আসলে কলকাতার বয়স কত? যে ইতিহাস ছিল আড়ালে
শুধু ব্রিটিশ-পূর্ব কলকাতার নামই নয়, কলকাতার বহুবাজার পাড়ারও উল্লেখ পাচ্ছি জনৈক কৃষ্ণদাসের 'নারদপুরাণ' কাব্যে।
কলকাতা কত পুরনো? ২০০৩-এর ১৩ জানুয়ারি 'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় বলা হচ্ছে, দমদমের ক্লাইভ হাউসে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানতে পেরেছে, কলকাতার বয়স আরও অন্তত স্বচ্ছন্দে ২০০০ বছর পিছিয়ে শুঙ্গ, কুশান আমল পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া যায়। তার আরও বেশি বয়স হলেও হতে পারে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সমীক্ষা ছেপে জনসমক্ষে এসেছে কি না জানি না, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কলকাতা সার্কেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট শুভ মজুমদার জানিয়েছেন, "এএসআই প্রথমবার দমদম ক্লাইভ হাউসের পাশে থাকা ঢিপিতে খননকার্য চালায় ২০০১ সালে। তখন বেশ কিছু প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী উদ্ধার হয়। সেগুলোর গুরুত্ব বুঝে ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ফের খননকার্য চালানো হয়েছিল। দেখা যায়, মাটির নিচের পরপর সাতটি স্তরে মানুষের জীবনযাত্রার প্রামাণ্য সামগ্রীর উপস্থিতি রয়েছে। স্তরগুলো থেকে বিভিন্ন রঙের মৃৎপাত্র, ঘর ও স্থাপত্যের অবশেষ মেলে। তা পরীক্ষা ও অনুধাবন করে আড়াইহাজার বছরের ইতিহাসের নিদর্শন পাওয়া যায়। দু’মাস আগে ফের ক্লাইভ হাউসে খননকার্য শুরু করেছে এএসআই। এবারও উদ্ধার হয়েছে মৃৎপাত্র-সহ নানা সামগ্রী, যেগুলি খ্রিস্টপূর্ব সময়ের সভ্যতার নিদর্শন। এছাড়াও ওই স্থান থেকে কয়েকশো বছরের প্রাচীন একাধিক মূর্তি, খেলনা, অলংকার, ধাতব বস্তু, মুদ্রা, সিলমোহর-সহ নানা জিনিস পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে নরকঙ্কালও। সেগুলো নিয়ে নৃতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ গবেষণা করছে। আগেরবারের খননে সাতটি স্তর পাওয়া গিয়েছিল। এবার ১২টি স্তর পেয়েছি। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতাব্দীতেও কলকাতায় মানবসভ্যতার নিদর্শন মিলেছে। এ-ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে যাবতীয় নমুনার বিজ্ঞানসম্মত ‘ডেটিং’ করা হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, গর্বের কলকাতার আরও গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সামনে আসবে।"
অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৯০ সালে কলকাতার ৩০০ বছরের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করেছে মহা ধুমধাম করে। মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ ইতিহাসজ্ঞানে আমরা ইংরেজি শিক্ষিতরা প্রায় সকলেই জানি, ১৬৮৬-তে হুগলিতে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ব্রিটিশরা, মুঘল সরকারকে বকলমা দিয়ে ৩০০০ টাকার বিনিময়ে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে, এবং ১৬৯০-এ সুতানুটিতে বাণিজ্য কুঠি শুরু করেন জোব চার্নক। ১৬৯৮-এ সুবাদার আজিমুশ্বানের থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতার জমিদারি লাভ করে কিছুদিনের মধ্যেই বাকি দুই গ্রামের নাম কলকাতা নামক জনপদ গিলে ফেলে ঔপনিবেশিক কলকাতা শহর হিসেবে পরিচিত হয়।
