মোদির রামরাজ্য এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষের কথাই বলে

Hey Ram : গান্ধির কাছে সীতার ভূমিকাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু আজকের বিজেপি এই সীতারামের সীতা অংশটি ছেঁটে ফেলে শুধু ম্যাচো এক পুরুষতান্ত্রিক রামকেই হাজির করেছে।

অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন হবে, প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী মন্দির হলেই দেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। এর আগে আমরা রামরাজ্য কথাটি শুনেছি মহাত্মা গান্ধির মুখে। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে বলা দরকার, বিজেপি নির্মিত এই ম্যাচো রাম ও তার অনুগত ক্রুদ্ধ হনুমানের সঙ্গে গান্ধির কল্পনার রামের কোনও দূরতম সম্পর্ক নেই। অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই গান্ধির মুখে প্রথম রামরাজ্যের কথা শোনা যায়। কিন্তু সেটা কী তা তখন তিনি খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করেননি।

এই রামমন্দির নির্মাণের সঙ্গে গান্ধির রামরাজ্য ভাবনার আদর্শের কোনও যোগই যে কোথাও নেই, সেই কথা বলছেন ইতিহাসবিদেরা। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, এক অবিতর্কিত, সমদর্শী, দীনদরিদ্রপ্রেমী রামচন্দ্রের কথা। তাঁর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের আদর্শের ভিত্তিতেই নাকি গান্ধি রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই রকম একটি হাস্যকর দাবি প্রধানমন্ত্রী করেছেন।

এই হাস্যকর দাবির প্রসঙ্গে মনে পড়ল, পরশুরামের (রাজশেখর বসু) হাস্যরসের লেখা ‘রামরাজ্য’ গল্পটির কথা। গল্পের একটি চরিত্র বলে যে, গান্ধিজি নেই, দেশ জাহান্নমে গেছে। তাই তাঁকেই প্ল্যানচেটে ডেকে পরামর্শ নেওয়া হোক, কীভাবে আসবে রামরাজ্য। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, গান্ধিজি নয়, প্ল্যানচেটে শ্রীরামকেই ডাকা হোক। কিন্তু রামের বদলে এসে পড়ে হনুমান এবং তার দীর্ঘ বক্তৃতায় প্ল্যানচেটে বসা মানুষদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাতে হাতাহাতিতে পর্যবসিত হয়ে ব্যাপারটি শেষ হয়।

প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী রামরাজ্য বলতে কী বোঝায়? রামের রাজ্যে প্রজারা সুখে-শান্তিতে বাস করত এবং রাজ্যের সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার অব্যাহত ছিল। এই জন্য রামের শাসনের অনুসরণে সুশাসিত রাজ্যকে ‘রামরাজ্য’ বলার প্রবণতা চালু হয়। রামরাজ্য শব্দটি গান্ধি জনপ্রিয় করেছিলেন। এটি একটি আদর্শ সমাজ যা তিনি কল্পনা করেছিলেন, ভগবান রামের শাসনের উপর ভিত্তি করে। রামরাজ্যের ধারণাটি একটি আদর্শ সমাজের ধারণাকে প্রতিফলিত করে যেখানে সবাই সমান এবং ন্যায়বিচার বিরাজ করে। 

আরও পড়ুন- পথের নাম নৈরাজ্য, মৃত গান্ধী জীবিত গান্ধীর চেয়েও শক্তিশালী যেভাবে

এইবার গান্ধির দিকে ফেরা যাক। পারিবারিকভাবে গান্ধি ছিলেন বৈষ্ণব, তাঁর নামও ছিল মোহনদাস কিন্তু তাঁর প্রিয় ভজন ছিল ‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম/ পতিতপাবন সীতারাম’। যদিও হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী রাম বিষ্ণুরই সপ্তম অবতার। এই ভজনটির নির্দিষ্ট উৎস জানা যায় না। আন্দাজ করা হয় ভজনটি উত্তর প্রদেশের সন্ত কবি তুলসীদাসের ১৬ শতকের রচনা রামচরিতমানসের উপর ভিত্তি করে লেখা অথবা মারাঠি সন্ত কবি রামদাসের ১৭ শতকের গাওয়া প্রার্থনার উপর ভিত্তি করে লেখা। এই ভজনটি জনপ্রিয় হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকরের কণ্ঠে। রেডিওতে এই ভজন ছোটবেলায় শুনেছি। এই ভজনটির জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে, গান্ধি মূল ভজনটি পরিবর্তন করেছেন। যোগ করেছেন যে, হিন্দুদের ঈশ্বর এবং মুসলমানদের আল্লাহ এক এবং অভিন্ন। গানটিকে আরও ধর্মনিরপেক্ষ-সুদর্শন করতে, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মিলনের কথা বলেছেন। গান্ধির পরিবর্তন করা ভজনটি দেখে নেওয়া যাক,

রঘুপতি রাঘব রাজারাম,
পতিতপাবন সীতারাম॥
সীতারাম, সীতারাম,
ভজ প্যায়ারে তু সীতারাম॥
রঘুপতি রাঘব রাজারাম,
পতিতপাবন সীতারাম॥
ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম
সব কো সন্মতি দে ভগবান॥
রঘুপতি রাঘব রাজারাম,
পতিতপাবন সীতারাম॥
রাম রহিম করিম সমান
হাম সাব হ্যায় উনকি সন্তান॥
রঘুপতি রাঘব রাজারাম,
পতিতপাবন সীতারাম॥
সব মিলা মাঙে ইয়ে বরদান
হামারা রহে মানব কা জ্ঞান॥
রঘুপতি রাঘব রাজারাম,
পতিতপাবন সীতারাম॥

