"জি-স্পটটা কোন দিকে?" সঙ্গিনীকে যৌনসুখ দিতে যা খুঁজছেন, তা কি আদৌ আছে?
G-Spot: গবেষকরা জানান জি-স্পট বলে আদতে আলাদা করে কোনও জায়গাই নেই। বরং তাঁরা উল্টে ক্লিটোরাল এবং ভ্যাজাইনাল অর্গ্যাজ়মের উপস্থিতির কথা জানান।
পাঠকদের শুরুতেই সাবধান করা হচ্ছে, আপনারা সিটবেল্ট শক্ত করে বেঁধে, লম্বা শ্বাস নিয়ে, হাতের পাশে জলের গ্লাস তৈরি করে বসুন, কারণ এই প্রতিবেদনের পরতে পরতে আপনারা যা পেতে চলেছেন তাতে আপনাদের মধ্যে “এই (কালচার) গেল গেল” রব উঠতে পারে। আপনাদের ভেতরকার মরাল মাসি-মেসোরা জেগে উঠতে পারে; আবার আপনারা পড়ে চূড়ান্ত হতাশও হতে পারেন। যে আশা নিয়ে লেখাটা পড়া শুরু করছেন, আপনার সেই আশা-বিশ্বাস আমরা ভাঙতে চলেছি। অবশ্য বলা যায় না, আপনি পড়ে আনন্দও পেতে পারেন, আশার আলোও দেখতে পারেন।
শুরু করা যাক একটি মিম দিয়ে। প্রেমিক-প্রেমিকা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে। অন্তরঙ্গ হচ্ছেন দু’জনে ধীরে ধীরে। প্রেমিকা আদুরে গলায় জানতে চাইলেন, “বলো তো, লেবিয়া মেজোরাটা ঠিক কোথায়।" প্রেমিক আকাশের দিকে আঙুল তুলে রোম্যান্টিক গলায় বলে উঠলেন, “কালকে তো আকাশের ওই কোণটায় উঠেছিল।"
নাহ, সেই প্রেমিক কেন, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপও লেবিয়া মেজোরা আকাশে খুঁজে পায়নি; কারণ লেবিয়া মেজোরা আকাশে পাওয়া যায় না (আপনি কি একবার গুগলে বা নাসার ওয়েবসাইটে খুঁজলেন?)। ওটা আসলে স্ত্রী যৌনাঙ্গের বাইরের দিকের ঠোঁটের মতো অংশ। আপনি নাসার ওয়েবসাইটে পাবেন না।
তবে আজ লেবিয়া মেজোরা নয়, আমরা বেরোব জি-স্পটের সন্ধানে। কারণ জি-স্পটের ধারণা মানুষের মধ্যে গোলমেলে, বিশেষ করে জি-স্পটের অবস্থান সম্পর্কে। তবে অনেক পুরুষ মনে করেন জি-স্পট নাকি ‘ম্যাজিক বাটন’। আলাদিনের প্রদীপের মতো। তাকে খুঁজে বের করে, ঘষা দিলেই নাকি অর্গ্যাজ়মে পৌঁছনো যায় বলে মনে করেন অধিকাংশ পুরুষ।
আরও পড়ুন- হারানো যৌন উদ্দীপনা থেকে দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে পারে সাপের বিষে তৈরি ওয়াইন!
