CID-র হাতে শাহজাহান-মামলার ভার , কোন পথে এগোবে সন্দেশখালি-তদন্ত?

Sheikh Shahjahan Arrest: গ্রেফতার হতে না হতেই সমস্ত দলীয় পদ খুইয়েছেন সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান। সূত্রের খবর, তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব ৬ বছরের জন্য শাহজাহানকে সাসপেন্ড করেছে।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মিনাখাঁ থেকে তাঁকে তুলে আনা হয়। সেখান থেকে সোজা তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মিনাখাঁ থানায়, সেখান থেকে বসিরহাট আদালতে। বসিরহাট আদালতে জবানবন্দি জমা করার পর সেখান থেকে গ্রিন করিডোর বানিয়ে শেখ শাহজাহানকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার ভবানী ভবনে। বসিরহাট আদালত শাহজাহানকে দশ দিন পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। সেই সময়টা ভবানীভবনেই থাকতে চলেছে সন্দেশখালির ত্রাস শেখ শাহজাহান। ইতিমধ্যেই শেখ শাহজাহানের মামলা সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তারাই এই মামলার তদন্ত করতে চলেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে। ভবানী ভবনে আপাতত রাজ্য পুলিশের জেরার মুখে পড়তে চলেছে শেখ শাহজাহান।

গত এক মাস ধরে সন্দেশখালি ইস্যুতে তোলপাড় রাজ্যরাজনীতি। দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেশখালিতে স্বৈরাচারী কাজকর্ম চালানোর অভিযোগ ছিল স্থানীয় তৃণমূলনেতা শেখ শাহজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে। জমি জবরদখল থেকে শুরু করে নারীদের অত্যাচার-শারীরিক নিগ্রহ, কী ছিল না তালিকায়! শেষপর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে রুখে দাঁড়ায় মানুষ। বাসিন্দারা নেমে আসেন রাস্তায়, ফুঁসে ওঠে সন্দেশখালি। অনেকেই সন্দেশখালির আন্দোলনের সঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের তুলনা করেছিলেন। তবে সন্দেশখালির বাসিন্দাদের একটাই দাবি ছিল মূলত। যে কোনও ভাবেই গ্রেফতার হোক শাহজাহান। এরই মধ্যে শাহজাহানের দুই সঙ্গী শিবু ও উত্তম গ্রেফতার হলেও, এতদিন হদিস মেলেনি শাহজাহানের। জানুয়ারি মাস থেকেই নিখোঁজ ছিল তৃণমূল নেতা।

আরও পড়ুন: কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী কী জানালেন সন্দেশখালির ‘ত্রাস’ শেখ শাহজাহান?

শেষপর্যন্ত বৃহস্পতিবার মিনাখাঁর একটি ভেড়ি থেকে শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানায় পুলিশ। খুব শিগগিরই যে পুলিশের জালে ধরা পড়তে চলেছে শাহজাহান, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল গত কয়েকদিনে তৃণমূল নেতাদের কথাবার্তা থেকেই। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শাহজাহানের গ্রেফতারির বিষয়ে আলোচনার জন্য বুধবার রাতে সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তারা একটি বৈঠক করেছিলেন। সেখানেই গ্রেফতারি এবং তৎপরবর্তী কার্যপ্রণালী স্থির করা হয়। তার পর রাতে শাহজাহানকে ধরে পুলিশ। রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার মিনাখাঁ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, শাহজাহানের বিরুদ্ধে ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯-সহ একাধিক ধারায় মামলা করা হয়েছে। তার ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু শাহজাহান কোথায় লুকিয়ে ছিলেন, তা তদন্তের স্বার্থে গোপন রেখেছেন এডিজি।

এদিকে গ্রেফতার হতে না হতেই সমস্ত দলীয় পদ খুইয়েছেন সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান। সূত্রের খবর, তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব ৬ বছরের জন্য শাহজাহানকে সাসপেন্ড করেছে। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠক করে সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। ভোটের ঠিক আগে আগে সন্দেশখালি যেন ক্রমশ কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তৃণমূলের কাছে। বিরোধীরাও সেই সুযোগটা ব্যবহার করেছে ভালো মতোই। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিত্যদিন তোপ দেগেছে শাসকদলকে সন্দেশখালি প্রসঙ্গে। আর শেখ শাহজাহান গ্রেফতার হতেই বিজেপিকে এক হাত নিতে ভুললেন না তৃণমূলমন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তিনি জানান, ‘‘দলের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তৃণমূল যে পদক্ষেপ করে, এটাই তার প্রমাণ। যদিও তৃণমূলের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। তৃণমূল আগেও এ কাজ করেছে। কিন্তু বিজেপি তো আর তৃণমূল নয়! আমরা প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করছি, শুভেন্দু অধিকারী, হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা নারায়ণ রাণেকে সাসপেন্ড করে দেখান উনি! মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী, ব্রিজভূষণ বা অজয় মিশ্র টেনির ব্যাপারে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে?"

