কেমন হতো বিদ্যাসাগরবিহীন বাংলা, কী হতো রামমোহনের জন্মই না হলে?

Renaissance of Bengal: রাজা রামমোহন রায় যদি সমাজের কিছু মানুষের চোখরাঙানি এবং তাঁর শুভাকাঙ্খীদের উৎকণ্ঠা উপেক্ষা না করতে পারতেন তাহলে কী হতো?

"যদির কথা নদীতে" বলে বাংলায় এক পরিচিত প্রবাদ রয়েছে। বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা যেভাবে ঘটেছে সেভাবে না ঘটে আমাদের কল্পনায় অন্য কোনওভাবে ঘটলে ঠিক কী হতো? উত্তরে বলাই যায়, বাস্তবের বদলে কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই বরং বাস্তব নিয়ে আলোচনা করলেই কিঞ্চিৎ লাভ হতে পারে। অর্থাৎ, সোজা হিসেবে প্রবাদের ভাষায়, যদির কথা নদীতে। কিন্তু কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে সত্যিই কি কোনও লাভ নেই? বহুক্ষেত্রেই কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে আমরা বাস্তবে অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে রাখা ইতিহাসের গুরুত্ব বুঝতে পারি। এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে বাংলার নবজাগরণের সময়কাল। যদি গ্রাম থেকে আসা শিক্ষিত বুদ্ধিমান ছাত্র পরবর্তীকালে কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে সমাজ সংস্কারের পথে না নামতেন তাহলে কি বিধবা বিবাহ আইন পাস হতো? যদি এক সরকারি কর্মচারী নিজের কাজের মধ্যে সুযোগ পেয়ে নাটক না লিখতেন তাহলে কি এক আইরিশ পাদ্রিকে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হতো? যদি এক উচ্চাকাঙ্খী বাঙালি খ্রিস্টান নিজের প্রাথমিক লক্ষ্যে পৌঁছে যেতেন তাহলে কি বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের আবির্ভাব ঘটত? যদি এক ধনী পরিবারের তরুণ সেই সময়ের বাবুদের পরিচিত আমোদ প্রমোদে গা ভাসিয়ে দিতেন তাহলে কে সেই সময়ের চোখে দেখা ইতিহাস লিখত?

২০২১ সালে আমেরিকায় প্রকাশিত মার্ভেল ধারাবাহিক কমিকসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল হোয়াট ইফ? হোয়াট ইফ একটি অ্যানিমেটেড ধারাবাহিক যেখানে মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখানো হয়েছিল, যদি মার্ভেলের চলচ্চিত্রগুলোর মূল ঘটনা অন্য কোনওভাবে সংঘটিত হতো তাহলে কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো? প্রধান ঘটনা থেকে এই নতুন ঘটনাগুলো অনেকটাই ভিন্ন এবং বিভিন্ন চরিত্রের নতুন ভূমিকা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ধারাবাহিকটি মানুষের মধ্যে ভালোই সাড়া ফেলেছিল। তাই ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন আসে। যদি বাংলার নবজাগরণের বিভিন্ন চরিত্র নিজেদের ভূমিকা পালন না করতেন না অথবা অন্যভাবে পালন করতেন তাহলে ঠিক কী ঘটত? এই প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, কাল্পনিক ইতিহাস নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলে অবশ্যই দেখা যাবে 'বাটারফ্লাই এফেক্ট'! কী এই প্রজাপতি প্রভাব? বাটারফ্লাই এফেক্ট অনুযায়ী বর্তমান সময়ে ঘটে চলা কোনও নগণ্য ঘটনা ভবিষ্যতের ঘটনার উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বাঙালির ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনার ছড়াছড়ি যে ঘটনা পরবর্তীকালের বহুকিছুর পট পরিবর্তন করেছে। তাই বাটারফ্লাই এফেক্টের নিয়ম অনুসারে আমরা যদি অতীতের কোনও বাস্তব ঘটনাকে সামান্য বদল করি তাহলেও অন্যান্য ঘটনার উপর তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল দেখতে পাব।

