রাজ্যের ঘাড়ে ৬ লক্ষ কোটির ঋণ! বাম আমলের ঋণ কীভাবে তিলে তিলে বাড়ল এ জামানায়

দেশের ১০টি রাজ্যের আর্থিক অবস্থান চিন্তা বাড়াচ্ছে। ঋণ-ক্ষেত্রে এদের অবস্থান ভালো জায়গায় নেই। যার মধ্যে প্রথম পাঁচে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

ঋণের বোঝায় কৃষকের মৃত্যু! অকালে আত্মহত্যা করলেন কৃষক! ভারতের খবর-ইতিহাসে এই ঘটনার আধিক্য রয়েছে বারবার। কিন্তু একটি গোটা রাজ্য? একটি রাজ্যের উন্নয়ন, এগিয়ে চলার মৃত্যুর জন্যেও কি দায়ী সেই ঋণ? রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একটি টুইটকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন উঠেছে ফের।

কী লিখেছেন শুভেন্দু? টুইটারে তিনি লেখেন, “রাজ্য ঋণের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে। প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে রাজ্য। টাকা নেই। ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করেছে সরকার। সেই ফাইল অর্থমন্ত্রকে আটকে। অনুমোদন না পেলে মাইনে বন্ধ হবে! আরবিআই যেন ঋণ না দেয়।”

শুভেন্দুর এই বিস্ফোরক টুইটের পরেই ফের উঠেছে প্রশ্ন। শুরু হয়েছে বিতর্ক। সত্যিই কি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে রাজ্যের সরকার? মাইনে বন্ধ হতে চলেছে সরকারি কর্মীদের? যদিও এই প্রশ্নের আবহে পাল্টা সরব হয়েছেন তৃণমূল নেতারাও। শুভেন্দুর দাবি নস্যাৎ করেছেন তাঁরা। কিন্তু এই ঘটনার আবহে ঠিক যা যা প্রশ্ন উঠছে, তা কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের মতে মারাত্মক। কেন? কী কী প্রশ্ন তৈরি হয়েছে সর্বিকভাবে?

২ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা। ৩৪ বছরের বাম-শাসনের পতনের পর তৃণমূল সরকারের জন্য এই পরিমাণ ঋণের বোঝা উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর সেই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা এবং তার শোধের গতিপথ নিয়েও আলোচনা হয়েছিল বিস্তর। উঠেছিল প্রশ্নও। কিন্তু তারপর?

আরও পড়ুন- হু হু করে বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যা! দেশজুড়ে অন্নদাতাদের দুর্দশার দায় কার

২০২০। ৯ বছরে, তৃণমূল সরকারের হাত ধরে ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়াল ৪ লক্ষ ৭৪ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। একথা স্পষ্ট জানান রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। এমনকী এই ঋণের সঙ্গেই পরের অর্থবর্ষে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবেন বলেও জানান তিনি।

আর এখন? শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা! আবার অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজ্যের নেওয়া ঋণের বর্তমান পরিমাণ সাড়ে ৫ লক্ষ কোটি টাকার কম নয়। অর্থাৎ বামেদের দেওয়া ২ লক্ষ ৭ হাজার কোটি বেড়ে গত ১১ বছরে হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা! বেড়েছে ৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি বোঝা।

কিন্তু কেন? কী পরিস্থিতি এই ঋণ-সাম্রাজ্যের? কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের মধ্যে একাধিক আঙ্গিক রয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যকে রাজস্ব ভাগ দেওয়া থেকে শুরু করে একাধিক ক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্রের রাজস্ব-সমন্বয় রয়েছে। যা থেকে একটা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে দু’পক্ষই। অর্থাৎ মিলেমিশে চলে রাজস্ব আদায়ের ভাগ নেওয়া। যা একটি সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু ক্ষেত্র, সংবিধান অনুযায়ী যৌথ তালিকার মধ্যে থাকে না। যেখানে রাজস্ব আদায়ে এবং তার গ্রহণে শুধুমাত্র হস্তক্ষেপ থাকে কেন্দ্রের বা রাজ্যের। আর এখানেই ওঠা-নামা করে আয়। রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্যের আয়। দেশের জন্য জাতীয় আয়।