 

সন্দেশখালির বাসিন্দাদের একাংশ থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেতারা গোড়া থেকেই অভিযোগ করে এসেছেন, তৃণমূলের ছত্রছায়াতেই রয়েছে শেখ শাহজাহান। সে কারণেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না সন্দেশখালির এই তৃণমূল নেতার। তবে বৃহস্পতিবার শেখ শাহজাহান গ্রেফতার হওয়ার পরে যেন একটু হলেও স্বস্তিতে তৃণমূল। কান টানলে যে মাথা আসে, সে কথাও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবারই। এদিনই সন্দেশখালির অন্যতম অভিযুক্ত ও শাহজাহান-ঘনিষ্ঠ আমির গাজিকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার রাতেই ওড়িশার রৌরকেল্লা থেকে আমিরকে গ্রেফতার করা হয়। সন্দেশখালিরই বাসিন্দা আমির এই ঘটনায় ধৃত আর এক নেতা উত্তম সর্দারের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধেও অত্যাচার, জবরদখল, মারধর, হুমকি দেওয়া এবং ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। শাহাজাহানের পাশাপাশি তাঁকেও বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। আমিরকে পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শাহাজাহানের পাশাপাশি আমিরকেও অনেক দিন ধরেই খুঁজছিল পুলিশ। বুধবার রাতে তাঁর মোবাইল ফোনের লোকেশন দেখে পুলিশ জানতে পারে, আমির ভিন্‌রাজ্যে রয়েছেন। রাতেই বসিরহাট থানা থেকে এক দল পুলিশ রৌরকেল্লা পৌঁছয়। সেখান থেকে আমিরকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে, রাজ্যপুলিশের হাতে শাহজাহান থাকার ব্যাপারটিকে মোটেও ভালো চোখে দেখেনি ইডি। রেশন দুর্নীতি মামলায় অনেক দিন ধরেই শেখ শাহজাহানকে খুঁজছে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টকরেট। গত ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালিতে শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়েই বাধার মুখে পড়ে ইডি। হামলা চালানো হয় ইডি-র আধিকারিকদের উপরেও। এদিন আদালতে সেই হামলার কথা স্বীকারও করে নিয়েছে শেখ শাহজাহান। ইডি-র দাবি, রাজ্যপুলিশের কাছে শেখ শাহজাহান থাকলে, অনেক নথিই নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। আর সেই আশঙ্কা করেই কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারি সংস্থা।

বৃহস্পতিবার কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইডির আইনজীবী ধীরাজ ত্রিবেদীর মন্তব্য, রাজ্য পুলিশ শাহজাহানকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন ধৃত। এর ফলে ইডি যে মামলার তদন্ত করছে, তার অনেক তথ্যপ্রমাণ ‘নষ্ট’ করে দেওয়া হতে পারে। এখনও আদালতে ঝুলে রয়েছে শেখ শাহজাহান সংক্রান্ত অন্য একটি মামলায়। ইডি-র উপর হামলার বিরুদ্ধে তিনটি এফআইআর দায়ের হয়েছিল। যা নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিস ইডি। হাই কোর্টের বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের বেঞ্চ ইডি আধিকারিকদের উপর আক্রমণের ঘটনায় সিবিআই এবং রাজ্য পুলিশকে যৌথ ভাবে সিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল। যাকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় ইডি এবং রাজ্য পুলিশ। সেখানে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সিট গঠনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সেই মামলার শুনানি হওয়ার কথা আগামী ৬ মার্চ।

আরও পড়ুন:শাহজাহানকে হারিয়ে জিতে গেল তৃণমূল? লোকসভায় আসন বাড়বে শাসকের?

আপাতত সিট গঠন করে দ্রুত শুনানি করা হোক ওই মামলার। প্রয়োজনে শুক্রবারই হোক শুনানি। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ অবশ্য ইডিকে বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। বসিরহাট আদালত থেকে প্রবল সতর্কতায় কলকাতায় ভবানী ভবনে নিয়ে আসা হয়েছে। গোড়া থেকেই শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে আসছে রাজ্যপুলিশ। এদিন আদালতে শাহজাহানের ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজত চেয়েছিল পুলিশ। যদিও আদালত শাহজাহানকে ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেয়। বৃহস্পতিবার পুলিশ আদালতে জমা দেওয়া নথিতে শাহজাহানকে ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ বলে উল্লেখ করেছে। তাঁকে জামিন দিলে সন্দেশখালি এবং ন্যাজাট থানা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেও মনে করছে পুলিশ। নথিতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। এবার সেই মামলার তদন্তভার গেল সিআইডি-র হাতে। এদিকে শাহজাহানকে নিজেদের হেফাজতে মুখিয়ে ইডি-ও। আপাতত কাদের হাতে খোলে সন্দেশখালি ও শেখ শাহজাহান কাণ্ডের জট, সেটাই দেখার।

More Articles