ব্রহ্মার দেওয়া কোনও বর নয়, যে রোগের কারণে এতো ঘুমাতেন কুম্ভকর্ণ

Hypersomnia : অতিরিক্ত ঘুম? ডেকে আনতে পারে ভয়ংকর ক্ষতি! যে রোগের শিকার হচ্ছেন অজান্তেই

ঘুমপাড়ানি মাসি পিসিদের সঙ্গে ভীষণ ভাব যাদের তাদের জীবনের সুখ নিয়ে ঈর্ষা হয় ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত ঘুম যে ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ রোগ, সে খোঁজ রাখেন কজন? ঘুম বিষয়টি বড়ই উপাদেয়। পুরাণের দিকে তাকালেও নজির মেলে অদ্ভুত ঘুমকাতুরে চরিত্রের। ব্রহ্মার বরে বছরের টানা ৬ মাস ঘুমাতেন কুম্ভকর্ণ। রাক্ষসকুলের যুদ্ধও তাতে। বাধ সাধতে পারেনি কোনওদিনই। এমনই ভয়াবহ ঘুম ছিল তাঁর। শুধু পুরাণ কেন, আজও ঘুম নিয়ে মানুষের অন্যরকম আবেগ। সম্প্রতি প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে সেরা ‘ঘুমকাতুরে’ হয়েছেন বাংলার মেয়ে ত্রিপর্না চক্রবর্তী। ভাবা যায় কেবল ঘুমিয়ে নাকি জিতে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা!

একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে আমাদের মধ্যে। ঘুম নাকি সব রোগের ওষুধ। তাই ঘুমহীনতা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। অবশ্য আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এটাই দস্তুর। চোখের সামনে আলো জ্বলা মুঠোফোনখানা সর্বক্ষণ ধরে থাকলে ঘুম তো পালাই পালাই করবেই! বয়স জনিত কারণের পাশাপাশি তাই নতুন প্রজন্মের মধ্যেও আজকের গেঁড়ে বসেছে ঘুমহীনতা। গাল ভরা রোগের নাম ইনসমনিয়া। চিকিৎসকই লিখে দিচ্ছেন ঘুমের বড়ি। দোকানে দেদার বিকোচ্ছেও সেসব। কিন্তু ধরুন যদি হয় এর ঠিক বিপরীত অবস্থা, ধরুন শুধুই ঘুম পাচ্ছে। দেরিতে ঘুম ভেঙে উঠেও খানিক বেলা গড়াতে না গড়াতেই মনে হচ্ছে নিজেকেও একটু গড়িয়ে নিল মন্দ হয় না। তবে কি সেটা খুবই স্বাভাবিক? ভাবাচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্রকেও। দিনে বার কয়েক ঘুমিয়ে নেওয়ার পরেও যদি সতেজ বোধ না হয়, তাহলে এটি হতে পারে হাইপারসোমনিয়ার লক্ষণ। সুতরাং সাবধান!

আরও পড়ুন : 

ইনসমনিয়ার মতো হাইপারসমনিয়াও ঘুমঘটিত একটি ভয়ঙ্কর অসুখ৷ বর্তমানে জনসংখ্যার ৪% থেকে ৬% এই সমস্যায় ভুগছেন। এ এমনই এক অসুখ যাতে রোগী দিনেরবেলা বেশিক্ষণ জেগে থাকতে অথবা সতর্ক থাকতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন জীবনে। ব্যাধি ক্রমশঃ পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন ছড়িয়ে গ্রাস করে বসে কর্মজীবনকেও। ডাক্তারি মতে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। আরও জানা যায়, সাধারণত ১৭ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা এতে বেশি আক্রান্ত হন। সারা রাত ঘুমানোর পরেও সকালে উঠতে অসুবিধা, ঘুম থেকে ওঠার সময় বিভ্রান্তি, দৈনন্দিন জীবনের চাপ হাইপারসমনিয়ার কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