১৯৫০ সালে জার্মান ডাক্তার আর্নস্ট গ্রেফেনবার্গ “The role of urethra in female orgasm” নামে একটি সাড়া জাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানেই তিনি লেখেন, “an erotic zone always could be demonstrated on the anterios wall of the vagina along the course of the urethra”। তাঁর নামেই এই যৌন সংবেদী অঞ্চলের নাম রাখা হল গ্রেফেনবার্গ স্পট। যা পরে সংক্ষেপে হয়ে গেল জি-স্পট।
বলা হয়, জি-স্পটটি নাকি উঁচু একটি জায়গা, যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা আরও উঁচু হয়ে ওঠে। যোনির মুখ থেকে কয়েক সেন্টিমিটার ভেতরে যোনির সামনের দেওয়ালের যৌন সংবেদী অংশকেই মূলধারার মাধ্যম এতদিন যাবৎ জি-স্পট বলে এলেও, চিকিৎসাশাস্ত্রে কিন্তু জি-স্পটের উপস্থিতি এবং অবস্থান নিয়ে বিতর্ক এখনও রয়েছে, জানাচ্ছেন একাধিক গবেষক এবং ডাক্তাররা।
কসমোপলিটান ম্যাগাজি়নের সমীক্ষা বলছে, আশি শতাংশ পুরুষই মনে করেন পৃথিবীর সমস্ত মহিলার জি-স্পট নামের একটি অঙ্গ অথবা জায়গা রয়েছে। প্রথমত, জি-স্পট আদৌ কোনও আলাদা অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ নয়; যদিও সেই ভুল ধারণা অনেকের মধ্যেই রয়েছে। দ্বিতীয়ত, জি-স্পট আদৌ সব মহিলার থাকে না এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যৌন জীবনের জন্য বা যৌনসুখ পাওয়ার জন্য তা আদৌ অপরিহার্য নয়।
আশির দশক থেকেই মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং বর্তমানে কয়েক বছর যাবৎ পুঁজিপতিরা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, যৌন সুখ পাওয়ার জন্য জি-স্পট অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য একটি স্থান। আর তারপর থেকেই ‘হট কেকের’ মতো বিক্রি হয়েছে জি-স্পট কন্ডোম, জি-স্পট ডিলডো, জি-স্পট ভাইব্রেটর এবং অন্যান্য সেক্স টয়। এখানেই শেষ নয়, বিশাল সংখ্যক মহিলা, যারা এরকম কোনও জায়গা নিজেদের যোনির ভেতরে খুঁজে পাননি, তাঁদের অনেকেই চূড়ান্ত হতাশা এবং অবসাদে ভোগা আরম্ভ করেছেন। নিজেদের অসম্পূর্ণ এবং অস্বাভাবিক ভাবতে আরম্ভ করেছেন।
তাহলে জি-স্পট কি সত্যিই আছে?
গ্রেফেনবার্গের সাড়া জাগানো সেই প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক তিরিশ বছর বাদে অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে “আর্কাইভ অব সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার” নামের জার্নালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, সেই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মহিলাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশেরই যোনিকে উদ্দীপিত করলে অর্গ্যাজ়মের মতো অনুভূতি আসছে। কিন্তু পাঠকের সব আশায় জল ঢেলে আমরা জানাতে বাধ্য হচ্ছি, তার পরেও গবেষকরা জানান জি-স্পট বলে আদতে আলাদা করে কোনও জায়গাই নেই। বরং তাঁরা উল্টে ক্লিটোরাল এবং ভ্যাজাইনাল অর্গ্যাজ়মের উপস্থিতির কথা জানান।
আবার এই গবেষণায় যে মহিলারা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ জানান, তাঁরা এই অনুভূতি যোনির পেছনের দিকের দেওয়ালে পেয়েছেন। অর্থাৎ যেদিকে মলাশয় রয়েছে। অন্যদিকে, ৭৪ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁরা যৌন অনুভূতি যোনির সামনের দিকের দেওয়ালে পাচ্ছেন।
১৯৮৬ তে ইজ়রায়েলের একটি গবেষণাতেও মহিলাদের শরীরে জি-স্পট বলে আলাদা কোনও ‘স্পট’ বা জায়গা পাওয়া যায়নি। ২০০৩ সালে মিশরীয় মহিলাদের ওপর করা হয় একটি গবেষণা। যোনির ভেতরে একটি অঞ্চলজুড়ে, তড়িতের খেলা দেখতে পান গবেষকরা। সেখানে তড়িতের খেলা বোঝার হাতিয়ার ইলেক্ট্রোভ্যাজিনোগ্রাম। যৌনসুখ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তড়িতের খেলা বাড়তে থাকে সেই অংশে। তবে এখানেও গবেষকরা আলাদা করে জি-স্পটের সন্ধান পাননি।
