চাঁদের মাটিতে ভারতীয় তেরঙার ছবি আঁকা দিয়ে শুরু, এবার কী করবে প্রজ্ঞান?

Chandrayaan-3 landing: চাঁদের মাটি ছুঁল ভারত, অথচ নিজেদের একটা দাগ রেখে যাবে না, তা আবার হয় নাকি। তাই চাঁদের মাটিতে সে এঁকে আসবে ভারতের একটি জাতীয় পতাকা ও ইসরোর লোগো।

যারা বলেন, ব্যর্থতাই সাফল্য়ের স্তম্ভ। খুব একটা ভুল বলেন না তাঁরা। দু-দু'বারের ব্যর্থতার পরে সাফল্য এল। আর এমন ভাবে এল, যা কার্যত গড়ে ফেলল ইতিহাস। তৃতীয় বিশ্বের দেশ পাল্লা দিল আমেরিকা, রাশিয়া বা চিনের মতো বলশালী দেশের সঙ্গে। কয়েক হাজার বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল মিলল শেষমেশ। চাঁদের মাটিতে পা রাখল ভারত।

আরও পড়ুন: রাশিয়া পারেনি, চাঁদ জয় করে কিস্তিমাত ভারতের!

গত ১৪ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে মহাকাশে পাড়ি দেয় চন্দ্রযান ৩। ৫ অগস্টের মধ্যে পৌঁছেও যায় সে চাঁদের কক্ষপথে। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় চন্দ্রযান ২-র ছিটকে যাওয়া অরবিটারেরও। আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ঘনিয়েছিল দুশ্চিন্তাও। শেষপর্যন্ত চন্দ্রযান ২-এর মতোই দশা হবে না তো তৃতীয় প্রজন্মের চন্দ্রযানেরও। এর মধ্যেই এগিয়ে আসে অবতরণের দিনক্ষণ। উৎকণ্ঠা ছিল তার দিনক্ষণ নিয়েও। তবে সেই সমস্ত অনিশ্চয়তার মুখে দুয়ো দিয়ে অবশেষে চাঁদের মাটি ছুঁল চন্দ্রযান ৩। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে অবশেষে চাঁদের পাহাড় ছোঁয়া সম্ভব হল ভারতের। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ীই মঙ্গলবার সন্ধে ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদজয় করল দেশ।

চাঁদের বাড়িতে পৌঁছে তো গেল চন্দ্রযান। সফল ভাবে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করল চন্দ্রযান ৩। এতদিনে কি শেষ হল তবে বিজ্ঞানীদের বিনিদ্র রজনী? না, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং এখান থেকেই শুরু হল নতুন লড়াই। চন্দ্রযান ৩-র বিক্রম চাঁদের মাটি ছোঁয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে গেল নয়া কাউন্ট ডাউন। চাঁদের মাটিতে বিক্রম পা দেওয়ার পরই তার পেট থেকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে বেরিয়ে এসেছে একটি ঢালু রাস্তা। আর সেই রাস্তা ধরেই চাঁদের বুকে নেমে পড়েছে রোভার প্রজ্ঞান। আপাতত ১৪ দিনের জন্য চাঁদই ওর ঘরবাড়ি।

তবে চাঁদের মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করতে হবে না তাঁকে। আপাতত ঘণ্টা চারেক বিশ্রাম নেবে প্রজ্ঞান। তার পর সে আস্তে আস্তে ঘুরে দেখবে চাঁদের আশপাশ। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ছটি চাকায় ভর করে সেকেন্ড প্রতি এক সেন্টিমিটার করে রাস্তা পাড়ি দেবে সেটি।

