আধার নিষ্ক্রিয় করা মানে নাগরিকের মৃত্যু! যে জটিলতা বাড়াতে চলেছে আরও
Adhaar Deactivation : মোদি বুঝতে পেরেছিলেন, আধার হচ্ছে এমন এক হাতিয়ার যা ব্যবহার করলে শুধু প্রশাসনিক সুবিধা হবে তাই নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকাও অনেক অনায়াস হবে।
আধার নিয়ে আঁবার আর কাটে না। যেদিন থেকে আধার আনা হয়েছিল সেদিন থেকেই অবশ্য দ্বন্দ্ব ও জটিলতা কাটেনি। তবে এবারের সমস্যাটা অভিনব। ২০০৯ সালে যখন আধার প্রকল্প এনেছিল কংগ্রেস, তখন তাদের যুক্তি ছিল, দেশের বহু মানুষের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাই তাঁদের জন্য দেশের সরকার
একটা পরিচয়পত্র দিতে চায়। হিসেব করে দেখা গিয়েছিল, দেশের ০.০৩ শতাংশ মানুষ এই আধার পাওয়ার যোগ্য। সেই সময়ে যিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, কংগ্রেসের আনা এই আধার প্রকল্পে তিনি সন্তুষ্ট নন। মোদি বুঝতে পেরেছিলেন, আধার হচ্ছে এমন এক হাতিয়ার যা ব্যবহার করলে শুধু প্রশাসনিক সুবিধা হবে তাই নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকাও অনেক অনায়াস হবে। এই আধারকে তিনি আইনে পরিণত করলেন। তারপরে আসতে থাকল একের পর এক নিদান, আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ভর্তুকির জন্য গ্যাসের সঙ্গে
আধার সংযোগ, রেশনের জন্য, ফোনের জন্য সংযোগ করতে হবে আধার। মানুষকে বোঝানো হলো, আগের সরকার মানুষের কাছে সরকারি সুযোগ সুবিধা পৌঁছতে পারেনি। আধার সঠিক মানুষকে চিনে, তাঁর ব্যাঙ্কে সরকারি টাকা পৌঁছে দেবে। আঙুলের ছাপ, মুখের ছবি বা চোখের মণির ছবি (বায়োমেট্রিক্স) তুলতে তখন বিভিন্ন আধার নিবন্ধন কেন্দ্রে মানুষের সারি পড়ে যায়। এখন মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে আধারকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বায়োমেট্রিক্স মানে নিরাপদ, বোঝানো হয় মানুষকে। কিন্তু এই বায়োমেট্রিক্স কি অদ্বিতীয়? নকল করা সম্ভব নয় সত্যিই? ধরা যাক, আপনাকে আপনার পরিচিত দুই বন্ধুর ছবি দেওয়া হল। তারপর সেই ছবিগুলো আরও ১০ টা ছবির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল এবং তারপর আপনাকে বলা হল খুঁজে বার করতে। আপনি ১০ সেকেন্ডে তা বের করে দেবেন। তারপর ওই ছবি দুটো ১০০ ছবির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল, আপনার খুঁজে বের করতে ধরা যাক ১০ মিনিট লাগবে এবার। একইরকমভাবে যদি ছবি দুটো ১ লক্ষ ছবির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় আপনি খুঁজে পাবেন তো? এই অনুশীলনটাকে বলে মানুষের ছবি মেলানো এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া। বায়োমেট্রিক্স দিয়ে চেনাটাও এইরকমই একটা পদ্ধতি। কম্পিউটার বায়োমেট্রিক্স দিয়ে মেলানোর চেষ্টা করে। সে আসলে ছবির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে। চোখের মণি, হাতের ছাপ বোঝার চেষ্টা করে, একটা পর্যায় অবধি পারলেও তারপর সে-ও ব্যর্থ হয়। এটা একটা সম্ভাবনা মাত্র। সম্ভাবনার ফল সঠিক হতেও পারে আবার ভুল ও হতে পারে। যদি ভুল হয় তাহলে কি সেই মানুষটির কোনও অস্তিত্বই থাকে না?