বাংলার নবজাগরণের কথা তার পথিকৃৎকে সঙ্গে করেই শুরু করা করা যাক। রাজা রামমোহন রায়, সতীদাহ প্রথার মতো এক নৃশংস প্রথা বিলুপ্তির কাণ্ডারী। এইবার কল্পনার জগতে যাওয়া যাক। ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান রামমোহন রায়। পিতৃদত্ত সম্পত্তির সঙ্গে সুদের ব্যবসা, জমিদারি থেকে তাঁর যা আয় হয় সেই থেকে আমোদ প্রমোদে তিনি দিন কাটাতে পারেন। রামমোহন শুধু বিত্তবান নয়, তিনি যথেষ্ট শিক্ষাও অর্জন করেছেন। এছাড়া সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, ইংরেজির মতো ভাষা গড়গড় করে বলে তিনি সকলকে তাক লাগিয়ে দিতে পারেন। শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মনে সমাজের প্রচলিত কিছু রীতি নীতির প্রতি বিরাগ জন্মেছে। সেই রীতিগুলোর মধ্যেই অন্যতম হলো সতীদাহ প্রথা। তিনি এই প্রথাকে তীব্র অপছন্দ করেন এবং সুযোগ পেলেই মৌখিক বিরোধিতা করেন। যদিও তাঁর শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে প্রকাশ্যে সতীদাহ প্রথার সমালোচনা করতে নিষেধই করেছেন। মূর্খ মানুষ তাঁর কথা বুঝবে না, যারা সতীদাহে উৎসাহ জোগান সেইসব স্বনিয়োজিত ধর্ম এবং সমাজের প্রহরীরা তাঁকে শত্রু বলে মনে করবে এবং যারা মনে মনে আসলে সতীদাহের বিরুদ্ধে তারাও সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করে রামমোহন বিপদে পড়লে পাশে হয়তো দাঁড়াবে না। ক্রমাগত এই ধরনের বক্তব্য রামমোহনের প্রাণহানির আশঙ্কাও বাড়াতে পারে। রামমোহন এইসব পরামর্শ শুনে চুপ করে থাকেন। মানসিকভাবে বিমর্ষ হয়ে পড়লেও মুখে কিছু প্রকাশ করেন না।

আরও পড়ুন-নির্লিপ্ত মুখে চিতায় ঝাঁপ, বাংলার শেষ সতীদাহের ঘটনা অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবে 

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর ইংরেজ কোম্পানির হস্তক্ষেপের প্রকাশ্যে সমালোচনা করে তিনি কোম্পানির বিরাগভাজন হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁর স্বজাতিকে উস্কে দিলে আরও ক্ষতি হতে পারে। তিনি ভাবেন, ঘরে বাইরে একইসঙ্গে লড়াই শুরু করা তাঁর পক্ষে উচিত নাকি অনুচিত? যদিও এইসবের মাঝেই তিনি নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলেন, সময় এলেই হয়তো উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে পারবেন। হিন্দু ধর্মের কিছু রীতিনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেই নিয়ম বাদ দিয়ে এক নতুন পথ অথবা ধর্মের সূচনা করবেন বলে ঠিক করেন রামমোহন। পারিপার্শ্বিক সমাজের মানসিকতা বুঝতে তিনি একটি সভা আয়োজনে উদ্যোগী হলেন। বিভিন্ন তর্ক বিতর্কের মাঝে তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন যে মানুষ কি তাঁর মতোই সমাজের কিছু প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে? আলোচনার মাধ্যমে তিনি বুঝলেন, অনেকেই এই প্রথাকে পুণ্য অর্জনের মাধ্যম হিসাবে দেখে। যারা সতীদাহকে ভালো চোখে দেখে না তারা সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে চুপ করে থাকে। হিন্দুধর্মের অনৈতিক নিয়মের বিরুদ্ধে এই সভায় কথা বলার কারণে কিছু মানুষ তাঁকে সমগ্র হিন্দুধর্মের বিরোধী বলে দাগিয়ে দিল। তাঁর নতুন পন্থার সূচনা তিনি কিছুদিনের জন্য মুলতুবি রাখলেন।

