জেলবন্দি, অসহায় পার্থর ভাগ‍্যের চাকা ঘুরছে কোনদিকে

Partha Chatterjee: একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ, নারী-সঙ্গের বিস্তারের মধ্যেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

'আজ যে রাজা কাল সে ফকির!' বঙ্গরাজনীতির আঙিনায় এই বক্তব্য সমার্থক হয়ে উঠেছে ফের। আর এই রাজাসুলভ পরিস্থিতিতে বর্তমান এক দাপুটে রাজনীতিক মঞ্চেও প্রায় যেন একাকি হয়ে উঠেছেন তিনি! কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, একের পর এক দুর্নীতির অবস্থানের মধ্যেই পণ্যের সঙ্গে নির্ভীক স্বাধীনতার কথায় আর টিকে থাকতে পারেননি পার্থ। কিন্তু?

কী হয়েছে আসলে? ২১ জুলাই, ২০২২। তৃণমূলের শহিদ দিবসের বিরাট উদযাপনের মঞ্চ আলো করেও তিনি ছিলেন। একের পর এক নীতি নির্ধারণে তিনিই ছিলেন অন্যতম। কিন্তু ২১ জুলাইয়ের মাত্র ৩১ দিন পরেই সম্রাট তকমা থেকে যেন আকস্মিক মৃত্যু হল তাঁর! নিমেষেই 'খলনায়ক' হয়ে গেলেন নাকতলার 'পার্থদা'। আর কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় এবং দুর্নীতির অভিযোগের অনলে পুড়ে ছারখার হলেন মমতার এই ডান হাত।

এবার সেই পার্থই যেন ম্রিয়মান। সেই দাপুটে নেতাই যেন অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। মলিন হচ্ছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ পার্থ চট্টোপাধ্যায়! মুকুটহীন সম্রাটের মতো কারাগারের বন্দিজীবন আর চরিত্র-বিতর্কে জর্জরিত হচ্ছেন ৭০ বছরের এক প্রবীণ রাজনৈতিক। খানিকটা যেন অনুব্রত মণ্ডলের মতোই পাকা চুলেই সম্বলহীন হয়ে উঠছেন পার্থ। কেন?

আরও পড়ুন: একটি প্রণামেই তছনছ সাজানো বাগান? শুভেন্দু-সৌজন্যে বিজেপির অন্দরে যে তোলপাড়

পার্থ-উত্থান
তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে মমতার ঘনিষ্ঠ-বৃত্ত করায়ত্ত করতে পারেননি পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতার এই বাসিন্দা বড় চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিতেই ক্রমশ বাড়িয়ে ফেলেন নিজের পরিসর। আরও কাছে আসেন মমতার। ক্রমশ বাড়তে থাকে পার্থ প্রভাব।

২০০৫ থেকে ২০২১। বিধানসভা নির্বাচন। তৃণমূলের ভরাডুবি এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হিসেবে উঠে আসেন নাকতলার পার্থ। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ছাড়িয়ে মহাসচিব হয়ে দলের নীতি নির্ধারণে ছাপ রাখতে শুরু করেন তিনি। দলের একাধিক সিদ্ধান্তে মমতার পর সুব্রত বক্সিদের ছাড়িয়ে তিনিই হতে শুরু করেন সবটা। পার্থ মন্ত্রী হন। শিক্ষা থেকে শিল্প, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরে পার্থর ডাক ছিল সবার আগে।

রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এই জুটির দাপটে বঙ্গের তৃণমূলের দিননামচা বিবর্তিত হত বারবার। অর্থাৎ মমতার পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে দলের শেষকথা, এটাই ছিল তৃণমূলের পার্থ-ইতিহাস।