আরও পড়ুন- আধারের পরে এবার ‘অপার’! কেন দেশের পড়ুয়াদের তথ্য পেতে মরিয়া কেন্দ্র?
যখন সমস্ত ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক হয়নি, তখন কিন্তু এই ধরনের আঙুলের ছাপ দিতে হত না। রেশন থেকে জিনিস তোলা, মোবাইলের সংযোগ বা অন্যান্য যে কোনও দৈনন্দিন প্রয়োজনে আঙুলের ছাপ চাওয়া হত না। সেই সময়ে জমি, বাড়ি কেনাবেচা, রেশন থেকে চাল-ডাল-আটা তোলা সবই হয়েছে, ব্যাঙ্কের লেনদেনও। তখন তাহলে এই কাজগুলি সম্পন্ন হত কী প্রক্রিয়ায়? প্রযুক্তি নির্ভরতা যত বেড়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, তত সাধারণ মানুষ অসুবিধার
সম্মুখীন হয়েছেন। আধার নম্বর এবং হাতের ছাপ বা চোখের মণি না মিললে সেই উপভোক্তা বা গ্রাহককে কি তাহলে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে হবে?
অনেকেই বলতে পারেন, আগের ব্যবস্থাপনায় প্রচুর দুর্নীতি হচ্ছিল। সেই দুর্নীতি কি বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল না? অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই দুর্নীতি রুখতে গিয়ে এমন প্রযুক্তি আনা হল যাতে দুর্নীতিকেই মান্যতা দেওয়া হল। যে কোনও ব্যক্তি রেশনে তাঁর প্রাপ্য না পেলে বা তাঁর নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি হয়ে গেলেও কোথাও অভিযোগ অবধি জানাতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, এখন যে বিভিন্ন মানুষের আধার নিস্ক্রিয় হওয়ার চিঠি আসছে, যা নিয়ে বাংলা
তথা দেশের রাজনীতি তোলপাড়, সেইরকম কোনও ঘটনা ঘটলে কী করতে হবে, তাও কেউ জানেন না। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসছে, বহু মানুষের আধার নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। তাঁরা অতল সমুদ্রে পড়ছেন অথচ কোথায় গেলে সুরাহা পাবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
চিঠিতে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, নাগরিকত্বের শর্ত পূরণ না হওয়ার কারণে আধার নিস্ক্রিয় করা হল। এতদিন যাঁরা বলছিলেন সংসদে নাগরিকত্ব আইন আনা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে ভারতে চলে আসা মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য, তাঁরা এবার বিপাকে পড়েছেন। মাঠে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় শাসক দলের বাংলার নেতা-মন্ত্রীরা। যদিও তাঁদের তিনজন, তিন রকম বয়ান দিয়েছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়েছে। চিন্তার কোনও কারণ নেই, সবার আধার আবার চালু হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত মেইলে এবং ফোন নম্বরে যেন অভিযোগ জানানো হয়। তিনি একটি অভিযোগ জানানোর ফর্ম ছাপিয়েছেন। সেই ফর্ম ভর্তি করলেই সবার আধার নম্বর চালু হয়ে যাবে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষড়যন্ত্রই দেখতে পাচ্ছেন। শুভেন্দু বলেছেন, কোনও আধার কার্ড বাতিল হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি, ইউআইডিএআইয়ের রাঁচি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে এই চিঠি
পাঠিয়েছেন। অথচ বাস্তবে, সারা দেশে এই ধরনের চিঠি অনেকেই পেয়েছেন। ২০২০ সালেই বেঙ্গালুরুর দু’জন যুবক এই ধরনের চিঠি পান, তাঁদের শুনানির
জন্য হাজির হতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখেন, তাঁদের মতো অনেকেই এই চিঠি পেয়েছিলেন। পরে হইচই হওয়াতে তখনকার মতো ইউআইডিএআই এই চিঠি পাঠানো বন্ধ করে।
আরও পড়ুন- প্রকট এনআরসি-র আশঙ্কা! কেন জেলায় জেলায় বাতিল একাধিক আধার কার্ড?
