কোন কোন আসনে বিজেপিকে দুরমুশ করছে তৃণমূল?
Lok Sabha Election Results 2024: সারা রাজ্যের হিসেব বলছে, দুপুর পর্যন্ত তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে প্রায় ৩১টি আসনে। বিজেপির ঝুলিতে দশটি আসন। আর বাম-কংগ্রেস এখনও খাতাই খুলতে পারেনি এ রাজ্যে।
সাত দফা ভোট শেষ। এখন সময় ফলপ্রকাশের। গোটা দেশের অধিকাংশ বুথ ফেরত সমীক্ষাই অঙ্ক কষে বলেছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে বিজেপি। এমনকী বাংলাতেও শাসক দলকে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে এক নম্বরে উঠে আসতে চলেছে বিজেপি। দেশে কী হবে, বলা কঠিন। তবে বাংলার রাজনীতিতে যে তেমন কিছু হচ্ছে না, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে মঙ্গলবার গণনা শুরু হতেই। কার্যত এ রাজ্যে বিজেপিকে বহু পিছনে ফেলে ইতিমধ্যেই সামনের সারিতে উঠে এসেছে তৃণমূল।
একাধিক দুর্নীতি মামলা, একের পর এক নেতা-মন্ত্রী জেলে, তা সত্ত্বেও যে বাংলার মানুষ তৃণমূলকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। সারা রাজ্যের হিসেব বলছে, দুপুর পর্যন্ত তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে প্রায় ৩১টি আসনে। বিজেপির ঝুলিতে দশটি আসন। আর বাম-কংগ্রেস এখনও খাতাই খুলতে পারেনি এ রাজ্যে। তৃণমূলের একের পর এক জনদরদি প্রকল্প যে ভালোই প্রভাব ফেলেছে জনমানসে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এ বার সবচেয়ে ভালো ফল হতে চলেছে বাংলার। সত্যিই কি তেমন আশাপ্রদ কিছু হতে চলেছে বাংলায় বিজেপির জন্য? তেমনটা কিন্তু ঠাহর হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: অপ্রতিরোধ্য মহুয়া! কৃষ্ণনগরে যে ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাম ও বিজেপির কৌশল
এ রাজ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবধান বোধহয় তৈরি করেছেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবারের মতোই ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বিপরীতে বামেরা প্রার্থী করেছিল তরুণ নেতা প্রতীক-উর রহমানকে। শেষ মুহূর্তে গিয়ে বিজেপি প্রার্থী করে আরএসএস ঘনিষ্ঠ নেতা অভিজিৎ দাসকে। মঙ্গলবার ভোটগণনা শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, প্রায় ৬ লক্ষ ২৬ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন অভিষেক। যে ব্যবঘান তিনি তৈরি করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে, তাকে আদৌ টেক্কা দিতে পারবেন বাকি প্রার্থীরা। সংশয় জাগে বৈকি।
এই লোকসভা ভোটে সবচেয়ে হাইভোল্টেজ কেন্দ্র ছিল বোধহয় বসিরহাট। আর তার কারণ সন্দেশখালি। লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালি ইস্যুকে হাতিয়ার করেই তৃণমূলকে কুপোকাত করতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু শেষমেশ মুখ থুবড়ে পড়ে সমস্ত হিসেব। সন্দেশখালির প্রতিবাদী মুখ রেখা পাত্রকে প্রার্থী করে ভোটময়দানে ফায়দা তুলতে চেয়েছিল বিজেপি। বামেরা প্রার্থী করেছিল সন্দেশখালিতে প্রতিবাদী চরিত্র নিরাপদ সর্দারকে। আর তৃণমূল আস্থা রেখেছে সেখানকার পুরনো তৃণমূল নেতা হাজী নুরুল ইসলামেই। ভোটের আগেই হাসনাবাদে বেরিয়েছিল তৃণমূলের বিজয়মিছিল। কার্যত সত্যি হল সেটাই। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬১৯ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন হাজী নুরুল। শেখ শাহজাহান মামলা সত্ত্বেও যে তৃণমূলের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে আস্থা রেখেছে সন্দেশখালি, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এদিকে কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্রে প্রত্যাশামাফিক এগিয়ে রয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মালা রায়। তাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ছিলেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী এবং বামপ্রার্থী সায়রা শাহ হালিম। এই তিন নারীর লড়াইয়ে সকলকে প্রায় ১ লক্ষ ২৭ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন মালা। কলকাতা দক্ষিণ কখনও খালি হাতে ফেরায়নি তৃণমূল সুপ্রিমোকে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সাংসদ পদ থেকে মমতা পদত্যাগ করলেও কলকাতা দক্ষিণ তৃণমূলের দখলেই রয়েছে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভাতেই জয়ী হয় ঘাসফুল শিবির। এবারও সেই পরম্পরাই অক্ষুন্ন থাকবে কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্রে, তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