নিজের আইন সম্পর্কে জ্ঞান এবং ইংরেজদের সঙ্গে কাজের সূত্রে তাঁর যে আলাপচারিতা ছিল তা থেকে তিনি বুঝলেন, ইংরেজদের আইনের মাধ্যমেই একমাত্র সতীদাহ প্রথার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায়। সেই বিষয়ে কলকাতায় বিশদে আলোচনা করার পরে আইনি সাহায্য পাওয়ার চেষ্টায় তিনি বিলেতে যাত্রা করলেন। ১৮৩৩ সালে ব্রিস্টলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। চারিদিকে রব উঠল, কালাপানি পার হওয়ার কারণেই রাজার এই পরিণতি! বড়বাজার এলাকায় থাকা ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় দেখতে পেলেন রাস্তায় খোল কর্তাল বাজিয়ে এক সতীকে তার স্বামীর সঙ্গে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাংলায় মহিলাদের এই দুর্দশা দেখে মন কেঁদে উঠল। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সতীদাহের বিরুদ্ধে আবার সবাই আগের মতোই চুপ করে গেল। ১৮৩৬ সালে জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র দাস (মাঁড়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ধর্মের স্বনিয়োজিত প্রহরী এবং সংকীর্ণমনা মানুষজন তার স্ত্রী রাসমণি দাসীকে আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন সতী হওয়াই একজন মহিলার জীবনে পুণ্যের কাজ।

এইবার একবার চোখ বুঁজে কল্পনা করার চেষ্টা করা যাক যে, বাংলার অন্যতম পুণ্যস্থান দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কোনও অস্তিত্ব নেই। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বদলে সেই জায়গায় মানুষ নিজেদের মতো ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে। হয়তো সেখানে সুদৃশ্য অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে উচ্চবিত্ত বাঙালি। জানবাজারের রাসমণি দাসীকে কিছু মানুষ তাওর দান ধ্যানের জন্য মনে রেখেছে, যদিও তিনি খুব অল্প বয়সেই সতী হয়েছিলেন। এই ঘটনার পরবর্তীকালে বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সতীদাহ প্রথা রদ হয়েছে। বিধবাদের দুর্দশা ঈশ্বরচন্দ্রকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। গদাধর চট্টোপাধ্যায় নামে এক কালীসাধকের নাম হাতে গোনা অল্প কিছু পুরনো নথিতে পাওয়া যায়। তিনি কামারপুকুরে বসবাস করতেন। তাঁর মতামতের কারণে তাঁর প্রতি অন্যান্য ব্রাহ্মণরা যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্তর কলকাতার সিমলা এলাকায় বসবাস করতেন। প্রচলিত ধ্যান ধারণার বহু জিনিসই তাঁর অপছন্দ ছিল। যদিও কর্মজীবন এবং সংসার জীবনের দায়িত্ব এড়িয়ে তিনি কোনওদিন বিদেশ যাত্রা করতে পারেননি। সমাজ সংস্কার সংক্রান্ত তাঁর চিন্তা কেবলমাত্র আত্মীয় এবং পরিবারই জানতে পেরেছিল। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল নামে এক আইরিশ শিক্ষিকা ভারতে নারী শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা করেছিলেন এবং কিছু সাহায্য আর অদম্য জেদকে সঙ্গী করে তিনি বাঙালি নারীদের শিক্ষার আলো দেখিয়ে বিদ্যাসাগরের শুরু করা কাজ অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার এই কাজের জন্য ব্রিটিশ শাসক এবং ভারতীয় জনগণ দু' পক্ষই তাঁকে বিভিন্ন সন্মানে সম্মানিত করেছিল। সতীদাহ রদের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্ম অনুপস্থিত। তাই দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যবসায় তাঁর ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগদান করলেন। দেবেন্দ্রর বুদ্ধিবলে ঠাকুর পরিবারের নানারকম ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠল। ঠাকুর বাড়ির দুর্গাপুজো কলকাতার অন্যান্য বনেদি বাড়ির পুজোকে টক্কর দিতে শুরু করল যা বর্তমান সময় অবধি তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। প্রতি বছর বহু মানুষ ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে ভিড় জমান।