হাইপারসমনিয়ার রোগীরা যেন কলির কুম্ভকর্ণ। ব্রহ্মার বর ছাড়াই দিব্যি ঘুমিয়ে কাটান আর ডেকে আনেন শারীরিক ক্ষতি। অবশ্য রামায়ণের যুগে চিকিসা বিজ্ঞান এতোটা এগোয়নি বলেই, নচেৎ কে বলতে পারে রাক্ষস রাজা কুম্ভকর্ণের হয়তো হাইপারসোমনিয়া হয়েছিল। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই অলস বলে মনে করেন। কিন্তু যদি কেউ সময়মতো বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন তাহলে সমস্যা এড়ানো যায়। তাই প্রয়োজন জানা ডাক্তারি পরিভাষাটি।

ন্যাশনাল সেন্টার অফ বায়োটেকনলজি ইনফর্মেশন জার্নালের প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুযায়ী, এটি একটি বিরল রোগ। একশো জনের মধ্যে চার থেকে ছয় জন হাইপারসমনিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। রোগটি মূলত ঘুমকে ঘিরেই। কিন্তু কী থেকে হতে পারে এই রোগ?

অন্যান্য স্নায়বিক ব্যাধির মতো হাইপারসমনিয়ার প্রকৃত কারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তবে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, এই রোগীদের শরীরে একটি নির্দিষ্ট অণুর বেশিমাত্রায় উৎপাদন হয়, যা মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট হরমোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তন্দ্রাভাব বাড়িয়ে দেয়। চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, ন্যারকোলেপ্সি এবং স্লিপ অ্যাপনিয়া, অটোনমিক স্নায়ু তন্ত্রের অকার্যকারিতা, মাদক অথবা মদ্যপানের অপব্যবহার ইত্যাদি ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ হাইপারসমনিয়া। এছাড়াও টিউমার, কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রে অথবা মস্তিষ্কে আঘাত, ওজন বৃদ্ধি, ডিপ্রেশন, এনসেফালাইটিস, মৃগী ইত্যাদি থেকেও হতে পারে রোগটি।

আরও পড়ুন :

রোগের উপসর্গ -

১. দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম হাইপারসমনিয়া প্রধান লক্ষণ l
২. পাশাপাশি সকালে ঘুম থেকে উঠতে অসুবিধা হওয়া বা দিনেরবেলা ঝিমুনির মতো বিভ্রান্ত বোধ হয় এ রোগে
৩. যে কোনও কারণেই উদ্বেগ এবং কথায় কথায় বিরক্তি বোধ লক্ষ্য করা যায়।
৪. এই রোগীরা প্রায়ই ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে থাকেন।
৫. এছাড়াও সারাদিনের কাজে এনার্জির ঘাটতি, অস্থিরতা, মনোনিবেশের অভাব, মাথাব্যথা, হতাশা, অবসাদ ইত্যাদি কাজ করে।

রোগ নির্ণয়

এই উপরিউক্ত লক্ষণগুলি যদি প্রতিদিন দেখা যায় তাহলে দেরি না করে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যথাযথ মেডিকেশন পদ্ধতিতে আসল সমস্যা ধরা সম্ভব। শুধু তাই নয়, ঘুম সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানাতে ভুলবেন না। প্রয়োজন বুঝলে চিকিৎসকই রোগীর রক্ত পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান, মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন। এমনকী পলিসমনোগ্রাফি পরীক্ষারও নির্দেশ দিতে পারেন চিকিৎসক। এ রোগ পুষে রাখলে বিপদ আরও বাড়তে পারে তাই দেরি না করেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কাজ করা বাঞ্ছনীয়।

হাইপারসোমনিয়া রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ করা যায় অ্যান্টি ডিপ্রেশন চিকিৎসা, মেডিটেশন ইত্যাদির মাধ্যমে। প্রতি রাতে একই সময়ে ঘুমান, ঘুমানোর কয়েক ঘন্টা আগে ক্যাফেইনযুক্ত পণ্য যেমন কফি, কোলা, চা, চকলেট ইত্যাদি একেবারেই খাবেন না। ঘুমের আগে অ্যালকোহল, তামাক এবং নিকোটিনযুক্ত পণ্যও একেবারেই সেবন করা যাবে না। পাশাপাশি অতিরিক্ত মেদ কমানোর জন্যও চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসায় সাহায্য নিন। ওষুধ ও খাবার নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। একটা কথা মাথায় রাখবেন, পর্যাপ্ত ঘুম স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। কিন্তু অস্বাভাবিক ঘুম নৈব নৈব চ!

More Articles