আয়-ব্যয়ে ঋণ

আর এই আয়ের তারতম্যের কারণে প্রয়োজন হয় ঋণের। যেখানে রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকার নীতি নির্ধারণ এবং রাজ্যের-কেন্দ্রের যাবতীয় কাজ চালানোর জন্য, অতিরিক্ত খরচ সামলাতে অথবা একাধিক প্রয়োজনে ঋণ নেয়।

ঋণের পথ

ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশি শক্তি বা বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বাধা না থাকলেও রাজ্যের ক্ষেত্রে রয়েছে একাধিক প্রতিবন্ধকতা। একাধিক স্থানে অনুমতির বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কোনও রাজ্য মনে করলে শুধু কেন্দ্র বা ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে নয় একাধিক বেসরকারি অর্থনৈতিক সংস্থার কাছ থেকেও ঋণ নিতে পারে। তবে এই সমস্ত বিষয়ের সম্পূর্ণকরণে একাধিক নিয়ম পালন করতে হয় রাজ্যকে।

ঋণের ঊর্ধ্বসীমা

এদেশের সংবিধান এবং আর্থিক নীতি অনুযায়ী, কোনও রাজ্য তার মোট আয় হিসেবে বার্ষিক ৩ শতাংশ পরিমাণে টাকা ঋণ নিতে পারে। এক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় বা অর্থ কমিশনের সরাসরি প্রভাব না থাকলেও রাজ্য তার মোট আয়ের ৩ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেবে। সেটা যে কোনও ক্ষেত্র থেকেই সম্ভব, নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী।

ঋণশোধ

মোট আয়ের উপর নির্ভর করে ঋণ নিলেও তার শোধের দিকে খেয়াল রাখতে হয় রাজ্যকে। এমনকী কোনও ঋণ না শোধ করে ফের একই জায়গা থেকে ঋণ নিতে গেলে কেন্দ্রের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে ঋণ নেওয়া হয়েছে কিন্তু শোধ না হওয়ার আগে ফের প্রয়োজন, এই ক্ষেত্রে ঋণের জন্য কেন্দ্রের অনুমতির প্রয়োজন হয়।

পশ্চিমবঙ্গের ঋণ-অবস্থা

বাম-আমলের ঋণের বোঝা এবং তার সুদ দিতে প্রচুর অর্থ খরচ নিয়ে অভিযোগ করতেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার সেই সরকারের মোট আয়ের একটা বড় অংশ পুরনো ঋণের সুদ দিতেই খরচ হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। এরপরে আর থাকছে না উন্নয়নের জন্য উদ্বৃত্ত অর্থ! দাবি, যেটুকু থাকছে তা কর্মীদের মাইনে এবং রাজ্যের অন্যান্য কাজের পরে খুব সামান্য। তাই ফের ঋণের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে রাজ্যকে। এর ফলেই ক্রমশ বাড়ছে ঋণের বোঝা।

সেপ্টেম্বর, ২০২২। রাজ্যগুলির ঋণ পর্যালোচনা করে দিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি (এনআইপিএফপি)-র তরফে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৮-১৯, এই ৪ বছরে ঋণের বোঝা কমানোর ক্ষেত্রে ভাল কাজ করেছে মমতার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ঋণ বাড়লেও ২০১৫-১৬ সালের চেয়ে কম ছিল সেই পরিমাণ। ১৮টি বড় রাজ্যের সাম্প্রতিক বাজেট পর্যালোচনা করে ওই রিপোর্ট প্রকাশ হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৫-১৬ সাল থেকে ৪ বছরে ৬টি রাজ্য জিডিপি-র তুলনায় ঋণের পরিমাণ কমিয়েছে। ৩৩.৮৭% থেকে ৩০.৮৮%  হয়েছে এই রাজ্যের ক্ষেত্রে।

ঋণ-আশঙ্কা

চলতি বছরের জুন মাস নাগাদ ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক একটি প্রতিবেদনে জানায়, দেশের ১০টি রাজ্যের আর্থিক অবস্থান চিন্তা বাড়াচ্ছে। ঋণ-ক্ষেত্রে এদের অবস্থান ভালো জায়গায় নেই। যার মধ্যে প্রথম পাঁচে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। যেখানে রাজ্যের জিডিপি-র তুলনায় ঋণের হার অনেক বেশি।

ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, পঞ্চদশ অর্থ কমিশন রাজ্যগুলির ঋণের যে ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছিল তা অতিক্রম করেছে এই রাজ্যগুলি। যেখানে, ২০২০-২১ সালেই পশ্চিমবঙ্গ জিডিপি হারের থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে। আবার এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবর্ষে ঋণ এবং রাজকোষ ঘাটতি, দুই-ই অর্থ কমিশনের লক্ষ্য পেরোতে পারে!

যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলির ঘাড়ে ঋণের আসল বোঝা কতখানি, তা খোলসা করতে আরও ৩ বছর সময় দেওয়ার কথাও বলা হয়। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশের অর্থমন্ত্রকের অধীনে থাকা এআইপিএফপি জানায়, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের ধার্য করে দেওয়া ঋণের সীমা ভাঙে এই রাজ্যও। ২০১৯-২০ থেকে ঋণের পরিমাণ ফের বৃদ্ধি পায় এখানে। আবার ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষের তুলনায় ওই ঋণের পরিমাণ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কমে হয় ১.৬ শতাংশ। যেখানে পঞ্জাবের মতো রাজ্যে এর হার বেড়েছে ১৫ শতাংশ। যদিও ঋণের পরিমাণ নিয়েও তারতম্য রয়েছে রাজ্য অনুযায়ী।

আরও পড়ুন- ২০১৮-র মাশুল পঞ্চায়েত ভোটে গুনতে হবে তৃণমূলকে? গেরুয়া বিপদ কতটা দোরগোড়ায়

কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?

ইনস্ক্রিপ্ট এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করেছিল অর্থনীতির কারবারিদের সঙ্গে। দীর্ঘকাল অর্থনীতি চর্চায় অভ্যস্ত এক সরকারি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক বললেন, “এই বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বললে, সরকারের নীতির, ঋণনীতির সমালোচনা করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। তবুও বলছি, বাম-আমলের দেওয়া ঋণের বোঝা শোধ করার বদলে একাধিক ভুল পদক্ষেপ এই রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। যেখানে শোধ করার চিন্তার বদলে বেড়েছে জাঁকজমক। যাতে ক্রমশ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। রাজ্যের আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়িয়ে আরও ভয়াবহ হয়েছে পরিস্থিতি।''

অর্থনীতিবিদ ধনপত আগরওয়াল ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, “রাজ্যের ঋণের বোঝা সত্যিই চিন্তার। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আর কয়েক বছরে এই অবস্থা শোচনীয় হতে পারে। বলছি না, শ্রীলঙ্কার মতো হবে। কিন্তু এই অবস্থার নিয়ন্ত্রণ না হলে বিপদ আসন্ন। এর জন্য দায়ী, শোধ করার সংগঠিত নীতির অভাব। কিছু না ভেবেই অনবরত অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া আর অপরিকল্পিত ব্যয়। বাম আমলে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ছিল। ঋণ নিতে হবেই, সকলেই নেন। কিন্তু সেটা তো নিয়ন্ত্রিত হতে হবে!”

পরিত্রাণের উপায়?

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খুব দ্রুত সংগঠিত ঋণনীতি নিতে হবে রাজ্যের তরফে। নির্দিষ্ট নিয়ম, আইন মেনেই দেখতে হবে রাজ্যের আয় এবং ব্যয়ের ভারসাম্য যেন ঠিক থাকে। ঋণ নিয়েই গেলাম, এই জিনিস করা যাবে না! ভয়াবহ ইঙ্গিত বহন করে আয়ের ৪০ শতাংশ ঋণ নিয়ে ফেললাম, এমন অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সরকার নজর না দিলে সমূহ বিপদ।

এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ধনপত আগরওয়াল বলছেন, “আইন-শৃঙ্খলা, উপযুক্ত পরিকাঠামোর উন্নয়নের সঙ্গে বিনিয়োগ আনতে হবে এই রাজ্যে। ছোট ছোট শিল্প নয়। বড় শিল্প, বড় বিনিয়োগ। রাজ্যে শান্তি বজায় রেখে আকৃষ্ট করতে হবে শিল্পের জন্য। আয় বাড়াতে হবে রাজ্যের তরফে। কর্মসংস্থান প্রয়োজন। মানুষের হাতে টাকা এলে ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। মানুষ কাজ পেলে আয় হবে, কিনবেন। নগদ আসবে। রাজ্যের আয় বাড়বে। সবমিলিয়ে পরিকল্পিতভাবে এর নিরসন করতে হবে এখন থেকেই, নইলে আরও পিছিয়ে যাবে এই রাজ্য।”

More Articles