‘স্পট’ বললে শুরুতেই ছোট্ট, সীমাবদ্ধ অংশের কথা মাথায় আসে। গবেষকরা উলটে বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে এই ‘প্লেজা়র এরিয়া’র সন্ধান পান। শুধু তাই নয়, কোনও উঁচু জায়গাও যোনির ভেতরে পাওয়া যায়নি বলে জানান গবেষকরা।
আরও পড়ুন- দেবতার যৌনতাকে বস্ত্রে ঢেকেছে মানুষ, শ্লীল অশ্লীলের বেড়া ভেঙেছেন রহস্যময়ী লজ্জা গৌরী
২০০৯ সালের মিশরীয় মহিলাদের উপর আরেকটি গবেষণা হয়, সেখানে কিন্তু হিস্টোলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যেমে সাতচল্লিশ শতাংশ মহিলার শরীরে জি-স্পটের সন্ধান পাওয়া যায় এবং অ্যানাটমিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় সাতষট্টি শতাংশ মহিলাদের শরীরে জি-স্পটের সন্ধান পাওয়া যায়।
২০১০ সালে “জার্নাল অব সেক্সুয়াল মেডিসিন”-এ প্রকাশিত গবেষণায় জি-স্পটের বদলে ‘ইউরেথ্রোভ্যাজাইনাল স্পেস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সোজা কথায়, সেই ‘আনন্দের স্থান’ বা ‘প্লেজা়র স্পট’ কোনও ছোট্ট বিন্দু বা দলার মতো জায়গা নয়। বলা যেতে পারে এটি একটি অঞ্চল। ঠিক একই বছর একই জার্নালে আরেক দল গবেষক একটি ভিন্ন গবেষণায় ‘ক্লিটো-ইউরেথ্রোভ্যাজাইনাল কমপ্লেক্স’ শব্দটির উল্লেখ করেন। হ্যাঁ, স্পট নয়। কমপ্লেক্স! যোনি ছাড়াও ক্লিটোরিস (যা থাকে যোনির বাইরে, মূত্রছিদ্রের উপরে) এবং মূত্রনালির কিছু অংশ যৌনসুখ পাওয়া এবং অর্গ্যাজ়মের সঙ্গে যুক্ত। অনেক মহিলাই জানাচ্ছেন, তাঁদের ক্লিটোরিসকে উদ্দীপ্ত করলে যোনির ভেতরের বেশ কিছু অংশ উদ্দীপ্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে ২০১৬-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এমআরআইয়ের সাহায্যে জি-স্পটের সন্ধান পান গবেষকরা। সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন কিছু মহিলা। ২০২১ সালে ‘এলসিভিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে গবেষকরা লিখেছেন, নারীদের যৌনতা আদতে খুবই জটিল এবং আকর্ষণীয় একটি জিনিস। তার কারণ এটি কোনও বেঁধে দেওয়া সূত্রে চলে না। নারীর ‘প্লেজা়র পয়েন্ট’ তাঁর শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, হরমোনাল, এমনকী, সংস্কৃতি এবং ধর্মের নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন হয়। এমনকি দেখা গেছে যমজ বোনেরও ‘প্লেজা়র পয়েন্ট’ আলাদা।
জি-স্পট সত্যিই রয়েছে কিনা তার উত্তর গবেষকরা আজও পাননি। যদি আমরা তাত্ত্বিক ভাবেও মেনে নিই যে জি-স্পট রয়েছে, সেক্ষেত্রে তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই এবং তা কোথায় রয়েছে, সে নিয়েও উত্তর দেওয়ার জায়গায় গবেষকরা নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে জি-স্পটের (যদি ধরে নিই তা আছে) অ্যানাটমি যে অজানা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এমিলির নাগোস্কি তাঁর বই “Come as you are: The Surprising New Science that Will Transform Your Sex Life” বইতে লিখছেন, “If it feels good, you’re doing it right”. গ্রেফেনবার্গ আবার সেই সাড়া জাগানো প্রতিবেদনেই লিখেছিলেন, “we can almost say that there is no part of the female body which does not give sexual response, the partner has only to find the erotogenic zones”।
এরপরে আপনাকে কী করতে হবে আপনি তো জানেনই।