আমরা শুধু ভাবলাম যে, রাজা রামমোহন রায় যদি সমাজের কিছু মানুষের চোখরাঙানি এবং তাঁর শুভাকাঙ্খীদের উৎকণ্ঠা উপেক্ষা না করতে পারতেন তাহলে কী হতো? উত্তর এল, প্রথার নামে নারী নির্যাতন চলতেই থাকতো। বিধবা বিবাহে বিদ্যাসাগরকে সাহায্যকারী জনদরদী, প্রজাবৎসল রানি রাসমণিকে আমরা পেতাম না। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, পুরী থেকে বাবুঘাট অবধি পাকা রাস্তা, বাবু ঘাটের সংস্কার সম্ভব হতো না। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরি না হলে রামকুমার অথবা গদাধর চট্টোপাধ্যায় হয়তো কামারপুকুরেই জীবন কাটাতেন। গদাধর চট্টোপাধ্যায় নিজের মতামতের কারণে সেখানকার অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কাছে পাগল বলে গণ্য হতেন। আজকের জনগণের কাছে তিনি হয়তো রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হিসাবে পরিচিতিই পেতেন না। নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে হয়তো রামকৃষ্ণ দেবের কোনওদিনই পরিচয় হতো না। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগোর সেই বিখ্যাত সভা হয়তো কোনওদিন অনুষ্ঠিত হতো না। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতেন না কারণ নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়তো শিক্ষার প্রসারে তাঁকে সাহায্য করতে পারলেও অনুপ্রাণিত করতে পারতেন না। মার্গারেটের লক্ষ্য হয়তো সিস্টার নিবেদিতার লক্ষ্যের থেকে কিছুটা আলাদা হতে পারত। ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো বৃদ্ধ বয়সে একঘেয়ে আমোদ প্রমোদ থেকে মুক্তি পেতে চাইতেন। সমাজের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনধারণের এক নতুন পন্থার কথা তিনি আমাদের জানাতেন। তাঁর সঙ্গে হয়তো শুরু হতো ব্রাহ্মধর্মের। আমাদের বাস্তব হয়তো এইরকমই হতো যদি রামমোহন রায় সতীদাহের মতো ঘৃণ্য প্রথার বিরোধিতা করে সেই প্রথা রদ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না নিয়ে সেই সময়ের বহু ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলের মতো মুখ বুঁজে চুপ করে সহ্য করতেন। শুধুমাত্র একটা মানুষের কিছু না করার পরিবর্তে আমাদের ইতিহাস এতটাই বদলে যেত!

