পাপ্পু আসলে কেন্দ্রীয় সরকার, যে ভাবে অঙ্ক কষে প্রমাণ করলেন মহুয়া মৈত্র

Mahua Moitra slams BJP government : বাজেট পেশের আট মাস পরই অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হয়। কেন অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন? প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ।

“ডোন্ট টেক পাঙ্গা”। ডিসেম্বরের শীতের মধ্য গগনে ভারতের রাজনীতি এই একটি বাক্যেই গরম হয়ে উঠল। দিল্লির শীতের মধ্যেও উত্তপ্ত হল সংসদ ভবন। সৌজন্যে মহুয়া মৈত্র। এই মুহূর্তে সংসদ ভবনে চলছে শীতকালীন অধিবেশন। সেখানেই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি, দেশের অর্থনীতি নিয়ে টোপ দাগেন কৃষ্ণনগর লোকসভার তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ। তাঁর উপলক্ষ্য ছিলেন কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। নিজের পার্লামেন্ট বক্তৃতার সময়ই তিনি ‘পাঙ্গা’ না নেওয়ার কথা বলেন। কেন?

ঘটনার সূত্রপাত ১৩ ডিসেম্বর। শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঘোষণা করে, এই মুহূর্তে বাজেটের নির্ধারিত হিসেব বেশ খানিকটা কম রয়েছে। এই ‘বেশ খানিকটা’-র হিসেব কতটা? মোদি সরকার বলছে, এখন বাজেটের বাইরেও সরকারের অতিরিক্ত ৩.২৬ লক্ষ কোটি টাকার প্রয়োজন। ঠিক এই তথ্যটি তুলে ধরেই পার্লামেন্টে আক্রমণ শানান সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এর আগেও সংসদে তাঁর ভাষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। তত্ত্ব, তথ্য এবং শব্দের শ্লেষ – সব মিলিয়ে মহুয়ার বক্তব্য যে উপভোগ্য হয়ে ওঠে তা এক কথায় স্বীকার করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

এবারও তাঁর বক্তব্যে সেই শ্লেষই ফুটে উঠল। মূল লক্ষ্য ভারতের অর্থনীতি এবং সেটা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি। মহুয়ার বক্তব্য, প্রতি বছর বাজেট পেশের সময় আশ্চর্য সব স্বপ্ন দেখায় কেন্দ্রীয় সরকার। বিশ্বের সবথেকে বড়ো অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। খুব ভালো কথা, স্বপ্ন দেখানো খারাপ নয়। কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ কীরকম হচ্ছে, সেটা আআসল কথা। মহুয়া বলছেন, প্রতি বছর বাজেট পেশের আট মাস পরই অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হয়। কেন অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন? প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ।

সেইসঙ্গে তাঁর আরেকটা বক্তব্যও এই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ার অন্দরে ঘুরছে। ২০১৪ সাল থেকে বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের একটি অংশ হল ‘পাপ্পু’। রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করার জন্য বারবার এই শব্দটির ব্যবহার করেছে বিজেপি নেতৃত্ব। সেই নেতাদের মতে, পাপ্পু মানে যার সেভাবে কিছুই করার নেই, অযোগ্য। এদিকে অমিত শাহকেও ‘পাপ্পু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন আরেক তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পাপ্পু’ লেখা জামাও ভাইরাল হয়েছিল। এবার সংসদে ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা বোঝাতে সেই ‘পাপ্পু’ই আশ্রয় মহুয়া মৈত্রের। তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দল (বিজেপি) বারবার ‘পাপ্পু’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কাউকে হেয় করতে, কেউ অযোগ্য প্রমাণ করতে এই শব্দটি বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে যাবতীয় তথ্য, পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে – আসল পাপ্পু কে?”

