকা যখন অনাচার, তখন তা খেয়ে ও খাইয়ে কুসংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, সমাজে বইয়ে দিয়েছেন মুক্তচিন্তার স্রোত, তাই তো তিনি যুগোত্তীর্ণ যুগপুরুষ।

More Articles