কেন হু হু করে কমছে ফেলুদা-ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা, কতটা দায় টলিউডের পরিচালক ও প্রযোজকদের?

এতজন পরিচালক, এত অভিনেতার ভিড়ে এই দু'টি চরিত্রের রোমাঞ্চ, যে কোনও পর্দার জন‍্যই ধ্বংস হয়ে গেছে।

একজন সত্যান্বেষী, আর একজন এবিসি, অর্থাৎ এশিয়াস বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর। ব্যস, এইটুকুই বাঙালির মনে আলোড়ন তোলার জন্য যথেষ্ট। একজনের ঠিকানা প্রথমে হ্যারিসন রোড, পরে কেয়াতলায়; আর অন্যজনের দক্ষিণ কলকাতার রজনী সেন রোডে, একজনের স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যজনের সত্যজিৎ রায়। বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ব্যোমকেশ ও ফেলুদা। সৃষ্টির এত বছর পরেও দুই গোয়েন্দা চরিত্রর জনপ্রিয়তায় কিন্তু একটু ভাটা পড়েনি বা বলা ভালো তা হতে দেওয়া হয়নি। এরম দুই গোয়েন্দাচরিত্র ভারতীয় সাহিত্যে নির্বিকল্প।

দুই চরিত্রের সৃষ্টির পর থেকে ব্যোমকেশ ও ফেলুদাকে নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। কখনও বাংলায়, কখনও হিন্দিতে। আজ এত বছর পরেও এই দুই চরিত্র নিয়ে উন্মাদনা এখনও সেই একইভাবে বর্তমান। বদলেছে সময়, বদলেছে সিনেমা। নির্মাণের আঙ্গিকে ব্যোমকেশ ও ফেলুদার চরিত্রে এসেছে বদল। কখনও তা দর্শক গ্রহণ করেছে, কখনও বা করেনি। কিন্তু আজও ব্যোমকেশ ও ফেলুদার সিনেমা বেরলে দর্শক সেই একইভাবে উত্তেজিত হয়। ব্যোমকেশ চরিত্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের মাধ্যমে আর প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়, 'চিড়িয়াখানা' গল্প অবলম্বনে। ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার, অজিতের চরিত্রে শৈলেন মুখোপাধ্যায়। সিনেমাটি হিট হলেও শরদিন্দুবাবু কিন্তু ছবিটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এরপর দ্বিতীয় ছবিটি আসে ১৯৭৪ সালে, ‘শজারুর কাঁটা’, পরিচালক ছিলেন মঞ্জু দে। ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয় করেন শ্যামল ঘোষাল ও অজিতের চরিত্রে আবারও শৈলেন মুখোপাধ্যায়।

Byomkesh Uttam Kumar

'চিড়িয়াখানা'-র একটি দৃশ্য

ফেলুদার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়, ১৯৬৫ সালে, ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ গল্পের মাধ্যমে। এরপর প্রায় ৩৫টি ছোট-বড় গল্প প্রকাশ পেয়েছে। ফেলুদার গল্প অবলম্বনে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায় নিজে। ১৯৭৪ সালে ‘সোনার কেল্লা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পর্দায় প্রকাশ পায় ফেলুদা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফেলুদার চরিত্রে। তারপর আর ফেলুদাকে ঘুরে তাকাতে হয়নি। আপামর বাঙালি ফেলুদার সেই মগজাস্ত্রের ধার আর ফেলুদার চরিত্রের সঙ্গে একদম মিলে যাওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আপন করে নিয়েছিল। সত্যি বলতে, সত্যজিৎ রায় নিজেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেই ফেলুদার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। এরপর সত্যজিৎ রায় নিজের জীব্বদশায় আর একটি ফেলুদার চলচ্চিত্র করে গেছেন, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। তখন থেকেই বাঙালি দর্শকদের মনে ফেলুদা বলতেই যে চরিত্রটি মনে ভাসত, তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়েরই। কিন্তু ব্যোমকেশ হিসেবে সেরম কেউ তখনও আমাদের মনে গেঁথে বসেননি।