'পার্থ-অবনমন'
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলগত প্রভাব বাড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূলের পুরনো নেতা, মন্ত্রীর নাকি চাপ বাড়তে থাকে। একথা বলেন কেউ কেউ। আবার একের পর দুর্নীতির তথ্য, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে জড়িয়ে যাওযার আশঙ্কা বৃদ্ধি করে বারবার। একদিকে দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ পার্থ অন্যদিকে চাপে পড়েন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সান্নিধ্যে যেতে গিয়ে। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই দলে অভ্যন্তরে পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রভাবের খানিকটা কম উদ্দীপনা ছিল। আর সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে খুব একটা সুখকর ছিল না পরিস্থিতি।

দুর্নীতি-ফাঁদে পার্থ
এবার আর রেহাই পাননি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি থেকে ফর্কর কার্যকরকে শুরু শিক্ষার কর্মী। এসএসসি থেকে শুরু করে টেট! একাধিক বিষয়ে নাম জড়ায় সোনু নিগমের। আর এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দলের অন্দরে প্রভাব কমতে থাকে তাঁর। কিন্তু রেহাই মেলনি আর। কর্মক্ষেত্রের রাসের মেলেনি খুব একটা সক্রিয় হননি তিনি।

জেলযাপনের সূত্রপাত
তৃণমূল নেতা অথবা মন্ত্রী নন, এই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক বিতর্কও। ক্রমশ, পিছু হটার পথেই এবার সাড়া নিজেই সাড়া দেয় ছেলেটি।

২৩ জুলাই, ২০২২। একাধিক নির্বাচনের আগেই শোরগোল ফেলেন পার্থ। সমস্ত জল্পনা কাটিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কাছে গ্রেফতার হন। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে শুরু করে, সব ছাড়িয়ে এবার জেল-অভিমুখে যাত্রা করতে হয় তাঁকে। দুর্নীতির দায়ে ইডি-র হাতে গ্রেফতার হন পার্থ। দল থেকে জেলে পৌঁছন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শুধু টাকা উদ্ধার নয়, এক বান্ধবীর মুখও প্রকাশ্যে আসে  সেদিন। কলকাতা থেকে বেলঘরিয়া, কয়েকশো কিলোমিটার দূরেও ছড়িয়ে যায় দুর্নীতির সুতো। উত্তাল হয় রাজ্য। কিন্তু কাজের কাজ?

জেলবন্দি পার্থ
পাক ধরেছে চুলে। তবু পার্থকে ঘিরেই কথকতা রচিত হচ্ছে বারবার। সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একদা মমতার কাছের লোকের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে চার দেওয়ালে অভ্যন্তরে। আর এই অসহনীয় জীবনের যানজট যেন প্রকাশ পাছে বারবার।

তৃণমূলের পার্থ-অবস্থান
'ওঁ কী বলল সেটা ভেবে দল কাজ করবে না!' পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে জেলবন্দি পার্থর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে একথা বলেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। যদিও রাজ্য-রাজনীতির অন্যতম মুখের দলীয় অবস্থান বা সৌভাগ্য শিরোহন জাগায় বারবার। আর এখানেই ব্যবস্থা নিয়েছে তৃণমূল। তবে মমতা আসার প্রায় ১১ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় থাকাকালীন পার্থ-বিড়ম্বনা সামনে আসেনি। যদিও এই অবস্থার মধ্যেই এই নেতার জেলবন্দী দশা আরও বিপদ বাড়ায় তৃণমূলের।

কিন্তু খুব একটা সময় নেয়নি তৃণমূল। আলোচনার কেন্দ্র একটু এধার-ওধার হতেই  চমকে উঠেছে রাজ্য। দল থেকে, মন্ত্রিত্বের পদ; থেকে থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়।

কুণাল থেকে অভিষেক। দেবাংশু থেকে তাপস রায়। পার্থ-অস্বস্তি ঢাকতেই ফের আক্রমণের পথে হেঁটেছেন তাঁরা। পার্থকে প্রায় ব্রাত্য করে দেওয়ার পথে হাঁটছে তৃণমূলও।

