বুনো ওল বনাম বাঘা তেঁতুল! অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়-অরুণাভ ঘোষ সংঘাতের আসল কারণ কী
বিবাদমান দুই পক্ষের নাম, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। এতে বিচারব্যবস্থা কতটা কলঙ্কিত হলো, সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, তাঁদের দ্বিমুখী লড়াইয়ের 'বচন’ নিয়ে চর্চা গড়াল দিন থেকে দিনান্তে।
এজলাসে ডুয়েল।
প্রতিপক্ষ (দুই আইনজীবী নন) এক আইনজীবী বনাম বিচারপতি।
যেন বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের লড়াই! এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! মুখের তোড়ে কেউই কম গেলেন না! বিবাদমান দুই পক্ষের নাম, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। এতে বিচারব্যবস্থা কতটা কলঙ্কিত হলো, সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, তাঁদের দ্বিমুখী লড়াইয়ের 'বচন’ নিয়ে চর্চা গড়াল দিন থেকে দিনান্তে। আইনজীবী বিচারপতিকে বলছেন, তিনি আইন জানেন না। (বিচারপতি কতটা প্রতাপশালী সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, অবশ্যই এতে খেপে যাওয়ার উপাদান ছিল)। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা। "আপনাকে আমি রুল ইস্যু করে জেলে পাঠাব,"- এরপর অরুণাভকে বিচারপতি। সত্যিই তিনি আইনজীবীকে জেলে ভরতে পারবেন না, তা তর্কসাপেক্ষ। তবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুই বিচারপতি আর আইনজীবীর ডুয়েলের যেভাবে সাক্ষী থাকল এজলাস, তাতে রসের উপাদান অবশ্যই আছে। কারণ যাঁরা সাধারণকে বিচার দেন, তাঁরাই কিনা বিবাদমান! কী হলো এ-দিন?
আরও পড়ুন: দাপটে অস্থির মন্ত্রী-আমলা, একাই একশো বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের 'অম্লমধুর' সম্পর্ক নিয়ে বারবার চর্চায় মেতেছে কলকাতা হাই কোর্ট। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এবং আইনজীবী ঘোষের বচসা গড়িয়েছিল আদালতের বাইরেও। ১৮ অগাস্ট তাঁরা তর্কে জড়ালেন এজলাসের ভেতরেই।
এইদিন বিকেল ৩টে নাগাদ হাই কোর্টে টেট মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। এজলাসে এসে বিচারপতি বলেন, "আমি আজ মামলা শুনব না। শরীরটা ভালো নেই। অরুণাভ কোথায়?" সংবাদমাধ্যমের সূত্র বলছে, তখন গান গেয়ে ওঠেন আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়- তুমি আসবে বলে কোর্টরুমে এত ভিড় হয়ে গেল! এরপর অনুব্রত মন্ডলের মেয়ে সুকন্যার আইনজীবী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "আপনিও নাকি ভালো গান করেন?"
তখন এজলাসে প্রবল ভিড়। এই নিয়ে অরুণাভ ঘোষ বলে বসেন, "আদালত যেন ছাতুবাবুর বাজার হয়ে গেছে। এত ভিড়!" এই থেকে শুরু হয় বচসা। মাঝে দুম করে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলে বসেন, একদিন সুযোগ পেলে গান্ধী পরিবারের হলফনামাও দেখব। মেজাজ হারান অরুণাভ। তিনি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলেন, "আপনি আইন জানেন না। আপনাকে কী করে ডিল করতে হয় জানি। সাংবাদিকরা আপনার চেম্বারে যান। আপনি অনেক কথা বলেন।"
অভিজিৎ এর পাল্টা দেন সঙ্গে সঙ্গে। "আপনি তো সংবাদমাধ্যমে অনেক কিছু বলেছেন। এই নিয়ে রুল জারি করে জেলে পাঠাব। আমার শরীর ভালো না। আসতাম না। কিন্তু না আসলে অনেকে ভাবত আমি ভয়ে পালিয়ে গিয়েছি। তাই এলাম।"
তারপরেই বিচারপতি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রক্রিয়া শেষে অরুণাভর উদ্দেশে হাতজোড় করেন। বাকি আইনজীবীরা অরুণাভকে বলেন, "আপনি উঠে দাঁড়ান", সেই শুনে অরুণাভ দাঁড়িয়ে হাসেন। অভিজিৎ কল্যাণ ও অরুণাভর উদ্দেশে বলেন, "মনে কোনও ক্ষোভ রাখবেন না।"
তাহলে কি মধুরেণ সমাপয়েৎ!