কিন্তু বিষয়টা কী আসলে? আধার কিন্তু কোনও পরিচয়পত্র নয়। আধার একজন মানুষকে বায়োমেট্রিক্স দিয়ে চেনার উপায়। যদিও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করেই সরকারি ফতোয়া মানতে গিয়ে, বেশিরভাগ মানুষ নিজের ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ফোন নম্বর সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার যুক্ত করার অভ্যাস করে ফেলেছেন। আধার হচ্ছে এনপিআর অর্থাৎ এনআরসি-র প্রথম ধাপ। আধার যখন ২০১৫ সালে আপডেট করা হয়, তখনই
এনপিআর হয়ে গেছে। যাঁরা বলছেন এনআরসি বন্ধ করতে হবে, অসমের মতো এই রাজ্যের অসংখ্য মানুষকে বেনাগরিক বানিয়ে দেওয়া চলবে না, তাঁরা যদি আধার আইনের ২৮এ ধারাটি পড়ে দেখেন তাহলেই দেখা যাবে, আধার এবং নাগরিকত্ব বিষয়টি একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ‘ক্রোনোলজি’ বুঝিয়েছিলেন, সেদিনও নাগরিকপঞ্জীর সমর্থনেই কথা বলেছিলেন অমিত শাহ। অসমে যেভাবে এখনও নাগরিকপঞ্জীর পরে, প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের আধার নিস্ক্রিয় হয়ে আছে, বাংলা কেন, সারা দেশের যে কোনও নাগরিকের এই সমস্যা যে কোনওদিন হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রক্তকরবী নাটকে যেভাবে ৪৭ফ কিংবা ৬৯ঙ এই পরিচিতিতে খনি শ্রমিক দেখিয়েছিলেন, এও অনেকটা সেইরকম। এখান থেকেই আসল অসুবিধার সূত্রপাত। একটি মানুষকে মেরে ফেলা কঠিন কিন্তু একটি সংখ্যাকে নিস্ক্রিয় করা অত্যন্ত সহজ। এই পদ্ধতিকেই এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছিলেন- সিভিল ডেথ অথবা নাগরিক মৃত্যু। আধার নিস্ক্রিয়করণ সেই সিভিল ডেথ। আধার ব্যবস্থা বন্ধ না করতে পারলে কোনওদিনই এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার কোনও উপায় নেই।
আধারের তথ্য চুরি হওয়াই একমাত্র অসুবিধার কারণ নয়, আধার দিয়ে জালিয়াতিও হতে পারে। আধার দিয়ে যদি নজরদারি করা যায়, কোন আধার নম্বরে কোন সরকারি সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেই হিসেব পাওয়া যায়, তাহলে আধার দিয়ে নির্বাচনকেও প্রভাবিত করা সম্ভব। আধার আসলে দুর্নীতি বন্ধ করার নামে অনেক বড় এক দুর্নীতি, হয়তো নির্বাচনী বন্ডের থেকেও বড়। এই সত্য না বুঝলে বিজেপির মতো শক্তিকে নির্বাচনে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। যে প্যান কার্ড দেখিয়ে আধার পাওয়া গিয়েছিল, সেই আধারের সঙ্গে প্যান সংযুক্ত না হওয়ার কারণে মানুষজনের থেকে জরিমানা বাবদ কোটি কোটি টাকা তুলেছে সরকার। বিরোধীরা কি এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না?। যে কোনও দিন যে কোনও মানুষ এই সমস্যায় পড়তে পারেন। একজন মানুষের পরিচিতি কেন শুধু আধার দিয়ে হবে? মানুষ আর যাই হোক, কোনও সংখ্যা তো নয়।