মৎস‍্যপ্রিয় বাঙালির দুঃস্বপ্ন! ভারতে হঠাৎ লক্ষ লক্ষ মাছের মৃত্যুর নেপথ্যে কারণ কী

মাছের সংখ্যা হ্রাস পেলে, বাস্তুতন্ত্রের নিচের দিকের প্রাণী, যাদের খেয়ে মাছেরা বেঁচে থাকত, তাদের সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি পাবে, এদিকে মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে যে সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ ও পাখি, তাদের খাবারের ঘাটতি দেখা য...

চলতি বছর এপ্রিল মাসে মুম্বইয়ের মালাবার পাহাড়ি অঞ্চলের বনগঙ্গা ট্যাঙ্কে অগুনতি মাছ মারা গিয়েছিল।সরকারি হিসেব অনুযায়ী, চারটি ট্রাক লেগেছিল মৃত মাছগুলিকে সরাতে। এদিকে ঠিক একমাস আগে গুয়াহাটির দীঘলীপুখুরি ফিশারিতে শ’য়ে শ’য়ে মাছ মারা গিয়েছিল। চলতি মাসের শুরুতে রহস্যজনকভাবে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে নাজাফগড় অঞ্চলে আবারও অসংখ্য মাছের মৃত্যু হয়। এই অঞ্চলেরই নিকটবর্তী গ্রাম ঝুলিঝুলিতেও একই ঘটনা ঘটে। ঠিক এই সময়েই স্থানীয়রা জানান, পুকুর বা জলাশয় থেকে সাপ জল ছেড়ে উঠে এসে, বাড়ির ভেতর আশ্রয় নিতে শুরু করে, যা আগে কখনও ঘটেনি।

'মঙ্গাবে ইন্ডিয়া'-র তরফে অনন্যা ব্যাস ক্ষতিয়ে দেখলেন এর কারণ কী। যদিও তার আগে মৎস‍্য-বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে পরিবেশবিদরা, এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে, সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার কারণ সম্পর্কে আরও বিশদে বিবরণ দিলেন অনন্যা।

মৎস‍্য-বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা আগেই জানিয়েছিলেন, জলদূষণই এত সংখ্যায় মাছ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ডিজ়লভড অক্সিজেন বা জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের অভাবই মাছেদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। অনন্যা জানাচ্ছেন, জলে স্বল্প অক্সিজেন বা অক্সিজেনের অনুপস্থিতির মতো অবস্থা তখনই তৈরি হয়, যখন জলজ আগাছা এবং সালোকসংশ্লেষে সক্ষম ব্যাকটেরিয়া ও শ্যাওলার সংখ্যা জলে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। এদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। এবং তার পাশাপাশি জলজ প্রাণীদেরও প্রয়োজন অক্সিজেন। এত অস্বাভাবিক হারে জলজ উদ্ভিদ এবং সালোকসংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়া এবং শ্যাওলার সংখ্যা বাড়ার দরুন, তারাই জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের বেশিরভাগটা ব্যবহার করে। ফলে প্রাণীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব ঘটে।

আরও পড়ুন: বাঘের মৃতদেহকে মানুষের স্যালুট, ভালবাসার ফুল, এক অন্য মানবিকতার গল্প

এই জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সহ্যসীমা বা ডিজ়লভড অক্সিজেন টলারেন্স লেভেল ভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে ভিন্ন। ধরা যাক মাছের ক্ষেত্রে সহ্যসীমা যা, কাঁকড়া ও শামুকের ক্ষেত্রে তা আলাদা। কিন্তু এসবের পরেও যে মূল প্রশ্নগুলি থেকেই যায়, সেগুলি হলো এর সঙ্গে জলদূষণের সম্পর্ক কী? তার থেকেও বড় কথা, জলীয় আগাছা, শ্যাওলা এবং অন্যান্য সালোকসংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়ার এরকম হঠাৎ করে বেড়ে ওঠার কী কারণ? জলদূষণের সঙ্গে কি এর কোনও সম্পর্ক আছে?