এইবার চলে আসা যাক দ্বিতীয় পরিস্থিতির কল্পনায়। আবার চোখ বুঁজে কল্পনায় যাওয়া যাক। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টার ফলে সতীদাহ প্রথা রদ হয়েছে। সতীদাহ রদের মাত্র চার বছরের মধ্যে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করার পক্ষে আইন পাশ করানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক সেই সময়ে কলকাতার শোরগোল থেকে দূরে চলছে চাষিদের সংগ্রাম। নীলকর সাহেবদের মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারের চাবুকের আঘাতের পালটা আঘাত দেওয়ার জন্য ফুঁসছে চাষিরা। তাদের দুঃখের কথা হই হট্টগোলে চাপা পড়ে যাওয়ার কারণে কলকাতার মানুষের কানে পৌঁছয় না। সেই সময়ে ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ এক বাঙালি কর্মী কলকাতায় এলেন। তাঁর উদ্দেশ্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত চাষিদের নিয়ে একটা নাটক রচনা করবেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তখন ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি। ইংরেজিতে বহু কবিতা রচনা করার পরে তাঁর শখ হয়েছে বাংলায় কবিতা এবং নাটক লিখবেন। তাঁর পক্ষে যে বাংলা ভাষায় একইভাবে সাফল্য অর্জন সম্ভব তা তিনি সকলকে দেখিয়ে দেবেন। যদিও শখটা শুরু হয়েছিল একটা বাজি থেকে। মাইকেল শুধুমাত্র ইংরেজিতে কাব্য রচনা করতে পারেন, বন্ধুস্থানীয় এক ব্যক্তির এই উক্তি শুনেই মধুসূদন দত্ত বাংলায় কাব্য এবং নাটক রচনা শুরু করেছিলেন। তাঁর লেখা নাটকগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করার কারণেই ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ ওই বাঙালির কর্মী মধুসূদন দত্তকে নীল চাষি সংক্রান্ত নাটক লেখার প্রস্তাব দিলেন। তিনি এবং তাঁর এক বন্ধু যৌথভাবে এই নাটকটি লিখবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু সরকারের অধীনস্থ কর্মী হয়ে সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করলে অচিরেই শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে। মধুসূদন স্বাধীন কবি। বহু বছর পরে কিছুদিন সময় নিয়ে তিনি কলকাতায় ঘুরতে এসেছিলেন। যদিও কলকাতা ততদিনে তাঁর স্থায়ী বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। বহু মানুষ তাঁকে মান্য করে। তাই মধুসূদনের শাস্তি হবে না বলেই ধরা যায়। মধুসূদন সম্পূর্ণ ঘটনা এবং প্রস্তাব শুনে রাজি হলেন কিন্তু একটি শর্ত রাখলেন। সরকারি কর্মীকে আশ্বাস দিয়ে তিনি জানালেন, তিনি নীল চাষিদের অত্যাচারের ঘটনা মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন কিন্তু সেটা করবেন কাব্যের মাধ্যমে। কাব্যে কেবলমাত্র তাঁর নিজের নাম থাকবে। তার ফলে কর্মীর শাস্তির কোনও ভয় থাকবে না। একইসঙ্গে মাইকেলের পরিচিতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

যথারীতি কাব্যটি প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক ইংরেজদের বিষ নজরে পড়ল। তাদের মধ্যে একজন স্বঘোষিত মুখপাত্র মাইকেলের বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মামলা করল। যদিও মাইকেলের এই কাব্য শুধুমাত্র কিছু শিক্ষিত এবং ধনী পরিবারের ব্যক্তিদের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেল। যাদের সম্পর্কে এই কাব্য লেখা হলো তারা এই কাব্য পড়ার সুযোগই পেল না। আর্থিকভাবে সমাজের নিচু তলার মানুষ এই কাব্য সম্পর্কে কিছু কিছু কথা শুনলেও বিস্তৃত বিবরণ জানতে পারল না। বাংলার ধনীদের মধ্যে অনেকেই মধুসূদনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। মধুসূদন দত্তের পক্ষে থাকা মানুষদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তির নাম কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর আয়োজিত সভায় তিনি মধুকবিকে সম্মানিত করেছিলেন। বিপদে মধুসূদনের পাশে দাঁড়ানো নিজের কর্তব্য মনে করলেন। বাংলার ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত এই মামলার রায়ে মধুসূদন দত্তকে কারাদণ্ড এবং জরিমানা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলো। জরিমানার টাকা জোগাড় হলেও কারাদণ্ড কিছুতেই এড়ানো গেল না। কারাবাস ভোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে মধুকবির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। পরিবার, বন্ধুদের উপদেশ শুনে তিনি দক্ষিণ ভারতে ফিরে গেলেন। কলকাতার কাছে তাঁর স্মৃতি হিসাবে রয়ে গেল কিছু বিখ্যাত নাটক, কাব্য, এক বিতর্কিত মামলা এবং সিগারেটের ছাই ও মদের বোতল।