বিচারপতির দাপটে কেঁপেছে এজলাস
এসএসসি হোক অথবা ডিএ, এইসব মামলাকে কেন্দ্র করে বারবার চর্চায় উঠে এসেছেন দু’জন বিচারপতি। একজন হলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরেকজন হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগ। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি একসময় স্কুল সার্ভিস কমিশনেরই আইনজীবী ছিলেন। যদিও তাঁর কেরিয়ার শুরু হয়েছিল একজন ডব্লুবিসিএস অফিসার হিসেবে। তবে এই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে কলকাতা হাই কোর্টে তিনি যোগ দেন ২০১৮ সালের ২ মে। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৩০ জুলাই হাই কোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এর আগে তিনি দশ বছর ধরে আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছেন। ন্যাশনাল ইনশিওরেন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাও তাঁকে লড়তে দেখা গিয়েছে। অন্যদিকে ২০২১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় একের পর এক নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ই এখন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের কাছে আশা-ভরসার পীঠস্থান। নেটমাধ্যমে প্রশংসাও কুড়োচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এ-যাবৎ সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য নির্দেশ হলো, এসএসসি মামলায় মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর শিক্ষকতার চাকরি কেড়ে নেওয়া এবং ৪১ মাসের বেতন ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ। এসএসসি সংক্রান্ত মামলা কেবলমাত্র সিবিআই-এর হাতে তুলে দেওয়ায় নয়, এর পাশাপাশি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বকেও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন তিনি। দুর্নীতির মামলা ছাড়াও এই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষকে ২৫ বছরের বকেয়া বেতন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন। ক্যানসার-আক্রান্ত শিক্ষিকার ১২ দিনের বেতন কেটে নেওয়ায় প্রধান শিক্ষকের পদ কেড়ে নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ওই প্রক্রিয়া দ্রুত মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ধারে-ভারে কতটা প্রভাব ফেলেছেন সমাজে এই বিচারপতি!
কম যান না অরুণাভ ঘোষ
শুধুমাত্র টিভির পর্দায় নয়, তাঁর মেজাজের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই পরিচয় ঘটেছে রাজ্যবাসীর। আইনজীবী এবং কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বিভিন্ন সময়ে বিনামূল্যে দুঃস্থদের হয়ে মামলা লড়েছেন, বিধাননগরে সম্পত্তি কর নিয়ে মামলা অথবা বাম আমলে সল্টলেকে জমি বণ্টন নিয়ে তাঁর প্রতিবাদী মেজাজের সাক্ষী থেকেছে রাজ্য। বারে বারে বিভিন্ন মামলায় তাঁর সওয়াল জবাবে কেঁপেছে এজলাস। তিনি বর্ষীয়ান আইনজীবী। তাঁর সন্ত্রাসবিরোধী মুখ তুলে ধরে ২০১৬ সালে বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁকেই বেছে নেয় দল। তাঁকে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী করা হয়। নিন্দুকরা বলেন, তিনি যত সক্রিয় টিভির পর্দায়, পথের আন্দোলনে তত ক্রিয়াশীল নন।
সে যাই হোক, সাতের দশকে প্রেসিডেন্সির আঙিনায় ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে তাঁর উপস্থিতি প্রবল। ২০০১-এ সিপিএমের ভরা বাজারেও দমদম কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। পরে ফেরেন কংগ্রেসে।
রাজনীতির আঙিনায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সময় তাঁর গর্জন শুনেছে রাজ্য। সম্প্রতি খোদ তাঁর দল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের কথা বললে, তিনি আইনজীবীর মতো এই নিয়ে কী বক্তব্য রেখেছিলেন? "মমতা সব জানেন। তবে যদি এ-কারণে মমতার পদত্যাগ চাওয়া হয়, তাহলে জ্যোতিবাবুর পদত্যাগ করা উচিত ছিল লক্ষণ শেঠের ব্যাপারে। লক্ষণবাবু চোর মানে জ্যোতিবাবু চোর নন। বুদ্ধদেববাবুও সৎ। রেজ্জাক মোল্লা তাঁর দলেও তো ছিলেন। কিন্তু, বর্তমান দুর্নীতি প্রসঙ্গে মমতা সব জানতেন।" মমতাকে নিশানাও করেন অরুণাভ। তাঁর কটাক্ষ, "আমার ছেলে যদি চুরি করে, ক'টা লোক আছে, নিজের ছেলেকে চোর বলবে? আমার বাপ চোর এটাই বা ক'জন বলতে পারে।" কখনও কখনও তাঁর আইনের পেশা ছাপিয়ে গেছে তাঁর রাজনৈতিক সত্তাকে। সম্প্রতি তৃণমূল-বিজেপিকে হারিয়ে হাই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন অরুণাভ ঘোষ। এতে কিছুটা হলেও অক্সিজেন পায় হাত শিবির।
অরুণাভ ঘোষ কিংবা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রত্যেকেই স্ব-স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক আগে থেকেই। অভিজিৎ সম্পর্কে বিভিন্ন সময় নাকি অপ্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন অরুণাভ। আদালতের ভেতরে নাম না করে তাঁকে 'হাই কোর্টের জ্যাঠামশায়' বলে সম্বোধন করেছেন অভিজিৎও। ফলে বলা যায়, এদিন যা ঘটেছে, তা দীর্ঘ দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়ামাত্র। কিন্তু এজলাসে তাঁরা যা করলেন, তা কি এককথায় কলকাতা হাই কোর্টের ইতিহাসে নজির হয়ে থাকল না?