লতার গান সেদিন জওহরলাল নেহরুর চোখে জল এনেছিল

তখনও শুক্ল পঞ্চমীর চাঁদ আকাশে ঝলমল করছে। অনেক ঝড়জঞ্ঝা কাটিয়ে সরস্বতী পূজা বেশ ভালোয় ভালোয় মিটেছে, রাত পোহালেই দেবীর ভাসান। কিন্তু কে জানত, রাত পোহালেই ভারতীয় সঙ্গীত জগতের সরস্বতীরও ভাসান হবে! গত রবিবার সকালে এক বেসরকারি হাসপাতালে, দীর্ঘ ২৭ দিনের লড়াইয়ে অবশেষে বিরাম চিহ্ন টেনে চিরঘুমের দেশে চলে যান সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। প্রায় অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ভারতীয় সঙ্গীত জগতকে উপহার দিয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার গান। ভারতের প্রায় প্রতিটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই তাঁর সংস্পর্শে বিশেষ সম্মৃদ্ধি লাভ করেছে। ৯২ বছর বয়সে প্রথমে কোভিড এবং পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, এই জগতের মায়া কাটিয়ে তিনি পাড়ি দিলেন হয়তো কোনো এক অজানা সুরের দুনিয়ায় আর পৃথিবীবাসীদের জন্য রেখে গেলেন তাঁর অনবদ্য, অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টিগুলি। ১০০ কোটির কানে বাজছে অ্যায় মেরে ওয়াতান কে লোগো’ গানটি।

লতার গাওয়া এই বিখ্যাত গানটির সঙ্গে প্রায় সবাই কম-বেশি পরিচিত। কিন্তু আপনারা হয়তো জানলে অবাক হবেন,  প্রথমে তিনি এই গানটি গাইতে একেবারেই নাকচ করে দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে ঘটে যাওয়া ভারত বনাম চিনের যুদ্ধে যে সকল ভারতীয় বীরযোদ্ধারা নিজেদের দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই সকল সৈন্যদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই গানটি লিখেছিলেন কবি প্রদীপজী। মূলত ১৯৬৩ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে, নিহত সৈন্যদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর উদ্দেশ্যে গানটি লেখা হয়েছিল। লতার কাছে যখন গানটি গাইবার আবেদন নিয়ে প্রদীপ এসেছিলেন, তিনি সময়ের অভাবে তা গাইতে পারবেন না বলেই জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, প্রজাতন্ত্র দিবসে অসংখ্য গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সামনে গানটি পরিবেশন করার জন্য, যে পরিমাণ চর্চা গানটিকে নিয়ে করতে হতো, সেই সময় তখন তাঁর ছিল না। কিন্তু প্রদীপ নিজের জায়গায় অনড় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি লতা গানটি না গান, তবে তিনি গানটিকে অনুষ্ঠানের তালিকা থেকেই বাতিল করে দেবেন।

এই সময় লতা তাঁর বোন আশার নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু কোনো ইতিবাচক ফল তাতে হয় না। অবশেষে তিনি গানটি গাইবার জন্য রাজি হন একটি শর্তে যে শ্রীমতি আশা ভোঁসলেকেও গানটি তাঁর সাথে গাইবার অনুমতি দিতে হবে কারণ আশার আগে থেকেই গানটি অভ্যাস  করা ছিল। তাই সই! চলল ‘অ্যা মেরে ওয়াতান কে লোগো’র রিহার্সাল। কিন্তু ওই একদিনই। দিল্লি যাওয়ার কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই আশা ভোঁসলে বেঁকে বসেন। তিনি লতাকে এসে জানায়, দিল্লি তিনি যাবেন না। অনেক বোঝানোর পরেও তাঁকে অবশেষে রাজি করানো সম্ভবপর হয়ে উঠল না। অগত্যা লতা একাই রওনা হলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে আর সঙ্গী হলেন তাঁর সবচেয়ে কাছের বান্ধবী নলিনী মাহাত্রে।

আরও পড়ুন-অভিমানে আজীবন বিয়েই করলেন না, লতার প্রেমকাহিনি আজও চোখে জল আনবে

গানটি কয়েকবার অভ্যাস করানোর জন্য সুরকার সি.রামচন্দ্র মহাশয়ের দিল্লিতে কিছুদিন থাকার কথা ছিল কিন্তু কোনো কারণে তা পরে সম্ভব হয়নি। তিনি লতাকে গানটির একটি রেকর্ডিং ক্যাসেট দিয়েছিলে। মুম্বাই থেকে দিল্লি আসার পথে প্লেনের মধ্যে তিনি অনেকবার রেকর্ডিংটি শুনেছিলেন মাত্র। ব্যাস এইটুকুই ছিল রিহার্সাল। কিন্তু  এতকিছুর পরেও বিপদ যেন পিছু ছাড়েনি লতার। দিল্লিতে নেমেই চূড়ান্ত পেটে ব্যাথা শুরু হয় তাঁর। অবশেষে সেই শরীর নিয়েই ২৭ জানুয়ারি তিনি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান। সেইদিন তিনি মোট দু'টি গান পরিবেশন করেছিলেন যার মধ্যে দ্বিতীয় গানটি ছিল বিখ্যাত ‘মেরে ওয়াতান কে লোগো’।

খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি যখন এক কাপ কফি নিয়ে মঞ্চের পিছনে গিয়েছেন, তখনই হঠাৎ করে মেহবুব খান তাঁকে ডেকে বলেন, ‘Chalo, Panditji ( Jawaharlal Neheru) ne bulaya hai.’  এই কথা কানে আসতেই সেই মূহুর্তে তাঁর রক্ত হিম হয়ে গেছিল বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির হন, তখন সেখানে উপস্থিত সকলেই গানটির জন্য তাঁকে অনেক শুভেচ্ছা জানায় এবং স্বয়ং জওহরলাল নেহরু লতাকে বলেন, “Bahut achcha. Meri aankhon mein paani aa gaya,”  যদিও এই বার্তালাপ এখানে থেমে থাকেনি। এরপরে পাণ্ডিতজি তাঁদের সকলকে নিজের বাসভবনে আমন্ত্রণ জানায় এবং সেখানেও লতাজিকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘lata kahan hai?’  এমনকী তিনি লতাকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন, মুম্বই ফিরে তিনি গানটি রেকর্ডিং করবেন কিনা? এরপর তিনি নিজের থেকেই লতার সঙ্গে একটি ছবিও তুলেছিলেন। এই ঘটনাগুলি থেকেই স্পষ্টই বোঝা যায়, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মনে একদিনের সেই গান কতখানি জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

এর ঠিক পরেরদিনই তিনি যখন মুম্বাইয়ের মাটিতে পা রাখেন, তখন ন্যাশনাল টেলিভিশনের দৌলতে গানটি রীতিমত ভাইরাল গেছে, ইতিমধ্যেই গানটি শুনে প্রধানমন্ত্রীর অশ্রুসজল চোখও মানুষের নজরে এসেছে। গানটি যে এতো তাড়াতাড়ি, বৃহৎ আকারে মানুষের মনে জায়গা করে নেবে, একথা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। তবে প্রদীপজী তাঁকে আগেই বলেছিলেন, “Lata tum dekhna yeh gaana bahot chalega. Log hamesha ke liye issey yaad rekhenge.”  এরপরের ঘটনা হয়তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৬৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গানটি একইভাবে জনপ্রিয় এবং লতাজির গাওয়া বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে একটি গান হিসাবে বিবেচিত।

তথ্যসূত্র

১. www.hindustantimes.com
২. www.moneycontrol.com
৩. www.nationalheralindia.com

More Articles