চাইলেই নিজের উচ্চতা কমাতে পারে মানুষ? পিঁপড়ের চেয়েও ক্ষুদ্র হলে কী হবে মানুষের?

Human Height Reduction: লম্বুদার উচ্চতা যদি ১ ইঞ্চি কমে, তাহলে তাঁর দেহের উপরিভাগ মানে ত্বকের ক্ষেত্রফলও সেই অনুপাতে কমবে।

আমরা কত বড়? মানে চোখে দেখা উচ্চতায়। পাঁচ কিংবা ছয় ফুট। অনেকে তার বেশি বা কম। সে যাই হোক, উচ্চতায় কীই বা আসে যায়? আসলে যায়, আসেও। ধরুন, আমাদের মধ্যে সব থেকে লম্বা মানুষটিরও যদি বেঁটে হতে ইচ্ছে করে? আর ছোট হতে হতে পিঁপড়ের মতো হয়ে গেলে ঠিক কী হবে? এসব হওয়া কি আদৌ সম্ভব? বিদেশের বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন সিনেমায় যেমন দেখায় আর কী, অ্যান্টম্যানের কাহিনি- এসব সত্যিই হতে পারে? চিত্রনাট্যর প্রয়োজনে, অ্যানিমেশনের কৃপায় এই আধুনিক যুগে চরিত্রগুলিকে ইচ্ছেমতো লম্বা-খাটো করা তো জলভাত। কিন্তু বাস্তবেও কি সম্ভব? এমনিতে তো জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী খুব জোরে, মানে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে কাউকে ছুটিয়ে দিলে তার দৈর্ঘ্য কমতে থাকবে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে 'দৈর্ঘ্যর সংকোচন'। যাক, সেদিকে এখন যাচ্ছি না।

আমাদের চারপাশে বিভিন্ন চেনা জীব-জন্তুর তাদের আকার অনুযায়ী জীবনযাত্রার পরিবেশও বিভিন্ন। যে যেমন আকারের তার টিকে থাকার ঝুঁকিও তেমন। এই যেমন ধরুন, মাছের ডিমের ব্যাস মোটামুটি ০.২৪ থেকে ৬.৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। আকারে ছোট হওয়ার হেতু এর বিপদও অনেক। একটা মাছের পেটে যত সংখ্যক ডিম থাকে, সবগুলো থেকে যদি আবার মাছের জন্ম হতো তাহলে পুকুরে তাদের বড় হয়ে ওঠা দুষ্কর হয়ে যেত। কিন্ত বাস্তবে এমন হওয়া থেকে বাঁচায় ডিম শিকারিদের দৌরাত্ম্য।

মাছের ডিমের থেকে প্রাণী কোশ আকারে অনেক ছোট, তা প্রায় ১০০০ গুণ। এক্ষেত্রে পরিমাপ করা হয় সাধারণত মাইক্রোমিটার স্কেলে। এরও হাজার ভাগের এক ভাগে হিসেব করলে আমরা পৌঁছে যাবো ন্যানোর ঘরে, হরেক রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমরা যে এককে প্রকাশ করি। বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যেমন সব থেকে কম, ৩৮০ ন্যানোমিটার, লাল আলোর ক্ষেত্রে আবার সর্বোচ্চ ৬২৫ থেকে ৭৪০ ন্যানোমিটার। এর আবার ১০ গুণ ছোট একক হচ্ছে 'অ্যাংস্ট্রম'। বিজ্ঞানীরা পরমাণুর আকার-আকৃতি মাপেন এই এককে। আমাদের বহুল পরিচিত সব থেকে সরল পরমাণু হলো হাইড্রোজেন। এর ব্যাসার্ধ ০.৫৩ অ্যাংস্ট্রম। বিজ্ঞানের পরিমাপ সম্পর্কে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা গেল। এবার বরং আমরা ফিরে আসি আমাদের আগের কল্পনায়। কোনও লম্বা লোক যদি ছোট হতে হতে এই পারমাণবিক আকারে, মানে অ্যাংস্ট্রম এককে পৌঁছতে চায়? তাহলে ব্যাপারখানা কেমন দাঁড়াবে? মানে আমাদের চেনা আকৃতি ছেড়ে পরমাণুদের বাড়িঘরে এলে টিকতে পারব কি আমরা?

আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া

এর উত্তর দিতে গেলে আমাদের একটু অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে যে, পরমাণুর পাড়া ঠিক কত বড়? এই ধরুন আমাদের দেশের জনসংখ্যার সমান, মানে প্রায় পৌনে দেড়শো কোটি পরমাণুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে (বিজ্ঞানের পরিভাষায় বল প্রয়োগ করে বা কোনও ক্ষেত্রের প্রভাবে) যদি এক জায়গায় নিয়ে আসা যায়- তাকে দেখতে অনেকটা ক্রিকেট বলের মতো লাগবে। অর্থাৎ একটি ছোট ক্রিকেট বলের ভেতরে জায়গা করে নেবে আস্ত এক ভারত-পরমাণু।

এই পারমাণবিক পর্যায়ে পৌঁছতে প্রথম বাধ সাধবে পরমাণুর ভর। কারণ ভর ধ্রুবক রেখে, আকৃতি ছোট করা মানে ঘনত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে পাড়ার লম্বুদাকে পিঁপড়ের আকারে নিয়ে গেলে তাঁর পায়ের চাপ বেড়ে যাবে প্রায় সাধারণ অবস্থার ১০০০০ গুণ। অতএব আকারে ছোট করলে হ্যাপা একটাই, লম্বুদার প্রতিটি ধাপের ওজন হবে প্রায় ৭০ কেজি।

আকারে ছোট হওয়ার প্রভাব মানব দেহের সমস্ত প্রাত্যহিক কর্মে পড়বে। যেমন ধরুন, লম্বুদার উচ্চতা যদি ১ ইঞ্চি কমে, তাহলে তাঁর দেহের উপরিভাগ মানে ত্বকের ক্ষেত্রফলও সেই অনুপাতে কমবে। ভাবছেন, তাতে কী আর এমন হলো? এই ত্বক মানবদেহের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এর মাধ্যমে শরীরের বাড়তি তাপ বের হয়ে যায়। এখন দেহের ত্বকের ক্ষেত্রফল হ্রাস পেলে, বাড়তি তাপ ঠিকমতো বার হতে পারবে না। এক পরিচিত গণনা বলে, পাড়ার লম্বুদার উচ্চতা ১ ইঞ্চি কমালে তাঁর ত্বক অনেকটা প্রায় ৫ হাজার ভাগ ছোট হয়ে যাবে। শুধু চামড়া বা ত্বকই নয়, ফুসফুসের আকারও কমতে থাকবে। তাতে অবশ্য আমাদের লম্বুদার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে বিশেষ কোনও অসুবিধা হবে না।

শরীরের আকৃতির এই সামান্য পরিবর্তনে পর্যাপ্ত শক্তির জোগান ঠিক রাখতে গেলে খাদ্যের জোগানটাও ঠিকঠাক হওয়া দরকার। শরীরের ওজনের কোনও পরিবর্তন যেহেতু হচ্ছে না তাই একই শক্তি জোগানোর জন্য লম্বুদাকে স্বাভাবিক পরিমাপেই খেতে হবে। আমরা জানি, মানব শরীর একটা সিস্টেম বা তন্ত্র যার তাপ তৈরির হার এর ভরের সমানুপাতিক।

আর এই তাপ সৃষ্টির দু'টি উপায়। হয় লম্বুদার শারীরিক বিপাকীয় প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানো, অথবা সমপরিমাণ শক্তি বাইরে থেকে সরবরাহ করা। এতক্ষণ যে গাণিতিক হিসাবগুলো দিলাম সবই কিন্তু মানব দেহের ১ ইঞ্চি উচ্চতা হেরফেরের নিরিখে। হাইড্রোজেনের পাড়ায় থাকতে গেলে এখনও পেরোতে হবে ঘোর বিপদ-আপদ।