জলে আবর্জনা ফেলা, নর্দমার জল গিয়ে জলাশয়ে মেশা, চাষের জমি থেকে ভেসে আসা সার, পুজোর সময় জলে অর্ঘ হিসেবে দান করা ফুল ও ফল প্রভৃতি জলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। এই জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন জলজ আগাছা, শ্যাওলা এবং বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বেড়ে ওঠার পক্ষে আদর্শ।

ভারতে জলদূষণের মূল কারণ কিন্তু জলে আবর্জনা নিক্ষেপ করা এবং নিকাশি ব্যবস্থার মাধ্যমে বেরনো দূষিত জল জলাশয়, হ্রদ বা নদীতে গিয়ে মেশা। ২০১৭ সালে রাজস্থান দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, যথেচ্ছভাবে নিকাশি-ব্যবস্থার জল হ্রদে গিয়ে মেশায় হ্রদের ডিজ়লভ অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলত, বিভিন্ন রোগসৃষ্টিকারী জীবেরও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে জলে।

বিগত কয়েক বছরেই খুব দ্রুত উন্নয়ন ঘটায় ভারতের জলভাগের উপরিতলের সত্তর শতাংশ কেবল পানের অযোগ্যই হয়ে ওঠেনি, পাশাপাশি এত বিপুল সংখ্যায় জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বনগঙ্গা ট্যাঙ্কের দূষণ এবং মাছের মারা যাওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঠিক একই ঘটনা ঘটে রাজস্থানের পুষ্কর হ্রদ বা আগ্রার যমুনা নদীর ক্ষেত্রেও ।

মঙ্গাবে ইন্ডিয়া-র সূত্রে জানা যাচ্ছে, বেঙ্গালুরুতে একাধিক হ্রদ জলজ প্রাণীর বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে ঠিক এই কারণেই। বেঙ্গালুরু-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে জলাশয়ে মাছ থেকে শুরু করে শামুক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে একাধিক রাসায়নিক পদার্থ, চাষের জমিতে ব্যবহার করা সার ও পেস্টিসাইড, এবং নালা-নর্দমার সঙ্গে ভেসে আসা জল।

জলে ডিজ়লভড অক্সিজেনের পরিমাণ যত বাড়ে, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর সেই জলে টিকে থাকার ক্ষমতা তত বাড়ে। কিন্তু কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দেওয়া রিপোর্টে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা যাচ্ছে, কর্নাটক এবং তেলেঙ্গানার অধিকাংশ জলভাগে ডিজ়লভড অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটার জলে মাত্র শূন‍্য থেকে চার মিলিগ্রাম। এত কম পরিমাণ ডিজ়লভড অক্সিজেন জলে উপস্থিত থাকলে কোনও মাছের পক্ষেই সেখানে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ভারতের ২১৫টি জলভাগের ডিজ়লভড অক্সিজেন পরীক্ষা করে দেখেন, তার মধ্যে ছিয়াত্তরটি জলভাগে প্রতি লিটার জলে ডিজ়লভড অক্সিজেনের পরিমাণ শূন‍্য থেকে চার মিলিগ্রাম। ২১৫টির মধ্যে ৭৫টি জলভাগে সেই পরিমাণ চার থেকে সাড়ে ছয় মিলিগ্রাম এবং ৬৪টি জলভাগে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে নয় মিলিগ্রাম ডিজ়লভড অক্সিজেন রয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন ভারতের জলভাগের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাতাসে বাড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে, বাতাসের কার্বন-ডাই অক্সাইড মিশছে জলে। ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইডে ভরে উঠছে ছোট থেকে বড় নদী, পুকুর, হ্রদ, এবং যে কোনও জলাধার। বাদ যাচ্ছে না ভূগর্ভের জলও। এর পাশাপাশি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল তাপমাত্রা জলজ প্রাণীদের বিশেষভাবে ক্ষতি করে। পরিবেশের তাপমাত্রা পরিবর্তন হলে, জলের তাপমাত্রাতেও বদল আসে। যার ফলে জলের নিজস্ব জৈব- রাসায়নিক পরিবর্তন কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হয় না, জলজ প্রাণীদের মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

জলের পরিবেশের জৈব ও রাসায়নিক পরিবর্তনে তাপমাত্রার পাশাপাশি জলে উপস্থিত অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই অক্সাইডও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু জলদূষণের কারণে যেহেতু অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য ক্রমাগত বিঘ্নিত হচ্ছে, তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাছেরাও। এই সংখ্যায় মাছ মারা গেলে ভারতের অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তার পাশাপাশি ক্ষতি হবে পরিবেশের এবং বাস্তুতন্ত্রের। কেবল জলের বাস্ততন্ত্রই নয়, স্থল এবং জল-স্থলের মধ্যস্থ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষায় মাছ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাছের সংখ্যা হ্রাস পেলে, বাস্তুতন্ত্রের নিচের দিকের প্রাণী, যাদের খেয়ে মাছেরা বেঁচে থাকত, তাদের সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি পাবে, এদিকে মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে যে সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ ও পাখি, তাদের খাবারের ঘাটতি দেখা যাবে।

ভারতীয় অর্থনীতির গ্রাফ এমনিতেই অধোগামী, মৎস‍্যশিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হলে আরওই ক্ষতির মুখ দেখব আমরা।

 

More Articles