দ্রৌপদী একা নয়! জানেন, এক নারীর বহুস্বামীর প্রথা কীভাবে এল বিশ্বে?
Polyandry Multiple Husbands: আনুমানিক ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ লাগাশের সুমেরীয় রাজা উরুকাগিনা মেসোপটেমিয়ায় বহুস্বামী গ্রহণের এই প্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেন।
বহুবিবাহ। শব্দটি শুনলেই এক স্বামীর অনেক স্ত্রীর ধারণাটিই মাথায় আসে। তেমনটাই স্বাভাবিক। পুরুষ এখানে কর্তা, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। বিয়ে এখানে কর্তার এক কর্ম, সুতরাং বহুবিবাহে স্বামীর অধীনে একাধিক স্ত্রী থাকবে এমনটাই প্রচলিত। বিপরীত প্রথা, মানে দুই বা ততোধিক স্বামী গ্রহণ করার একখানিই উদাহরণ জনপ্রিয়। দ্রৌপদী। বহুগামিতা পলিগ্যামি নামেই পরিচিত। আর এক নারীর অনেক স্বামী সাধারণত পলিঅ্যান্ড্রি নামে পরিচিত। কীভাবে এল নারীর এই বহুগামিতার ধারণাটি?
পলিঅ্যান্ড্রি শব্দটি গ্রিক। পলি মানে বহু এবং অ্যান্ড্রোস হচ্ছে পুরুষ। তাই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ একজন মহিলার দুই বা ততোধিক স্বামী গ্রহণ। প্রথাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সম্পত্তির উত্তরাধিকারই। সম্পদ, বিশেষ করে জমি এবং খাদ্যের অভাব ছিল এককালে, এখনও তাই আছে। সেই সময়ে নারীদের সম্পত্তি বা পৈতৃক পদের অধিকারী হওয়ার অনুমতি ছিল। বিশ্বের কিছু এমন অঞ্চলে এই প্রথাটি ঘটে যেখানে নারীরা নিজেরাই ছিল দুষ্প্রাপ্য। সেই সমাজে নিয়মিতভাবে কন্যাশিশু হত্যা করা হতো, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মেয়েদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই কম ছিল৷ তাহলে এই মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তি পাবে কে? পলিঅ্যান্ড্রির মাধ্যমে পুরুষরা এই মহিলাদের সম্পত্তির মালিক হতে পারতেন। স্ত্রীর সম্পত্তির উপর নির্ভর করে আরামদায়ক জীবনযাপনও করতে পারতেন। এই ধরনের সম্পর্কগুলিতে মহিলাদের অবস্থান ছিল বেশ উঁচুতে, নারীদের সামাজিক ও পারিবারিক দুই মর্যাদাই ছিল বিপুল।
মানব সভ্যতার সূচনাকালে সারা বিশ্বেই মহিলাদের বহুবিবাহের প্রথা প্রচলিত ছিল। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে, কানাডিয়ান আর্কটিক এবং আফ্রিকা, চিন এবং আমেরিকার কিছু অংশে মহিলাদের একাধিক স্বামীর ঘটনা জানা যায়। প্রাচীন কিছু সেল্টিক সমাজে, মহিলারাই পৈতৃক সম্পত্তির মালিক হতেন এবং তাই একাধিক স্বামীকে বিয়ে করার অনুমতিও ছিল তাঁদের। জুলিয়াস সিজার এই প্রথা সম্পর্কে সেইকালে অভিযোগও তুলেছিলেন। আনুমানিক ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ লাগাশের সুমেরীয় রাজা উরুকাগিনা মেসোপটেমিয়ায় বহুস্বামী গ্রহণের এই প্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেন। একেশ্বরবাদে বিশ্বাস ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলামেও বহুপতি গ্রহণে প্রথা ক্রমাগত নিষিদ্ধ হতে থাকে।
আরও পড়ুন- জানেন যৌনতায় তৃপ্তি আপনার অধিকার! কিন্তু কতটা সুখী ভারতীয়রা?