প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চতা কমানোর সময় আশেপাশের সমস্ত কিছুই লম্বুদার কাছে ক্রমশ বড় হতে থাকবে। তারপর হঠাৎ করেই এক সময় নেমে আসবে আঁধার। কারণ বিজ্ঞানীদের হিসাবে লম্বুদার আকারকে যদি তাঁর স্বাভাবিক আকারের ১০,০০০ ভাগের একভাগে নামিয়ে আনা যায়, তাহলেই ঘরের দৃশ্যমান আলোতে লম্বুদার চোখ তার কর্মক্ষমতা হারাবে। আকারে ছোট হওয়ার দরুণ চোখের তারারন্ধ্র এতই ক্ষুদ্র হবে যে কোনও আলোই প্রবেশ করতে পারবে না।

আরও পড়ুন- “চরকায় সুতো কেটে দেশের উন্নতি হবে না!” গান্ধীর সমালোচনাই কাল হয়েছিল মেঘনাদ সাহার?

ধীরে ধীরে আমাদের চিরপরিচিত লম্বুদাকে অ্যাংস্ট্রম পর্যায়ে নিয়ে গেলে অক্সিজেন অণুই তাঁর কাছে হিমালয়ের মতো ঠেকবে। বাঁচবার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাওয়ারই সুযোগ থাকবে না তখন। শুধু অক্সিজেনই নয়, আশেপাশের সকল পরমাণুই লম্বুদার কাছে দৃশ্যমান হবে। সে দেখতে থাকবে ইলেকট্রনের মেঘ। যার প্রতিটা পরতে পরতে রহস্যের হাতছানি। লম্বুদার সামনেই ঘটতে থাকবে পরমাণুর অভ্যন্তরীণ বাজারঘাট- তথা পূর্ণ কার্যক্রম!

লম্বুদার এই অবস্থা একজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর ভাবতে চমকপ্রদ লাগলেও মানবদেহের আকারকে অ্যাংস্ট্রম পর্যায়ে ছোট করার ক্ষেত্রে একটা মহা ঝামেলা আছে। মহাকাশে আমরা যেসব তারকারাজি দেখতে পাই, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সংখ্যক অণু-পরমাণু আছে আমাদের শরীরে। এই সমস্ত পরমাণুকে জড়ো করে হাইড্রোজেন পরমাণুর চেয়েও ছোট জায়গায় আবদ্ধ করলে বস্তুর আগের সমস্ত গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের কোনও অস্তিত্বই এই অ্যাংস্ট্রম পর্যায়ে আর থাকে না। তখন এরা হয়তো পরিণত হবে ব্ল্যাকহোল কিংবা নিউট্রন স্টারের মতো কঠিনতম বস্তুতে! নিউট্রন তারায় যে পদার্থ থাকে, তার এক চা চামচের ভর প্রায় এক বিলিয়ন টন!

আসলে, ইচ্ছা যতই করুক পাড়ার লম্বুদাকে পিঁপড়ে বানানোর বা নিজেই সায়েন্স ফিকশন সিনেমার নায়ক হয়ে ওঠার, ওসব সিনেমাতেই মানায়। আমরা যেমন আছি সেটাই সুবিধাজনক, এখানে প্রতিনিয়ত কেউ আমাদের গিলে খেতে আসছে না মাছের ডিমের মতো। অস্তিত্ব টেকানোর দায় মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় না প্রতিনিয়ত। এই আকার নিয়েই আমরা পৌঁছে গেছি চাঁদে, মঙ্গলে, মহাবিশ্বে। আর এদিকে বাকি রইল ইলেকট্রনের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সে তো কোয়ান্টাম বলবিদ্যার চর্চার সুবাদে অজস্রবার এঁকেছি তাদের ঘরবাড়ি-পরমাণুর অন্দরমহল আরও কত কী? এর জন্যে আমাদের এই সাড়ে তিন হাত দীর্ঘ শরীরই যথেষ্ট।


ঋণস্বীকার :

১। কনসেপ্ট অফ মডার্ন ফিজিক্স - আর্থার বাইসার

২। তুলনামূলক সংখ্যার পরিমাপ সংক্রান্ত তথ্য -আন্তর্জাল

More Articles