তথ্য গুঁজে দিলেই কাজ সারা? আসলে কাকে বলে প্রবন্ধ?

What is an Essay: ইদানীং প্রবন্ধের নামে যা কিছু প্রকাশিত হয় সেগুলিকে ‘প্রবন্ধ’ বলা চলে না।

অনেকেই ভাবেন প্রবন্ধ লেখা সহজ। নানা জায়গা থেকে বিভিন্ন তথ্য সংকলন করলেই বুঝি প্রবন্ধ লেখা হলো। এজন্য প্রাবন্ধিকদের সাহিত্যিক বলার আগে পাঠকেরা দু'বার ভাবেন। এই ভাবনার মধ্যে গলদ আছে। বাংলা ভাষার পাঠকদের পরম সৌভাগ্য যে আজ থেকে দেড়শো বছর আগে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘প্রবন্ধ’ কাকে বলে তার চমৎকার সব নিদর্শন প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্কিম সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে দু'রকম প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। এক রকমের লেখাকে প্রবন্ধ না বলে আজকের ভাষায় আকাডেমিক জার্নাল-এর জন্য লেখা ‘পেপার’ও বলা চলে। তা কিন্তু নিতান্ত তথ্যের সংকলন নয়। তার মধ্যে লেখকের ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। সেই ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি সতথ্য বঙ্গদর্শনে প্রকাশ করছেন লেখক। সেখানে তথ্যের উৎস নির্দেশ করছেন। তখন উনিশ শতকে তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও ‘টিচিং ইউনিভার্সিটি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। সেটি মোটের উপর পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা মাত্র ছিল। বিস্তৃত অঞ্চল – সহজ করে বললে ব্রহ্মদেশ থেকে লাহোর পর্যন্ত – এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার অধীন হয়েছিল। পাঠ্যসূচি তৈরি করা ও নানা স্তরের পরীক্ষা নেওয়াই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘বিদ্যা উৎপাদন’ বলেছিলেন সে কাজ করত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্য শুরু হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ তথ্যনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ উৎস নির্দেশিত প্রবন্ধ ছাপত। এখনকার ভাষায়, আগেই বলেছি, এগুলিকে আকাডেমিক পেপার বলা চলে। তবে একালের পেপারের সঙ্গে সেকালের বাংলা ভাষায় লেখা এই পেপারগুলির উদ্দেশ্যগত পার্থক্য আছে। যাঁরা লিখছেন তাঁরা নিতান্ত জ্ঞানচর্চার জন্য ও স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে এগুলি লিখছিলেন। এখন উচ্চশিক্ষায় খ্যাতি-প্রতিপত্তি-অর্থ ইত্যাদির আশায় পেপার ছাপার যে চল হয়েছে তার সঙ্গে এই লেখাগুলির উদ্দেশ্যগত সাদৃশ্য একেবারেই নেই।

‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে আরেক রকম প্রবন্ধও ছাপা হত। এই প্রবন্ধগুলি চেহারা-চরিত্রে আকাডেমিক পেপারের মতো নয়। তবে অসম্ভব সুখপাঠ্য, যুক্তিনিষ্ঠ, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এই লেখাগুলি ভাষাভঙ্গিতে ও বিষয়ের উপস্থাপনায় এমন যে এগুলিকে সাহিত্য নিদর্শন বলতেই হবে। সন্দেহ নেই বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে সাহিত্যগুণসম্পন্ন প্রবন্ধ লিখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি যদি উপন্যাস, রম্যগদ্য নাও লিখতেন তাহলে এই প্রবন্ধগুলির জন্যই সাহিত্যিক বলে বিবেচিত হতেন। এই দু'রকমের লেখার নিদর্শন দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল প্রফুল্লচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাল্মীকি ও তৎসাময়িক বৃত্তান্ত’। খুবই পরিশ্রম করে লেখা। পাদটীকা কণ্টকিত এই লেখায় এখনকার মতো আকাডেমিক লেখার উৎস নির্দেশের কোনও মান্য রীতি চালু হয়নি বলে নিজস্ব উপায়ে উৎস নির্দেশ করা হয়েছিল। যেমন প্রফুল্লকুমার জর্জ গ্রোট (George Grote)-এর History of Greece বইয়ের খণ্ডগুলি প্রয়োজন মতো ব্যবহার করেছিলেন। পাদটীকায় লিখলেন ‘Grote’s Greece. Vol. I pp.494’। সংস্করণ ও প্রকাশকের উল্লেখ সেখানে নেই। তবে সে সময় সাধারণের জন্য প্রকাশিত সাময়িক পত্রে এ-জাতীয় উৎস-নির্দেশ বুঝিয়ে দেয় তাঁরা বিদ্যাচর্চার বিশেষ রীতি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত কৃষ্ণ দাস লিখিত ‘চৈতন্য’ প্রবন্ধটিকেও গবেষণা-সন্দর্ভ বলা চলে। সেখানেও পাদটীকার নানারকম ব্যবহার রয়েছে। শুধু উৎস-নির্দেশ নয় পাদটীকায় প্রাসঙ্গিক মন্তব্য যোগ করা হচ্ছে। হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য (শাস্ত্রী) রচিত ‘ভারত মহিলা’ও চমৎকার জ্ঞানদীপ্ত লেখা।

আরও পড়ুন- বিয়ের মরীচিকায় ধরা দেয়নি শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রেম