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, বহুবিবাহপ্রথা ব্যাপকভাবে রয়েছে এখনও। বিশ্বে উপজাতীয় সমাজের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, তাদের মধ্যে ৮৩.৩৯% মানুষই বহুবিবাহ প্রথা অনুশীলন করে। ১৬.১৪% একবিবাহের প্রথা মেনে চলেন আর মাত্র ০.৪৭% বহুস্বামী গ্রহণের প্রথার চর্চা করেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই, বহুপতি গ্রহণের বিষয়টি পাণ্ডবদের মতো, মানে এক পরিবারের অনেক ভাই একজন স্ত্রীকে ভাগ করে নেন। এক পরিবারের ভাই না হলে সেখানে তাঁদের এক স্ত্রী হলে সম্পর্কে অস্থিরতা বাড়ে। সেখানে সম্পর্কের বাইরের কোনও পুরুষের সঙ্গে সেই স্ত্রীর সন্তানের লালন পালনের দায়িতে নিতে অনেকেই কম ইচ্ছুক হন।
ভারত, ভুটান, নেপাল এবং তিব্বতের বেশ কিছু স্থানে বহুপতির প্রথা তুলনামূলকভাবে বেশ সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, বিশেষ করে এই অঞ্চলের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এখন চিন কর্তৃপক্ষ তিব্বতে এই প্রথাটি নিষিদ্ধ করেছে, ভারতেও এই প্রথা অচল। বহির্বিশ্বে সম্পদ এবং সুযোগ বাড়তে থাকায় পিছিয়ে পড়া এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পুরুষরা অন্যত্র চাকরি এবং স্ত্রী দুই-ই খুঁজে নিচ্ছেন। মহিলাদের ক্ষেত্রেও স্রেফ সম্পত্তির জন্য একাধিক স্বামীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, স্বামীর প্রয়োজনই কমে যাচ্ছে একাংশের কাছে।
আরও পড়ুন- একই মানুষের বহু যৌনসম্পর্কে আগ্রহ, কেন এমন হয়!
লাসা থেকে একটু উত্তর-পূর্বে, তিব্বতের মালভূমির এক বিশাল অংশ জুড়ে থাকা পাহাড়ের মধ্যে এক জনগোষ্ঠী রয়েছে যেখানে বহুপতি গ্রহণের প্রথা এখনও বিদ্যমান। বিশ্বের খুব কম অংশেই এখনও বহুস্বামী গ্রহণের প্রথার চর্চা করা হয়। তিব্বতের এই অংশে গেলে তাই রীতিমতো অবাক হতে হয়। এখানে একটি পরিবারে হয়তো একটিই কন্যা রয়েছে। কোনও যুবক যদি এই পরিবারের সঙ্গে জুড়তে চান, এক ছাদের তলায় থাকতে এবং সেই কন্যার স্বামী হতে চান তাহলে মেয়েটির বাবা মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সম্পত্তির পরিমাণের বিষয়ে একটি চুক্তি করেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে ওই মেয়েটির পরিবারকে কিছু সম্পত্তি দান করতে হবে। এই দেনা পাওনা বিষয়ে যদি বাবা মা রাজি এবং তৃপ্ত হন তাহলে যুবক ওই ঘরে এসেই থাকেন এবং কন্যার স্বামী হন। এবার এমনটাও তো হতে পারে যে এই একই সৌভাগ্যের অংশীদার হতে ইচ্ছুক অন্যান্য যুবকরাও লাইন দিলেন মেয়ের জন্য? মেয়েটির যে আগেই একবার বিয়ে হয়ে গেছে এই বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণই নয়। অন্য যুবকরাও মেয়েটিকে বিয়ে করতে একইরকম সম্পত্তি দেনা পাওনার চুক্তি করেন। মেয়ের আবার অন্য যুবকের সঙ্গেও বিয়ে হয়, সেই যুবকও মেয়ের বাড়িতে এসেই স্বামী হয়ে থাকেন।
স্বামীদের মধ্যে কি স্ত্রীর একচেটিয়া 'অধিকার' নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি বেঁধে যায়? ঈর্ষা জাগে না? কামের ক্রোধ? একেবারেই না। বিষয়টা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে অর্থ ও সম্পত্তির উপর। সেই তিব্বতি যুবক যদি বিশাল ধনী হয়ে থাকেন, তাহলে একজন স্ত্রী তিনি কিনেই নেবেন এবং পরিবারের একমাত্র কর্তা হয়ে উঠবেন। এই প্রথায় সন্তানরা সবসময়ই মহিলার উত্তরাধিকারী হন, বাবারা সন্তানদের উপর কোনও দাবি রাখেন না। বহুস্বামীর প্রথাটি আইনস্বীকৃত নয় অবশ্যই। তবে এ এমন এক প্রথা যা সম্ভবত এমন এক সময়ে উদ্ভূত হয় যখন নারীর জনসংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম ছিল। সমাজের দরিদ্রতম অংশে ছিল এই প্রথার বিশেষ চর্চা। বিয়ে, একাধিক স্বামী বা স্ত্রী সম্পূর্ণ বিষয়টিই আসলে সম্পত্তি ও অর্থের সঙ্গে যুক্ত। এতে যৌনতা, প্রেম বিষয়টির তেমন দখলদারি কখনই ছিল কি?