এই ভজনে বারবার উচ্চারিত পতিতপাবন সীতারাম শব্দদু'টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সীতারাম অর্থ সীতা ও রাম। এটি হিন্দুদের অভিবাদন হিসাবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে ভারতের আওধ, ভোজপুর এবং মিথিলা অঞ্চলে আর ভারতের বাইরে ফিজি, গায়না, মরিশাস, সুরিনাম এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রবাসী ভারতীয় হিন্দিভাষীরাও এই অভিবাদন ব্যবহার করেন। পতিতপাবন সীতারাম অর্থ পাপীদের ত্রাণকর্তা সীতা ও রাম। লক্ষ্যণীয় সীতার নামটি আগে আসছে। সীতার অর্থ কী? লাঙল দিয়ে কর্ষণের ফলে জমিতে যে রেখা পড়ে তাকে বলে সীতা। রামায়ণ অনুসারে, যজ্ঞের অংশ হিসাবে লাঙল দিয়ে জমি কর্ষণ করার সময় রাজা জনক সীতাকে পেয়েছিলেন এবং তাকে দত্তক নেন। সীতা শব্দটি একটি কাব্যিক শব্দ ছিল যা উর্বরতা এবং বসতিবদ্ধ কৃষি থেকে আসা অনেক আশীর্বাদকে বোঝায়। আর ধরিত্রী যেমন প্রকৃতি, পশু ও মানুষকে ধারণ করে আছে, তেমনই ধরিত্রীকন্যা (যেহেতু মাটি থেকেই তার জন্ম) সীতাও এই প্রকৃতি, প্রাণী ও মনুষ্য সমাজকে ধারণ করে রাখেন। সীতার ভূমিকাটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এই ভজনে। প্রজাপালনে, জীববৈচিত্রের লালনে এই সীতার ভূমিকা রামের চেয়েও বড়। গান্ধির কাছে সীতার এই ভূমিকাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু আজকের বিজেপি এই সীতারামের সীতা অংশটি ছেঁটে ফেলে শুধু ম্যাচো এক পুরুষতান্ত্রিক রামকেই হাজির করেছে।

গান্ধি তাঁর নিজের রামরাজ্যর যে ভাবনার কথা ‘হিন্দ স্বরাজ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, সেগুলি একবার পড়া যাক- 

ক. সমতা : গান্ধি তাঁর রামরাজ্যের ধারণায় সাম্যের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির সমান সুযোগ এবং অধিকার থাকা উচিত।

খ. ন্যায়বিচার : রামরাজ্য এমন একটি সমাজ, যেখানে ন্যায়বিচার থাকবে এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। গান্ধি ন্যায়বিচার অর্জনে স্বশৃঙ্খলা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কাজ করা উচিত, যাতে তারা সমাজে অন্যায় মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারে।

গ. অহিংসা : রামরাজ্য এমন একটি সমাজ যেখানে হিংসা পরিহার করা হবে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধগুলির সমাধান করা হবে। গান্ধির রামরাজ্যের ধারণার মূল ভিত্তি হলো অহিংসা। গান্ধিজি বলেছেন, অহিংসা হলো আত্মার অঙ্গ এবং ধর্ম, তাই প্রত্যেকের জীবনের প্রতিক্ষেত্রেই অহিংসা পালন করা প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করতেন, হিংসা কেবল হিংসারই জন্ম দেয় এবং শক্তি প্রয়োগ কখনই স্থায়ী শান্তি আনতে পারে না। পরিবর্তে, তিনি নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সত্যাগ্রহের যে বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলি হলো, আমরণ অনশন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট, পিকেটিং প্রভৃতি।

আরও পড়ুন- রাম মন্দির উদ্বোধন নিয়ে মোদির পাশে নেই বহু হিন্দুত্ববাদীই! কেন?

ঘ. স্বশাসন : রামরাজ্য এমন একটি সমাজ, যেখানে মানুষের স্বশাসন থাকা উচিত এবং তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত।

ঙ. সমৃদ্ধি : রামরাজ্য এমন একটি সমাজ যেখানে প্রত্যেকেই জীবনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলি পাবে।

চ. নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ : রামরাজ্য সম্পর্কে গান্ধির দৃষ্টিভঙ্গি নিছক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজ তিনি কল্পনা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের ভিত্তি হওয়া উচিত সত্য, প্রেম, সহানুভূতি এবং ক্ষমা।

ছ. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : গান্ধি বিশ্বাস করতেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া উচিত এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত স্থানীয় পর্যায়ে। তিনি গ্রাম সভা বা গ্রাম সমাবেশ প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

জ. ট্রাস্টিশিপ : গান্ধি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র নয়, ট্রাস্টিশিপই একটি ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। রাষ্ট্রের এহেন বিরোধিতায় তাঁকে একজন আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যবাদীও বলা যায়। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সম্পদ নিজেই শেষ নয়, বরং সর্বসাধারণের ভালো পরিবেশনের একটি উপায়। রামরাজ্যে, ধনী এবং ক্ষমতাবানরা ট্রাস্টি হিসাবে কাজ করবে, দরিদ্র ও দরিদ্রদের উন্নতির জন্য তাদের সম্পদ ব্যবহার করবে। গান্ধির ট্রাস্টিশিপের ধারণা ছিল অহিংসা ও স্বেচ্ছাসেবী সহযোগিতার নীতির উপর ভিত্তি করে। 

এই হলো গান্ধির পতিতপাবন সীতারাম ও রামরাজ্যের ভাবনা। ২০১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বে উপরের একটি ভাবনাকেও বাস্তবায়িত হতে আমরা দেখিনি। তিনি যে অযোধ্যা, রামমন্দির এইসব রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয়গুলো নিয়ে রামরাজ্যের দাবি করছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তা এক পিছিয়ে যাওয়া এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষের কথাই বলে।

 

More Articles