আরও পড়ুন- নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার রাস্তা! জেমস লং সরণির নামকরণ হয়েছিল কার নামে?

এইবার চোখ খুলে বাস্তব ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক কী কী বাদ পড়ল? কল্পনার জগতে নীলদর্পণের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র শুধু একজন উদ্বিগ্ন সরকারি কর্মী হয়েই থেকে গেলেন। সেই কারণেই স্কুলের পাঠ্যবই থেকেও তাঁরা বাদ পড়লেন। নীলদর্পণ নাটক হিসাবে প্রকাশ না পাওয়ার কারণে সেই নাটক দেখতে গিয়ে উডের চরিত্রের অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির দিকে বিদ্যাসাগরের জুতো ছুঁড়ে মারার ঘটনা ঘটল না। নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদের সম্পাদনা করার এবং নীলদর্পণের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিদের নাম গোপন রাখার দায়ে আইরিশ পাদ্রি জেমস লংকে কারাদণ্ডের আদেশ শুনতে হলো না। জেমস লং শুধু দেশিয় মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এক পাদ্রি হিসাবে ইতিহাসের পাতার এক ছোট্ট কোণে স্থান পেলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে কলকাতার একটি রাস্তার নাম তাঁর নাম অনুসারে দেওয়া হলো না। শুধুমাত্র রচয়িতা এবং রচনার ধরন পরিবর্তনের ফলে দু'টি মানুষের গুরুত্ব কল্পনার ইতিহাসে প্রায় থাকলই না। বিদ্যাসাগর এবং অর্ধেন্দুশেখরের ঘটনা মানুষের মুখে ছড়িয়ে পড়ল না।

বাঙালি ইতিহাসবিমুখ নাকি ইতিহাস খুঁজে মরা নাগরিক তা নিয়ে দিস্তে দিস্তে প্রবন্ধ রয়েছে। তবে সেই ইতিহাসের চরিত্ররা যদি ঠিক সেভাবেই আচরণ না করতেন যেমনটা আমরা জেনেছি, পড়েছি তাহলে কী হতো সেই ভাবনা আমাদের অস্থির করে দেবেই। বিদ্যাসাগর যদি সমস্ত চেষ্টা ছেড়ে দিতেন, এতকাল পরে এই লেখাটি লেখার বা পড়ার জায়গাও আসত কিনা বলা দুষ্কর। কোনও কাজ করে কী লাভ হবে অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে কী লাভ হবে সেই প্রশ্ন করার আগে এই কল্পনা আমাদের থামাক, আমাদের প্রশ্নকে অন্যভাবে সাজাতে শেখাক। সমাজের এমনকী নিজের জীবনে বড় পরিবর্তন ঘটাতে গেলে তাই একবার ইতিহাসকে অন্য দূরবীনে দেখা দরকার। অভিযোগ আর হতাশার বদলে অন্য পথ খোঁজার পন্থা হতে পারে এই নয়া ইতিহাস দর্শন। সামান্য একজন চরিত্র যদি হাল ছেড়ে দিতেন তাহলে কী হতো? যদির সব প্রশ্নই নদীতে নয়, কিছু মননেও ঢেউ তুলুক।

 
 
তথ্যঋণ : গেট বেঙ্গল, হুতোম প্যাঁচার নকশা - কালীপ্রসন্ন সিংহ, সেই সময় - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উইকিপিডিয়া
 

More Articles