এই বক্তব্যের ভিত্তিতে মহুয়া মৈত্র বেশ কিছু পরিসংখ্যান সামনে রেখেছেন। উল্লেখযোগ্য হল, সমস্ত পরিসংখ্যানই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিমাপক। এক এক করে সেই দিকেই আসা যাক। কী বলেছেন মহুয়া? তিনি যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, সমস্তটাই সরকারি তথ্য। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের তথ্য বলছে, অক্টোবরে ভারতে শিল্পে উৎপাদনের পরিমাণ আগের তুলনায় ৪ শতাংশ কমেছে। হিসেব করলে দেখা যাবে, গত ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ করোনার বীভৎসতা, লকডাউনের জেরে কারখানা বন্ধ, কোনওটাই এখন নেই। পাশাপাশি ম্যানুফেকচারিং সেক্টর বা কারখানায় উৎপাদন ক্ষেত্র কমেছে ৫.৬ শতাংশ। খেয়াল রাখতে হবে, শিল্পের মানচিত্রে উৎপাদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সেজন্য ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রিরও প্রয়োজন আছে। এই জায়গাটি বাড়লে বাকি শিল্পও বাড়বে। ম্যানুফেকচারিংয়ের হাত ধরেই বাকি ছোটখাট শিল্পগুলি আসে। কর্মসংস্থানও বাড়ে। সেই সেক্টরে মন্দা এলে সামগ্রিক ভাবেই অবস্থা খারাপ হবে। কমবে কর্মসংস্থানও।

এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। মহুয়া মৈত্র বলেছেন, অন্তত ১৭টি শিল্পক্ষেত্রের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উৎপাদন ‘নেগেটিভ গ্রোথ রেট’-এ। মানে, সেই উৎপাদন বাড়ছে না। এক বছরে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার কমেছে ৭২০০ কোটি ডলার। সম্প্রতি সংসদে দাঁড়িয়েই বিদেশ মন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রায় দু’লাখ ভারতীয় নিজেদের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। ২০১৪-২০২২ গত আট বছরের হিসেবে সেই সংখ্যাটা সাড়ে ১২ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। যাঁদের টাকা আছে, তাঁরা পর্তুগাল, গ্রিসের মতো দেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছেন। কেন? যে কোনও সুস্থ, অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক দেশের ছবি কি এটা? প্রশ্ন তুলেছেন মহুয়া।

শুধু তাই নয়, অর্থনীতির সঙ্গে প্রচ্ছন্নে জড়িত রাজনীতির প্রসঙ্গও তুলেছেন তিনি। যারা খবরের কাগজ পড়েন, ভোট এলে সমস্ত পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন ইলেকটোরাল বন্ডের কথা। এই মুহূর্তে কোন দলের পকেটে কত টাকা ঢুকছে এই বন্ডের মাধ্যমে, কেউ জানে না। আরটিআইয়ের আওতা থেকে সরে গিয়েছে সেসব।

সেইসঙ্গে আরও একটা শব্দবন্ধ ভোটের ভারতে খুব জনপ্রিয়। ‘ঘোড়া কেনাবেচা’। আজ থেকে নয়, কয়েক দশক ধরে এই ট্র্যাডিশন চলিতেছে। তবে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের বিজেপি এই কাজে নিজেদের ‘দক্ষতা’ দেখিয়েছেন বারবার। কংগ্রেস, আপ, তৃণমূল কিংবা অন্যান্য দল থেকে নেতা, বিধায়ক, সাংসদ ভাঙিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাঁদের জুড়ি নেই। বদলে দেওয়া হচ্ছে ভালো পদ, সঙ্গে মোটা টাকা। কোথা থেকে আসছে এই টাকা? প্রশ্ন তুলেছেন মহুয়া। ঘোড়া কেনাবেচার পরও যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, তাঁরা সবাই বিরোধী।

নতুন সংসদ ভবন তৈরি, মন্দির তৈরি, মূর্তি তৈরির পেছনে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ কারখানা, শিল্প, অর্থনীতির এমন অবস্থা কেন? মহুয়া মৈত্রের প্রশ্ন যে যুক্তির বাইরে নয়, তার প্রমাণ রয়েছে তথ্যেই। বেকারত্বের বিচারে ভারত রেকর্ড করেছে, লকডাউনে দেখেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা। তাহলে কেন্দ্র কেন দিবাস্বপ্ন দেখাচ্ছে বারবার? ডলারের বিচারে ভারতীয় টাকার মূল্যের অবস্থা তথৈবচ। সেই দামে রাশ টানার জন্য চলতি অর্থবর্ষেই ৩৩৪২ কোটি মার্কিন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। অর্থনীতির সোনার পাখি কি আদৌ উড়ছে? পার্লামেন্টে মহুয়া মৈত্রের প্রশ্ন সেই কথাই তুলে ধরছে বারবার। 

More Articles