সামান্য তথ্য জানতে বারবার গুগল ঘাঁটছেন? অজান্তে আপনিও এই বিশেষ রোগের ফাঁদে পড়ছেন
Google Effect Digital Amnesia : পানিপথের যুদ্ধ থেকে কোনও দেশের রাজধানী – হঠাৎ প্রশ্ন করলে অনেকেই হয়তো উত্তর দিতে পারবেন না। ছুটতে হবে গুগলে।
ধরুন, কোনও একটা বই পড়ছেন, কিংবা ভিডিওয়, সিনেমায় বিশেষ কোনও ঘটনার কথা উল্লেখ পেলেন। অথবা নিজের পড়াশোনার কাজে বিশেষ কোনও বিষয় সামনে এল। কিন্তু ব্যাপারটি কী, কিছুতেই মনে পড়ছে না। চিন্তায় চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার জোগাড়। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না সেই বিশেষ জিনিসটি এর আগে কোথায় পড়েছেন। কিংবা অমুক নায়িকা আর কোন সিনেমায় কাজ করেছেন, পেটে আসলেও মুখে আর আসছে না। বাধ্য হয়ে শেষমেশ একটাই ভরসা, গুগল।
অগুনতি মানুষ প্রতিদিন এই সার্চ ইঞ্জিনে ঘোরাফেরা করেন। তথ্যের ভাণ্ডারে নিজেকে বিলিয়ে দেন। রথ দেখা থেকে কলা বেচা – সমস্ত কাজেই গোটা বিশ্বের আম জনতার একটাই আশ্রয়, গুগল। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর এমন প্রভাব যে, ২০০৬ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ক্রিয়াপদ হিসেবে জায়গা করে নেয় ‘গুগল’ শব্দটি। অফিসের কাজ হোক বা নিজস্ব পড়াশোনা, ইন্টারনেট আর গুগল এখন সমস্ত মানুষেরই ভরসার জায়গা।
কিন্তু সেই ভরসাই যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়। মানে ধরুন, যখন তখন ইন্টারনেটের পর্দায় সেঁটে রয়েছে আপনার চোখ। সামান্য একটু কিছু মনে হলেই ছুটে চলে যাচ্ছেন কম্পিউটারে কিংবা মোবাইলে। কোটি কোটি তথ্য ঘেঁটে খুঁজে নেওয়া নতুন কোনও তথ্য – এটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে? ঠিক এখানেই সাবধান করছেন ডাক্তাররা। কারণ, অজান্তেই ‘গুগল এফেক্ট’-এর ফাঁদে পা দিচ্ছেন আপনি। একটু একটু করে এই রোগ কুরে কুরে খাচ্ছে আপনাকে, অথচ বুঝতেও পারছেন না। ডিজিটাল অ্যামনেশিয়াও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অতিরিক্ত টেক স্যাভি হয়ে উঠতে গিয়ে আখেরে নিজের বিপদই ডেকে আনছে মানুষ, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন : সবটুকু শুষে নিচ্ছে স্মার্টফোন, শান্তি ফেরাতে গোটা বিশ্ব ফিরছে সেই পুরনোয়…
কিন্তু কী এই ‘গুগল এফেক্ট’? ‘ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া’-ই বা কী?
ইন্টারনেট, প্রযুক্তির বিপ্লব, গুগলের আগমন – এসব তো সময়ের সাপেক্ষে খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ইন্টারনেট আসার আগেও মানুষ বিভিন্ন বই পড়ত। লাইব্রেরিতে ভিড় লেগে থাকত। সেই সমস্ত বইপত্র, খবরের কাগজ ঘেঁটেই বিভিন্ন তথ্য মনে রাখত মানুষ। খুব প্রয়োজনীয়, দরকারি তথ্য হলে খাতায় লিখে রাখত। কিন্তু স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার একটা সহজাত প্রচেষ্টা ছিল। একটা প্র্যাকটিস ছিল। ছোটবেলায় মুখস্ত করে যে জিনিস পরীক্ষার খাতায় লিখে আসতেন, সেটা বহুদিন অবধিই মনে থাকত।
এখন গোটা পরিস্থিতিটাই বদলেছে। হাতের সামনে রয়েছে মোবাইল, স্মার্টফোন। কম্পিউটার, ল্যাপটপে কাজ সারছেন। দিনের অধিকাংশ সময়ই ইন্টারনেটের সামনে বসে আছে অনেকে। একটু কিছু মনে হলেই আমাদের একটাই জিনিস মাথায় আসে ‘একটু গুগল করে নিই’। নেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় আমাদের স্মৃতিতে ধরে রাখার সেই সহজাত প্রচেষ্টাটাই আর নেই। একটু একটু করে সেই জায়গাটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। পানিপথের যুদ্ধ থেকে কোনও দেশের রাজধানী – হঠাৎ প্রশ্ন করলে অনেকেই হয়তো উত্তর দিতে পারবেন না। ছুটতে হবে গুগলে।
ঠিক এখানেই সমস্যা। ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা বারবার সামান্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গুগলের দ্বারস্থ হই। অথচ আগে এই উত্তরই দিব্যি মনে থাকত! এই জিনিসটার নামই হল ‘গুগল এফেক্ট’। ডাক্তারি পরিভাষায় তারই নাম ‘ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া’। অর্থাৎ, ডিজিটাল মাধ্যমের গ্রাসে আমাদের স্মৃতিশক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এখানে বয়স কোনও বাধা মানছে না। জার্মানি ও বার্মিংহামের গবেষকরা বলছেন, কম বয়সিদের মধ্যেই এই ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া বা ‘গুগল এফেক্ট’-এর ক্ষতিকর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন : সুতোয় ঝুলছে চাকরি, ChatGPT-এআইয়ের ধাক্কায় কাজ হারিয়ে পথে বসতে পারেন আপনিও!
কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
কেবল গুগল নয়, সার্বিকভাবে স্মার্টফোনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাই এর জন্য দায়ী। সামান্য তথ্য, যা খুব সহজেই মনে রাখতে পারতেন, সেটাও আপনাকে মোবাইলের স্ক্রিনে লিখে রাখতে হচ্ছে। কিংবা নেট ঘেঁটে জেনে নিতে হচ্ছে। সামান্য যোগ, বিয়োগ, গুণ – এজতা মুখে মুখে করতে পারতেন, সেটার জন্য ফোনের ক্যালকুলেটর বের করতে হচ্ছে। কিংবা ভাবুন, আপনি ঘড়ি পরে রাস্তায় বেরিয়েছেন। কিন্তু অভ্যাসবশত স্মার্টফোন বের করে সময় দেখছেন। বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বর মনে রাখতে পারছেন না।
এসবই একটু একটু করে মস্তিস্কের কোষে প্রভাব ফেলে। স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে আসতে থাকে। পাশাপাশি কমতে থাকে ঘুমও। গভীর ঘুমের সময় মস্তিস্ক নিজেকে নতুন করে তৈরি করে। ফলে মানুষ অনেক বেশি সতেজ, কর্মক্ষম থাকে। স্মার্টফোন, গুগল, ইন্টারনেট সেই কাজে ভয়ানকভাবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ‘সাইন্যাপটিক প্রুনিং’-এর কোনও কাজই হচ্ছে না। ফলে মস্তিস্কও নিজেকে রিচার্জ করতে পারছে না। ২০১১ সালে প্রথমবার সামনে আসে এই ‘গুগল এফেক্ট’ ও ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া। তারপর থেকে যত দিন গিয়েছে, এই সমস্যা বেড়েই চলেছে।
আরও পড়ুন : জন্মই হতো না মোবাইল, কম্পিউটারের! যে জাদু লুকিয়ে আছে ছোট্ট মেশিনে
মুক্তির উপায়?
১) প্রথমত ও প্রধানত, অতিরিক্ত ইন্টারনেট নির্ভরতা কমিয়ে ফেলা। মানুষের স্মৃতিশক্তি অনেক বেশি প্রখর। সে অনেক কিছু ধারণ করতে পারে। তাই তার কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে না দিয়ে তাকে আরও পুষ্ট করুন। কাজের সূত্রে কিংবা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য ইন্টারনেট অবশ্যই ভালো জিনিস। তারপর সেটি নিজের মাথায় রাখুন। দরকারে খাতায় লিখে রাখুন।
২) ইন্টারনেট বা ডিজিটাল লাইব্রেরি নয়, বই পড়া অভ্যাস করুন। আগে যেমন লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারতেন, সেটাই করুন। কেবল পড়ে যাওয়া নয়, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিখে নিয়ে আসুন। এসব ক্ষেত্রে একেবারেই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হবেন না। এমন অভ্যাস করুন, যাতে একবার জেনে নেওয়ার পর দ্বিতীয়বার ইন্টারনেটের দ্বারস্থ যেন না হতে হয়।
৩) হাজার ব্যস্ততা থাকলেও, ঘুম জরুরি। ঘুমোতে যাওয়ার আগে কখনই স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না।
৪) সপ্তাহে অন্তত একটা দিন নিএজ্র জন্য রাখুন। সেখানে কোনও ইন্টারনেট, অনলাইন সিনেমা, গুগল কিচ্ছু থাকবে না। সেই সময় ঘুরতে যান, দরকারে বই পড়ুন। কিন্তু ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকুন ওইটুকু সময়।
৫) শারীরিক কসরত অত্যন্ত জরুরি। ঘুম আর শরীরচর্চা – এই দুটো জিনিস অবশ্যই জীবনের খাতায় রাখুন। সঙ্গে পর্যাপ্ত, স্বাস্থ্যকর খাবার খান।