মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হিন্দুদের জন্যে দু’টি আবেদন

Bangladeshi Hindu Minorities: আমরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চাই। যাতে হিন্দুদের ভোটে হিন্দুরা নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যেতে পারে। যাঁরা হিন্দুদের দাবি-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধার কথা পার্লামেন্টে তুলে ধরবে।

সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, বহু জায়গা থেকেই কানে আসছে বাংলাদেশে মন্দির থেকে শুরু করে বহু হিন্দু স্থাপত্য় ভাঙার খবর। হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগানো থেকে হত্যার খবরও ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু আমি বলতে চাই, আজকের দিনে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপরে ব্যাপক ভাবে হামলার কোনও সংবাদ কিন্তু আমি অন্তত পাইনি। এই যে ছাত্রদের গণআন্দোলন ক্রমশ জাতীয় আন্দোলনের রূপ নিল, তার নেপথ্যে রয়েছে আসলে হাসিনা সরকারের স্বৈরাচার। বাংলাদেশের মানুষ বহু দিন ধরেই ক্ষুব্ধ। দু-দু'টো দফায় ভোট দিতে পারেননি এদেশের জনগণ। বিনা ভোটে ক্ষমতা আটকে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। এদেশের পুলিশবাহিনী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, দেশের প্রায় সমস্ত সরকারি জায়গায় নিজের লোককে বসিয়ে স্বৈরাচার করে গিয়েছে আওয়ামী লীগ। যেটা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ মেনে নেয়নি। ভারত শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে বলে বাংলাদেশের বিশাল অঙ্কের হিন্দুও কিন্তু শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে এসেছেন। এমনকী সে সরকার স্বৈরাচারী হলেও, খারাপ কাজ করলেও সমর্থন করেছেন তাঁরা। এমনকী এই যে সরকার শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করল, তার পরেও তাঁদের সমর্থন থেকেছে শেখ হাসিনার পাশেই।

পডুয়াদের বিক্ষোভ দানা বাধার পর, তাদের রাজাকার স্লোগানের কথা চারপাশে ছড়াতেই, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তরফে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ছাত্র-জনতা— যাঁরা নিজেদেরকে রাজাকার বলেছে, তাঁদেরকে যেন কোনও সরকারি চাকরিতে সুযোগ না দেওয়া হয়। তাঁদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করে দ্রুত সাজা দেওয়ারও সুপারিশ করে তাঁরা। এই ঘটনায় বিএনপি-জামাত তো বটেই, সাধারণ মানুষও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁর একটা কারণ তো অবশ্যই তাঁরা তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে। দ্বিতীয় কারণ, তাদের এই একপেশে বক্তব্য। আর সেই ক্ষিপ্ততা আঁচ করতে পেরেই বিএনপি-জামাত নেতৃত্ব আমাদের সঙ্গে আলাপ করে এবং তাঁদের সমস্ত নেতানেত্রীকে নির্দেশ দেন, যাতে তাঁরা সারা দেশের সমস্ত হিন্দু মন্দির, মঠ এবং হিন্দু পাড়া-মহল্লাগুলিতে পাহারা দেয়। দেশের বড় বড় প্রায় সমস্ত মন্দিরে নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে তারা। তাঁদের সঙ্গে পাহারায় রয়েছেন আমাদের নেতানেত্রীরাও।

আরও পড়ুন: হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?

কিন্তু যারা আদতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা, সর্বোপরী আওয়ামী লীগের নেতা, যাঁরা বিভিন্ন সময় এই স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন করেছেন, এলাকার মধ্য়েই অন্য দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের বাড়িতেই সাম্প্রতিক কালে হামলা হয়েছে। তাঁদের কিছু দোকানপাটেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, বহু সুযোগসন্ধানীই এই সুযোগে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে। পরাজিত শক্তি যারা, তারা জয়ীদের এই অর্জনটাকে ধুলিস্যাৎ করার জন্য রাতের অন্ধকারে গ্রামাঞ্চলের মন্দিরগুলিকে ভেঙে দিয়ে আসছে। আবার তারাই সকাল হলে সেই সব ভাঙা মন্দিরের ভিডিও করে প্রশ্ন তুলছে, "এই কি আমাদের স্বাধীনতা? এই কি আমাদের অর্জন?" আমরা সব সময়ে বলেছি, প্রতিটি গ্রামে-মহল্লায় হিন্দুরা যেন প্রতিটি মন্দির পাহারা দেয়। সেই সমস্ত মন্দিরেরই এক-একটি করে কমিটি রয়েছে। কিন্তু সেই সব কমিটিগুলিতে যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন, তাঁরা এই মন্দিরগুলি পাহারা দেননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে কোনও হিন্দু আহত হয়েছে বা নিহত হয়েছে, এমন কোনও খবর নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে গিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের পরিণতি হয়েছে শোচনীয়। রংপুরের একজন হিন্দু নেতা খুন হয়েছেন সম্প্রতি, যিনি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিও ছিলেন। তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে জানা গিয়েছে। একই সঙ্গে আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিতে বহু হিন্দু ছাত্র ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।