এর পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন ‘সাম্য’-র মতো প্রবন্ধ। সে প্রবন্ধের অন্তর্দৃষ্টি এতই গভীর প্রকাশভঙ্গি এমনই আকর্ষণীয় যে সেটিকে সৃষ্টিশীল রসসাহিত্য না বলে উপায় নেই। যুক্তির সঙ্গে হৃদয়ের মিশেলেই প্রকাশভঙ্গির স্বাদু সুখপাঠ্যতা তৈরি হয়েছে। একটু অংশ উদ্ধার করা যেতে পারে,

অতএব বৈষম্য সাংসারিক নিয়ম। জগতের সকল পদার্থেই বৈষম্য। মনুষ্যে মনুষ্যে প্রকৃত বৈষম্য আছে। কিন্তু যেমন প্রকৃত বৈষম্য আছে ... তেমনি অপ্রাকৃত বৈষম্য আছে। ব্রাহ্মণ শূদ্রে অপ্রাকৃত বৈষম্য। ব্রাহ্মণ বধে গুরু পাপ, -- শূদ্র বধে লঘু পাপ; ইহা প্রাকৃতিক নিয়মানুকৃত নহে। ব্রাহ্মণ অবধ্য – শূদ্র বধ্য কেন? শূদ্রই দাতা, ব্রাহ্মণই কেবল গ্রহীতা কেন? তৎপরিবর্ত্তে যাহার দিবার শক্তি আছে সেই দাতা... এ বিধি হয় নাই কেন?  

বঙ্কিমচন্দ্র এই অংশে সামাজিক বর্ণভেদের বিরোধিতা করছেন। সংক্ষিপ্ত ছোট ছোট তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাক্যগুলি পাঠকদের মনে সহজে সঞ্চারিত হচ্ছে। বঙ্কিমের মতো কলমের তো সবাই অধিকারী নন। ফলে প্রবন্ধ-সাহিত্য সৃষ্টি করার সামর্থ্য সকলের থাকে না। তবে মেধার সঙ্গে শ্রমের সংযোগ ঘটলে গবেষণা-সন্দর্ভ লেখা সম্ভব। তারও গুরুত্ব কিছু কম নয়। যিনি গবেষণা-সন্দর্ভ লিখছেন তিনি যদি প্রতিভাবান হন তাহলে প্রবন্ধ সাহিত্যও সৃজন করতে পারেন। শঙ্খ ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত আনন্দ পাবলিশার্স যে হীরক সংগ্রহ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে তাতে এমন অনেকের লেখা রয়েছে যাঁরা গবেষণা সন্দর্ভ ও স্বাধীন প্রবন্ধ দু'ক্ষেত্রেই সচল ও সফল।

আরও পড়ুন- হেঁটেছিলেন গান্ধী-সুভাষের বিপরীতে! যৌনতা নিয়ে কেন পাপবোধ ছিল না নেহরুর?

তবে ইদানীং প্রবন্ধের নামে যা কিছু প্রকাশিত হয় সেগুলিকে ‘প্রবন্ধ’ বলা চলে না। দায় পড়ে দার গ্রহের মতো অনেকেই চাকরির বাজারে উন্নতির আশায় এখন ‘আকাডেমিক পেপার’ লিখতে বসেন। সেগুলি বহুক্ষেত্রেই ভাবনাহীন, একই কথার পুনরাবৃত্তি। আগে যে সে বিষয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে সে খোঁজ করার শ্রমটুকুও সেখানে নেই। তাহলে লেখার কী দরকার! অনেকে উইকিপিডিয়ার এন্ট্রি লেখা আর বাংলা প্রবন্ধ লেখা দু-য়ের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেন। কোষগ্রন্থের জন্য কোনও একটি বিষয় নিয়ে ভাবনা-জাগানো লেখার চরিত্র কেমন হতে পারে তার আদর্শ নিদর্শন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত ভারতকোষ– এর খণ্ডগুলিতে মিলবে। ‘এক্ষণ’ পত্রিকার পাতা উল্টে-পালটে দেখা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে বঙ্কিম যে ধারা তৈরি করেছিলেন তা ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বিচিত্রা’, ‘সবুজপত্র’, ‘পরিচয়’ স্পর্শ করে একালের ‘বারোমাস’, ‘অনুষ্টুপ’ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। অশোক সেনের প্রয়াণের পর ‘বারোমাস’ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে জানি, বছরে একটি সংখ্যা প্রকাশের জন্য কী বিপুল পরিশ্রম যে সম্পাদক অশোক সেন করতেন! লেখকের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনের সূত্রে শুরু হতো প্রস্তুতি। লেখক-সম্পাদকের যৌথ পরিশ্রমে লেখাটি প্রাণ পেত। এ ঐতিহ্যও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পর্বের দান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সাময়িক পত্রের আনুকূল্যে গণপরিসরে বাংলা ভাষায় চিন্তামূলকগদ্য রচনার ধারাটি দীর্ঘদিনের – সেই ধারায় আত্মনিয়োগ করার জন্য গভীর প্রস্তুতির প্রয়োজন। 

লিখতে গেলে ভাবতে হয়, শ্রম করতে হয়। প্রবন্ধ লেখা কঠিন কাজ। গল্প-কবিতা-উপন্যাসের মতোই প্রাবন্ধিকের প্রয়োজন নিজস্ব ভাষাভঙ্গি অনুধাবন ও বিশ্লেষণের মৌলিক সামর্থ্য। তাই প্রস্তুতি না নিয়ে প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা না করাই ভালো। সকলেই যেমন কবি নন, তেমনি সকলেই প্রাবন্ধিক নন।

 

More Articles