এরপরেই শুরু হবে তাঁর কাজ। রোভারের সঙ্গেই রয়েছে একাধিক দিকনির্দেশক ও স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা রয়েছে। যা দিয়ে আস্তে আস্তে চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি তোলা শুরু করবে প্রজ্ঞান। চাঁদের মাটি ছুঁল ভারত, অথচ নিজেদের একটা দাগ রেখে যাবে না, তা আবার হয় নাকি। তাই চাঁদের মাটিতে সে এঁকে আসবে ভারতের একটি জাতীয় পতাকা ও ইসরোর লোগো। কী করে আঁকবে? আদতে প্রজ্ঞানের গায়ে এমব্লেম করা রয়েছে ওই দু'টি লোগো, যার ছাপ থেকে যাবে চাঁদের মাটিতে। এর সঙ্গেই শুরু হবে চাঁদের মাটি থেকে বিভিন্ন ডেটা সংগ্রহ করে সেসব ইসরোর বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠানোর কাজ। চাঁদের বাতাস কেমন, বায়ুমণ্ডলের মৌলিক গঠন কেমন, তাঁর ঘনত্বই বা কী? সব পরখ করে দেখে সেসবের তথ্য সরবরাহ করতে থাকবে প্রজ্ঞান। এমনকী চাঁদের মাটির প্লাজমা তথা আয়ন ও ইলেকট্রনের ঘনত্ব পরিমাপ করে সেই তথ্য পাঠাতে থাকবে ইসরোর কাছে। আগামী দু’সপ্তাহ ধরে স্পেকট্রোমিটার বিশ্লেষণের মাধ্যমে চাঁদের মাটিতে কোন ধরনের খনিজ বস্তু আছে, তা-ও খুঁটিয়ে দেখবে সে। এই সমস্ত পরীক্ষাগুলি করার জন্য ল্যান্ডার এবং রোভারের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে পাঁচটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। চাঁদের মাটিতে ভূমিকম্প হয় কিনা, খতিয়ে দেখা হবে তাও।

কিন্তু এতদিন কীভাবে চাঁদে টিকে থাকবে প্রজ্ঞান। শক্তি পাবে কোথা থেকে? সেই চিন্তা যাতে করতে না হয়, তার জন্যই বিজ্ঞানীরা ল্যান্ডার ও রোভারের গায়ে লাগিয়ে দিয়েছেন একাধিক সৌরপ্যানেল। সেখান থেকেই শক্তি সংগ্রহ করবে তারা। তবে রোভার বিক্রম কিন্তু সরাসরি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। তার জন্য দরকার তার ল্যান্ডারের। চাঁদে ঠিক কতখানি পথ পরিক্রমা করবে প্রজ্ঞান? তার হিসেব অবশ্য এখনই বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। ইসরোর প্রধান এস সোমনাথ জানান, তা বিভিন্ন জিনিসের গণনার পরেই নির্ধারণ করা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, চাঁদের যে অঞ্চলে অবতরণ করেছে চন্দ্রযান ৩, তা চাঁদের দক্ষিণ মেরু। সেখানে রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ২৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। ফলে আঁচ করাই যায়, সেই হিমাঙ্ক সহ্য করা সহজ হবে না প্রজ্ঞানের জন্য। অবশ্য তেমন ভাবেই তৈরি করা হয়েছে যন্ত্রটিকে। ফলে প্রথম চোদ্দ দিন অতিক্রম করার পরও আদৌ টিকে থাকবে কিনা প্রজ্ঞান, তা নিয়ে সম্পূর্ণ রকম নিঃসংশয় হতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। তবে আশাও ছাড়ছেন না।

আরও পড়ুন:চন্দ্রযান ৩-র সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে শেষ ১৫ মিনিটেই! কেন জরুরি ‘সন্ত্রাস’-এর এই ১৫ মিনিট?

আসলে অন্য তিনটি দেশ চাঁদের মাটি ছুঁলেও চাঁদের দক্ষিণ মেরু এর আগে স্পর্শ করেনি কোনও দেশ। ফলে সেখানকার প্রায় সবটাই অনাবিষ্কৃত। সেই কারণেই চাঁদের 'কুমেরু'-কেই নিশানা করেছিল ইসরোর বিজ্ঞানী। চাঁদে জল আছে কি নেই, এ তর্ক বহুদিনের। সেই রহস্য ভেদ করাও প্রজ্ঞানের বড় একটি দায়িত্ব। চাঁদের মাটিতে যদি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের হদিস পাওয়া যায়, তাহলেই জলের অস্তিত্বের ব্যাপারে জানা যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। আর হাইড্রোজেনের হদিস পাওয়া মানে শক্তির উৎসের খোঁজ পাওয়া, তেমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। চাঁদে পৌঁছনো তো হয়েই গিয়েছে। এবার চাঁদের অনাবিষ্কৃত সত্যের দরজার খোঁজ যদি পেতে পারে প্রজ্ঞান, কে বলতে পারে ভবিষ্যতে চাঁদের মাটিতে নতুন কোনও শক্তিভাণ্ডারের খোঁজ পাবে না ভারত। প্রতিদিন পৃথিবী একটু একটু করে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে শক্তিভাণ্ডার। চাঁদের মতো উপগ্রহ বা অন্য গ্রহে যদি শক্তিভাণ্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীকে বাঁচানো সহজ হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। আর কে বলতে পারে প্রজ্ঞানের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে না অন্য কোনও ভিনগ্রহী কিংবা উপগ্রহীর।

 

More Articles