Movie Scene

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া ফেলুদা ভাবা যেত না

সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সন্দীপ রায় ফেলুদার সিনেমা তৈরি করতে লাগলেন একে একে। ছোটপর্দায় 'ফেলুদা ৩০' সিরিজের জন্য পাঁচটি ও 'সত্যজিতের গপ্পো'-র জন্য চারটি ফেলুদাকাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হয়, এছাড়াও ই টিভি বা‌ংলার 'সত্যজিতের প্রিয় গপ্পো'-তে হয় 'ডা. মুনসীর ডায়রি'। ছোটপর্দায় ফেলুদা হিসেবে এলেন সব‍্যসাচী চক্রবর্তী। তোপসে হলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের দৌলতে বাঙালির কাছে জটায়ুর চরিত্রায়ণ ছিল সংবেদনশীল। সন্তোষ দত্তর মৃত্যুর পর সত্যজিৎ নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, আর ফেলুদা বানাবেন না তিনি‌। সেই চরিত্রে ছোটপর্দায় অভিনয় করলেন তিন জন। রবি ঘোষ, অনুপকুমার ও বিভু ভট্টাচার্য। এরপর আবার বড়পর্দায় পা রাখল ফেলুদা, 'বোম্বাইয়ের বোম্বেটে (২০০৩) দিয়ে। তারপর 'কৈলাসে কেলেঙ্কারি' (২০০৭), 'টিনটোরেটোর যীশু' (২০০৮), 'গোরস্থানে সাবধান' (২০১০) ইত্যাদি ছবিগুলি হলো পরপর। ফেলুদা রইলেন সেই সব্যসাচী, এবং 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য' অবধি জটায়ু রইলেন বিভু ভট্টাচার্য। বিভু।ভট্টাচার্য মারা যাওয়ায় আবার শূন্যস্থান তৈরি হলো জটায়ুর ক্ষেত্রে। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য হলেন বড়পর্দার তোপসে।

Movie Scene

'ডা. মুনসীর ডায়রি'-তে ফেলুদার চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী

আরও পড়ুন: কেন বারবার ব্যোমকেশই জিতে যায়? ফেলুদা-কিরীটির থেকে কোথায় এগিয়ে সে!

একদিকে যখন ফেলুদা একের পর এক ছক্কা হাঁকাচ্ছে, তখন বড়পর্দায় ব্যোমকেশের কোনও পাত্তাই ছিল না। বাঙালিরা, তথা ব্যোমকেশপ্রেমীরা যখন তাঁকে প্রায় ওই বইয়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ করে নিয়েছে, তখনই, প্রায় কয়েক দশক বাদে, হাজির হয় ব্যোমকেশ। ২০০৯ সালে আবার বড়পর্দায় ফিরে আসে সত্যান্বেষী, ‘মগ্ন মৈনাক’ গল্প অবলম্বনে। কিন্তু তেমনভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না স্বপন ঘোষালের এই সিনেমা। ব্যোমকেশের চরিত্রে ছিলেন শুভ্রজিৎ দত্ত, যিনি ব্রাত্য বসুর নাট্যরূপে ও নির্দেশনায় মঞ্চেরও ব্যোমকেশ বটে। কিন্তু এর পরের বছরই অঞ্জন দত্ত পরিচালনা করেন 'ব্যোমকেশ বক্সী', 'আদিম রিপু' গল্প অবলম্বনে। ব্যোমকেশের চরিত্রে আবির চট্টোপাধ্যায়, অজিত হলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ফেলুদার পাশাপাশি এরপর থেকে ব্যোমকেশও বড়পর্দা মাতাতে থাকে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়- 'আবার ব্যোমকেশ', 'ব্যোমকেশ ফিরে এল'। এর মাঝে হঠাৎ সন্দীপ রায়ের হাত ধরে আবির হলেন ফেলুদা। চলচ্চিত্রায়িত হলো 'বাদশাহী আংটি'। ফেলুদা-ব্যোমকেশ একসঙ্গে করা যাবে না, এই যুক্তিতে আবিরকে ব্যোমকেশের চরিত্র ছাড়তে হয়। অঞ্জন দত্তর নতুন ব্যোমকেশ হন যিশু সেনগুপ্ত‌।

movie scene

'ব্যোমকেশ বক্সী' ছবিতে আবির চট্টোপাধ্যায়

এব‌ং তারপরেই অরিন্দম শীলের নির্দেশনায় আবির আবার ফেরেন ব্যোমকেশ হয়ে। 'হর হর ব্যোমকেশ', 'ব্যোমকেশ পর্ব', 'ব্যোমকেশ গোত্র', এবং অবশেষে 'ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ', যা মুক্তি পেয়েছে সম্প্রতি, ব্যোমকেশের চরিত্রে অব্যাহত আবির চট্টোপাধ্যায়। অন্যদিকে সন্দীপ রায়ের নির্দেশনায় ফেলুদা আবার ফেরে 'ডবল ফেলুদা'-র মাধ্যমে, ফেলুদা আবারও সব্যসাচী চক্রবর্তী। কিন্তু তাঁর বয়স তখন দৃশ‍্যত বেশি। মাঝে ২০১৩ সালে মুক্তি পায় 'সত্যান্বেষী', পরিচালক খোদ ঋতুপর্ণ ঘোষ। ব্যোমকেশের চরিত্রে ছিলেন মুম্বইয়ের চিত্রপরিচালক সুজয় ঘোষ।