আবার কি প্রভাব বিস্তার করবেন পার্থ?
১২০ দিনের বেশি কালো ইতিহাস ছাড়িয়ে এই প্রশ্নের দাবদাহে খানিকটা যেন উত্তর নিশ্চিত করেছেন পার্থ নিজেই! বারবার আদালতের দরবারে জামিনের আশায় বসে থাকা নেতাকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে তৃণমূল। একদা যাঁর হাত ধরেই দলীয় শাস্তির মুখে পড়েছিলেন কুণাল। সেই ব্যক্তিকে প্রায় রাজনৈতিক অবসরের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।

পার্থর বর্তমান অবস্থান
সম্প্রতি কলকাতার আদালতে ওঠে এই পার্থ মামলা। ভার্চুয়াল উপস্থিতি ছিল পার্থ এবং অর্পিতার। এদিন জামিনের আর্জি জানানোর পরিবর্তে আদালতে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পার্থর আইনজীবী সেলিম রহমান। বুধবার স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-র  মামলায় জামিনের আবেদন করেননি। আবেদন জানাননি অর্পিতার আইনজীবীও। যদিও দুই পক্ষের সওয়ালে উঠে আসে একাধিক তথ্য। জামিন হয়নি, বরঞ্চ বিচারকের নির্দেশে ফের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের দিকে এগিয়েছেন পার্থ।

যদিও এতদিনেও জামিন নয় কেন, এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডাকাতির প্রসঙ্গ নিয়ে ইডি-র আইনজীবী ভাস্করপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তরফে বলা হয়, "ডাকাতি হলে সেটা ‘শিডিউল অফেন্স', তবে ডাকাতি করে কেউ যদি এ দিক-ও দিক চলে যান, তা হলে কি ২৪ ঘণ্টায় তদন্ত সম্ভব!”

বেসরকারি আইন কলেজ নিয়েও এদিন সমস্যায় পড়েন পার্থ। ছাড়পত্র দেওয়ার বিনিময়ে টাকা তুলতেন পার্থ। মানিক ভট্টাচার্য থেকে জলের যোগান। একাধিক কসরত করেছেন তৃণমূল নেতারা।

ধনকুবের পার্থ, অর্পিতা
ইতিমধ্যেই, পার্থ ও অর্পিতার প্রায় ১০৩ কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছে ইডি।  যে সংস্থার তরফেও বিপুল সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। দলের হয়েই এগিয়ে গিয়েছেন বারবার। সেই ব্যক্তিই অর্থাৎ পার্থ এবং তাঁর সহযোগীর প্রায় ৪৮ কোটি ২২ লাখ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় সেদিন। যোদিও এর আগেই অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুই ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ্য কোটি নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। উদ্ধার হওয়া সোনার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫.০৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট ১০৩.১০ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় ইডি-র তরফে।

'একাকী পার্থ'
লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু! তিনি একা, প্রভাব ছাড়িয়ে আজ সাধারণ হয়ে উঠছেন ফের। কারণ, বন্দিদশা। যেখানে পার্থর জন্য নেই আগের মতো কিছুই।

আসলে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ, নারী-সঙ্গের বিস্তারের মধ্যেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। তৃণমূলের ক্ষেত্রে পার্থ যে তেমন আর কিছু নন। একজন অভিযুক্ত বিধায়ক হিসেবে দলের কেউ নন। একথা প্রমাণিত হয়েছে বারবার। তৃণমূলের তরফে পার্থ নিয়ে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের আধিপত্য অনাবৃত হতেই দলের অবস্থান আরও নিচের দিকে নামিয়ে আসে পার্থর অবস্থান। পাকা চুল আর ভার্চুয়াল আদালত উপস্থিতির মধ্যেও বারবার হার্টের হয় তাঁকে। আর সেখানে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন ওঠে একের পর উত্তরপত্র নিয়েও।

More Articles