অনেকেই মনে করেন, হাসিনার আমলে বাংলাদেশের হিন্দুরা তুলনামূলক সুরক্ষিত ছিলেন। কিন্তু এ কথা সর্বান্তকরণে ভুল। কার্যত কোনও সুরক্ষাই ছিল না আওয়ামী লীগের সময়কালে হিন্দুদের। শেখ হাসিনার সময়ই অভয়নগরে আওয়ামী দুই নেতার কোন্দলের জেরে হাজার হাজার হিন্দুকে নদী পার হয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। শত শত বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের বহু জায়গায় মহানবীর বিরুদ্ধে কটুক্তি, ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তি— এই সমস্ত অজুহাতে আওয়ামী লীগের নেতারা সক্রিয় ভাবে হিন্দু বাড়িতে হামলা চালায়। ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখনও হিন্দুদের বাড়িতে ব্যাপক ভাবে হামলা হয়। তার বিচার করেনি বিএনপি সরকারও। হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে সাহাবুদ্দিন কমিশন গড়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই কমিশনের কাছে ২৫ হাজার হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছিল। যে সব ঘটনায় আওয়ামী লীগ জড়িত, সেই সব মামলাগুলি অবলীলায় সরিয়ে ফেলা হয়। কেটেছেঁটে মামলার সংখ্যা নামিয়ে আনা হয় ৫ হাজারে। সেই সব মামলায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের নাম নিয়ে একটা গেজেট তৈরি করা হয়েছিল। দেখা যায়, সেই পাঁচ হাজার ঘটনার সঙ্গেও কোনও না কোনও ভাবে যোগ থেকে গিয়েছে আওয়ামী লীগের। ফলে সেই গেজেট যাতে কোনও মানুষের হাতে না যায়,সেই ব্যবস্থা করেছিল হাসিনা সরকার। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে ৫৫০টি মডেল মসজিদ হয়েছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু হিন্দুদের কোনও দাবিদাওয়া পূরণ করেনি হাসিনা সরকার। এমনকী দুর্গাপুজোয় তিন দিনের ছুটির জন্য সমগ্র হিন্দু সমাজ বহুদিন ধরে দাবি করে আসছে। পূরণ করা হয়নি সেই সামান্য দাবিটুকুও। এর থেকেই বোঝা যায়, ঠিক কতখানি মৌলবাদী ছিল শেখ হাসিনা সরকার। আসলে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা নেই। আর হাসিনার এই চালাকিটাই ভারত সরকার কখনও বুঝতে পারেনি।

আরও পড়ুন: এই মুহূর্তে কেমন আছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা?

হাসিনার বিদায়ের পর বাংলাদেশের দায়িত্ব বুঝে নেবে গণতান্ত্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার মুখ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে। বলাই বাহুল্য, তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। কৌটিল্য বলেছিলেন, 'সুখস্য মূলম ধর্ম, ধর্মস্য মূলম অর্থ, অর্থস্য মূলম রাজ্যম'। ফলে রাজক্ষমতার অংশীদারিত্ব ছাড়া কোনও জাতি টিকে থাকতে পারে না বলেই বিশ্বাস করি। আর সেই রাজক্ষমতায় অংশীদারিত্বের জন্য আমরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চাই। যাতে হিন্দুদের ভোটে হিন্দুরা নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যেতে পারে। যাঁরা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলবে,  যাঁরা হিন্দুদের দাবি-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধার কথা পার্লামেন্টে তুলে ধরবে। আর চাই একটা সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যেটা ভারত-পাকিস্তানের মতো প্রায় সব দেশেই রয়েছে। অথচ বহুবার চেষ্টা করেও বাংলাদেশে সেটা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আমার মনে হয়, এইটুকু যদি করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজেরাই মেরুদণ্ড সোজা করে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে। এই ভূমি আমাদের। আমরা এই ভূমি ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। ভারতেও যেতে চাই না, আমেরিকাতেও যেতে চাই না। এটা আমাদের পিতৃভূমি, মাতৃভূমি। এটা হরিঠাকুর, অনুকূল ঠাকুর, জগদ্বন্ধু, বালক ব্রহ্মচারী, রামঠাকুর পরমহংসদেবের পুণ্যভূমি। এই ভূমি ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না।

(লেখক বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাসভার মহাসচিব)

More Articles