১৫ লক্ষ মানুষ সেঁধিয়ে গেছেন নিজের ঘরে! যে বিরল রোগ গিলে খাচ্ছে জাপানকে

Hikikomori Japanese Social Withdrawal: হিকিকোমোরিরা এতটাই সমাজবিচ্ছিন্ন, সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন যে তারা কোনওদিনই আর পরিবার গড়া, সন্তানের জন্ম এসবের দিকে যাবেন না।

জাপানের মানুষদের জীবনধারা বিশ্বের অনেকের কাছেই অনুকরণীয়। জাপানের মানুষদের দীর্ঘ জীবন, সুস্থ জীবন, নিয়মানুবর্তিতা, শান্ত-নম্র কর্মমুখী জীবনের মন্ত্র জানতে চান অনেকেই। সেই জাপানেই এখন তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ছে এক বিরল রোগ। সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন মানুষরা। সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক সম্পর্ক সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, একা করে রাখছেন মানুষ। জাপান জুড়ে হু হু করে বাড়ছে এই প্রবণতা। রোগের নাম হিকিকোমোরি। জাপানের সরকারের একটি সমীক্ষা বলছে সামাজিক প্রত্যাহারের এই ঘটনায় জাপানে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কর্মক্ষম বয়সি মানুষ সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করছেন। জাপানের মন্ত্রিপরিষদ গত নভেম্বরে জাপান জুড়ে ১০ থেকে ৬৯ বছর বয়সের ৩০,০০০ মানুষের উপর সমীক্ষা করে এবং দেখা যায়, হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত ১৫-৬২ বছর বয়সি মানুষের হার ২%। আর এই মানুষরা প্রায় ২০% ক্ষেত্রেই কোভিড মহামারীকেই দায়ী করেছেন।

মন্ত্রিপরিষদ জানিয়েছে, বিপুল সংখ্যক হিকিকোমোরিরা জানিয়েছেন তারা সম্পর্কের সমস্যার কারণে বা চাকরি চলে যাওয়ার পরে সমাজের মূলধারা থেকে নিজেদের ক্রমে সরিয়ে নিচ্ছেন। ৪০-৬৪ বছর বয়সের মানুষদের মধ্যে, ৪৪.৫% বলছেন চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকেই তাঁদের এই আচরণ শুরু হয়েছে। ২০.৬% মানুষ কোভিড মহামারীকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এভাবে সমাজের মূলস্রোত থেকে নিজেকে সরিয়ে একাকীত্বে ডুবে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপও করেছে। টোকিওর এডোগাওয়া ওয়ার্ডে হিকিকোমোরিদের জন্য জুন মাস থেকে মেটাভার্স সামাজিকীকরণের একটি অনুষ্ঠান ঘটাতে চলেছে। ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা বলছে এই ওয়ার্ডটিতে ৯,০০০ জনেরও বেশি মানুষের বাস। এই মানুষদের মধ্যে এমন পড়ুয়ারা আছেন যারা ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা সকলেই নিজেদেরকে হিকিকোমোরি বলে ডাকেন।

আরও পড়ুন- বিশ্বের ‘অশ্লীলতম’ উৎসব! জাপানের এই পুরুষাঙ্গের মিছিল কেন এত জনপ্রিয়?

হিকিকোমোরি আসলে কী?

হিকিকোমোরি আসলে সামাজিক প্রত্যাহারের একটি ঘটনা, জাপান জুড়ে যা হু হু করে বাড়ছে। এই শব্দটি সাধারণত অল্পবয়সীদেরই বোঝায়। এই মানুষরা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে সরে আসে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য, কখনও কখনও বছরের পর বছর ধরে নিজেদের বাড়িতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে। হিকিকোমোরি উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং সামাজিক ভীতির মতো অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ শিক্ষাগত প্রত্যাশা, তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সহ আধুনিক সমাজের বিবিধ চাপের ফলই এই হিকিকোমোরি।

বলাই বাহুল্য এই হিকিকোমোরির প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু যারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখছেন সমাজ থেকে তাঁদের জন্যই নয়, সার্বিকভাবে সমাজের জন্যই। যারা এই হিকিকোমোরি অনুভব করছেন তাদের পরিণতি বিধ্বংসী হতে পারে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ সহ আরও নানা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এই মানুষরা আর কোনও দিনও সমাজের মূলস্রোতে নাও ফিরতে পারেন। হিকিকোমোরি কোনও ব্যক্তির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। জীবনে আর কোনওদিনই কোনও চাকরি বা কাজ করা, সম্পর্কে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে তাঁদের।

আরও পড়ুন- ‘সা রে গা মা পা ধা নি, বোম ফেলেছে জাপানি’, কী ঘটেছিল ৭৮ বছর আগের সেই দিনটায়

হিকিকোমোরি সমাজেও বিস্তৃত প্রভাব ফেলবে। জাপানে হিকিকোমোরিকে বৃহত্তর সামাজিক সমস্যার লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রচণ্ড পর্যায়ের মানসিক চাপ এবং প্রতিযোগিতা, সামাজিক সমর্থনের অভাব এবং বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি মানুষকে একা করে দিচ্ছে, নিজের মধ্যে গুমরে থাকতে বাধ্য করছে। হিকিকোমোরি যত বাড়বে সম্পর্ক তত ভাঙবে, পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে বন্ধন ছিঁড়ে যাবে। প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার চাপের সঙ্গে এই হিকিকোমোরি ভীষণভাবেই সংযুক্ত।

হিকিকোমোরির প্রভাবও শুধু সম্পর্কে না, রাষ্ট্রের উপরেও পড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং জাপানের বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এই হিকিকোমোরি। হিকিকোমোরি মানুষের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে দেবে। একাকীত্বে চলে যাওয়া এই ব্যক্তিদের পক্ষে বিস্তৃত অর্থনীতিতে অবদান রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। জাপানের জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জগুলিকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে হিকিকোমোরি। দীর্ঘকাল ধরেই জাপানের বৃদ্ধ মানুষদের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং জন্মহার ক্রমেই কমছে। হিকিকোমোরিরা এতটাই সমাজবিচ্ছিন্ন, সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন যে তারা কোনওদিনই আর পরিবার গড়া, সন্তানের জন্ম এসবের দিকে যাবেন না। জাপান বুড়িয়ে যাবে, কর্মক্ষম মানুষ রইবে না একটা দেশে। ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একটা আস্ত দেশ, একা হয়ে যাবে? ভয়াবহ প্রশ্ন, উত্তর আরও মারাত্মক!

More Articles