মেদিনীপুরে বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পলকে পিছনে ফেলে ব্যাপক ভোটে এগিয়ে রয়েছেন তৃণমূল নেত্রী জুন মালিয়া। প্রায় ৩৪ হাজার ভোটে এগিয়ে তিনি। ঘাটালেও প্রত্যাশামাফিক ভালো ফল তৃণমূলের। বিজেপির হিরণকে প্রায় ৩৮ হাজার ভোটে পিছনে ফেলে দিয়েছেন দেব। কৃষ্ণনগরে বিজেপি ও বামেদের পিছনে ফেলে প্রায় ৬৫ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন মহুয়া মৈত্র। যাদবপুর কেন্দ্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও শেষপর্যন্ত উঠে আসতে পারলেন না বামনেতা সৃজন ভট্টাচার্য। মানুষের ভোট গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী সায়নী ঘোষের পক্ষেই। প্রায় ১ লক্ষ ১৯ হাজার ভোটে এগিয়ে তিনি।
এবার খড়্গপুরের বদলে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছিল বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। তবে সেখানে তেমনভাবে দাঁত ফোটাতে পারলেন না বিজেপি নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল দাঁড় করিয়েছিল প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদকে। যিনি কিনা আগে বিজেপির হয়ে ভোটে জিতেছেন। যতদূর জানা গিয়েছে, সেই কীর্তি ৫৮ হাজারেরও বেশি ভোটে পিছনে ফেলে দিয়েছেন বিজেপির এই প্রবীণ নেতাকে। বর্ধমানের প্রাক্তন কলেজ অধ্যক্ষ সুকৃতি ঘোষালকে সেখানে প্রার্থী করেছিল বামেরা। তবে সেখানে তিনি তেমন সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে করছে না ওয়াকিবহাল মহল।
সংখ্যালঘুদের গড় হিসেবেই পরিচিত বাংলার মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রটি। সেই সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখেই ওই কেন্দ্রে প্রার্থী বেছেছিল বাম ও তৃণমূল। বাম প্রার্থী করেছিল সিপিআইএমের প্রবীণ নেতা ও সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে। তৃণমূলের তাস ছিল সিনিয়র নেতা আবু তাহের খান। টানা চারবার নওদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি। বিজেপি দাঁড় করিয়েছিল গৌরীশঙ্কর ঘোষকে। গণনাপর্বে দেখা হয়েছে বামনেতা সেলিমের সঙ্গে তৃণমূল নেতা আবু তাহেরের। কুশল বিনিময়ও করেছেন দুজনে। একসঙ্গে বসে ছবিও তুলতে দেখা যায় তাঁদের। সকাল থেকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও বেলা বাড়তেই দেখা যায়, প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী কার্তি আজাদ। এদিকে বহরমপুরের ২৫ বছরের সাংসদ তথা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীকও পিছনে ফেলে দিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান।
আরও পড়ুন:হায় রে উচ্চাশা! প্রশান্ত কিশোর যা বলেছিলেন, আর বাংলার গণনায় যা হচ্ছে
সব মিলিয়ে এই লোকসভা ভোটে বাংলায় যে তৃণমূলের লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো জনদরদী প্রকল্পগুলি ম্যাজিকের মতোই কাজ করেছে, তা বললেও বোধহয় ভুল হবে না। এই লোকসভা ভোটের প্রচারে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় বারংবার জোর দিয়েছেন কেন্দ্রীয় বঞ্চনার উপরে। একশো দিনের কাজ-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলার বঞ্চনাই কি আদতে শাপে বর হল তৃণমূলের। যে হিন্দুত্বের মশাল গোটা দেশ জুড়ে জ্বালতে চেয়েছিল মোদিবাহিনী, তা কি বাংলায় পৌঁছতে পৌঁছতে নিভে গেল আসলে? মানুষের রায় যে আসলে তৃণমূলের পক্ষেই, তা ভোটবাক্সে ভালোমতোই বুঝিয়ে দিল বঙ্গবাসী। অন্তত দুপুর পর্যন্ত ভোটগণনার অঙ্ক তো সেদিকেই দিকনির্দেশ করছে।