আবির চট্টোপাধ্যায়ের পর বাংলায় চতুর্থ ফেলুদা ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ২০১৫ সালে প্রথম ফেলুদাকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ প্রকাশ পায়। পরিচালনা পরমব্রতরই। তোপসে হয়েছিলেন ঋদ্ধি সেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেলুদার গল্পের কিঞ্চিৎ বিনির্মাণ ছিল সেখানে। এরপর ফেলুদা ওয়েবেই ফেরে, প্রায় ঝড় তুলে, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ফেলুদা হন টোটা রায়চৌধুরি, তোপসে কল্পন মিত্র, আর জটায়ুর চরিত্রে বহুকাঙ্ক্ষিত অনির্বাণ চক্রবর্তী। 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ' ও 'দার্জিলিং জমজমাট'- পরপর দু'টি গল্প নিয়ে দু'টি আলাদা ওটিটি প্ল‍্যাটফর্মে দু'টি ওয়েব সিরিজ জনপ্রিয়তাও পায়। আবার সন্দীপ রায়ের হাত ধরে আসছে 'হত্যাপুরী', ফেলুদা ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, জটায়ু অভিজিৎ গুহ‌, তোপসে আয়ুশ দাস‌। এরপর অরিন্দম শীলও বানাবেন ফেলুদা।

Movie Scene

'দার্জিলিং জমজমাট'-এ টোটা রায়চৌধুরি, অনির্বাণ চক্রবর্তী ও কল্পন মিত্র

অন‍্যদিকে ব্যোমকেশের চরিত্রে ওটিটিতে এসেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ছোটপর্দায় এই চরিত্রে দেখা গেছে বিভিন্ন সময় রজিত কাপুর (হিন্দিতে) সুদীপ মুখোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি বিশ্বাস ও গৌরব চক্রবর্তীকে।

Movie Scene

'ব্যোমকেশ' অনির্বাণ ভট্টাচার্য

হিন্দি বড়পর্দাতেও প্রকাশ পেয়েছে ব্যোমকেশ বক্সী, অভিনয় করেছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত। পরিচালক ছিলেন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে শুধু ব্যোমকেশ নয়, ফেলুদাও হয়েছিল হিন্দিতে, দূরদর্শনের জন্য। 'যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে' অবলম্বনে সেই ছবির নাম ছিল ‘কিসসা কাঠমান্ডু কা’। কিন্তু তেমনভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি তা।

যেমন চরিত্র বদলেছে, তেমনই বদল ঘটেছে পরিচালকের, কারও হাতে সিনেমা ও গল্পের বুনন প্রাণ পেয়েছে, কারও হাতে গল্পের রহস্য-রোমাঞ্চ নিছক সাধারণে পরিবর্তিত হয়েছে। যেহেতু গল্পগুলি আগে থেকেই বেশিরভাগ দর্শকের পড়া থাকে, তাই সিনেমা তৈরি করতে হয় তা মাথায় রেখেই, যাতে দর্শক গল্প সব জানা সত্ত্বেও সেই প্রথমবারের পড়ার মতো উত্তেজনা তারা অনুভব করতে পারে। আর এই উত্তেজনা যে সিনেমায় থাকে না, তা যেমন চলচ্চিত্র হিসেবে ব্যর্থ, তেমনই অ্যাডাপ্টেশন হিসেবেও।

আর এইখানেই ঘটেছে আসল গোলমাল। এতজন পরিচালক, এত অভিনেতার ভিড়ে এই দু'টি চরিত্রের রোমাঞ্চ, যে কোনও পর্দার জন‍্যই ধ্বংস হয়ে গেছে। একই অভিনেতা ব্যোমকেশ, ফেলুদা দুইই হয়েছেন (আবির ও পরমব্রত), একই পরিচালক বড়পর্দায় বানাচ্ছেন ব্যোমকেশ, ওটিটিতে বানাচ্ছেন ফেলুদা (অরিন্দম শীল)। ষাটোর্ধ্ব সব‍্যসাচী সাতাশের ফেলুদা হয়ে পর্দায় আসছেন তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ ও সব‍্যসাচীর ফেলুদার টক্কর নিয়ে তৈরি হয়েছে হাস্যাস্পদ সিনেমা। কখনও ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় বৃদ্ধ ব্যোমকেশের চরিত্রে এসেছেন (শজারুর কাঁটা), আবার কখনও বাংলাদেশে ফেলুদা হয়েছেন আহমেদ রুবেল। যত ফেলুদা-ব্যোমকেশের ভিড় পর্দায় বেড়েছে, তত সেলুলয়েডে এই গোয়েন্দাদের উপস্থিতি ঘিরে উত্তেজনার পারদে ঘাটতি দেখা গেছে।

হ‍্যাঁ, জেমস বন্ডেও বহু অভিনেতা এসেছেন, গেছেন। স্পাইডারম্যান হয়েছেন নয় নয় করে তিন জন অভিনেতা। কিন্তু এসবের পরেও হলিউড জানে, ইউনিভার্স কাকে বলে। আমাদের এখানে কোনও ব্যোমকেশ ও ফেলুদা ইউনিভার্সই তৈরি হলো না। উল্টে প্রযোজকরা ফেলুদা নিয়ে মামলা লড়লেন, কখনও লড়াই জমাতে একইদিনে মুক্তি পাওয়ালেন দু'-দু'টি ব্যোমকেশ। মুনাফা আর লাভের অঙ্কে ঢেকে গেল বাঙালির প্রিয়তম দুই আইকনিক গোয়েন্দা।

More Articles