ব্রিটিশ আর ব্রিটিশ-অনুমোদিত নবজাগরণীদের প্রচারে কলকাতার বয়স যে মাত্র ৩২২, এটা জনগণ বিশ্বাস করে নিল। এই তথ্যই হয়ে উঠল পাঠ্যপুস্তকীয় সাধারণ জ্ঞান। উন্নয়ন বিকাশের স্তর নির্ধারিত হল ব্রিটিশ উদ্যোগে কলকাতা স্থাপনে। ২০০২-এর ক্লাইভ হাউসে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাটি খুঁজে পাওয়া জ্ঞানকে সরিয়ে রাখলে কি আমরা ধরেই নিতে পারি, ‘কলকাতা প্রতিষ্ঠাপক’ ব্রিটিশ বাহাদুর এই ভূখণ্ডে আসার আগে কলকাতা নগণ্য গ্রাম ছিল? কলকাতার প্রাচীনত্বের আর কি কিছুই সহজ প্রমাণ নেই? এই যে সাধারণ জ্ঞানের একটি ঔপনিবেশিক চক্কর তৈরি হয়েছে, তার থেকে কি আমাদের বেরোবার আর কোনও আশা নেই? তাহলে কেন আমরা হকার-কারিগর-চাষিদের সংগঠন কলকাতাকে কয়েক হাজার বছরের পুরনো এশিয়াজোড়া সমৃদ্ধ রেশম পথের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দাবি করি? সেই প্রাচীনত্বের দাবি কি তাহলে ভুয়া? না, ভুয়া তো নয়ই, বরং কঠোর বুনিয়াদনির্ভর। অন্তত বাংলায় এবং বাংলানির্ভর সাহিত্যের উদাহরণে দেখাতে পারব যে, কলকাতার উল্লেখ আছে ব্রিটিশ পূর্ব সময়ের সাহিত্যেও। তথ্য উন্মোচন পর্বে একে একে প্রবেশ করা যাক।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্র-ভক্তরা তাড়াতে চেয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে, বলেছিলেন রামকিঙ্কর
১৩৪৫-এ সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতার প্রাচীনত্বের মতের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, কিন্তু পশ্চিমের জ্ঞানচর্চায় যাকে প্রামাণ্য নথি স্বীকার করা হয়, সেরকম খুব বেশি কিছু প্রমাণ তিনি তুলে দিতে পারেননি। ফলে সেই প্রবন্ধটি খুব বেশি প্রচার পায়নি। কিন্তু আমরা এই লেখার শেষে সেই প্রবন্ধের একটা তথ্য উল্লেখ করব।
কলকাতা যে ব্রিটিশ-পূর্ব সময়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল, তার প্রথম প্রমাণ আমাদের হাতের কাছেই আছে। বেলঘরিয়ার পাশের নিমতা অঞ্চলের কবি কৃষ্ণরাম দাসের 'কালিকামঙ্গল'-এ'-এ (সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত কবি কৃষ্ণরাম দাস রচনাবলী) কলকাতার নামোল্লেখ পাচ্ছি। বইটির যেহেতু প্রচুর নকল পাওয়া গিয়েছে, এর একটি নকল যেহেতু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সটীক ছেপেছে, তাই বইটাকে জালও বলা যাবে না, অন্য কোনও প্রমাণ না এলে কাব্যে ব্যবহৃত কলকাতা নামকেও প্রক্ষিপ্ত বলা যাবে না। কৃষ্ণরাম কাব্য রচনার সময়কাল সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সেটি পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম:
বলে কবি কৃষ্ণরাম/নিমিতা তাহার গ্রাম/জথা হৈল কালির মঙ্গল।/বসু নব বাণ ইন্দু/শক এই গুণসিন্ধু/বিচারিয়া বুঝহ সকল।।
অঙ্কস্য বামাগতি নীতি অনুসারে বসু ৮, নব ৯, বাণ ৫, ইন্দু ১ সূত্রে আমরা পেলাম ১৫৯৮ শকাব্দ, অর্থাৎ ১৬৭৬-'৭৭ খ্রি। তাছাড়া 'কালিকামঙ্গল'-এর রচনাকাল যে মুঘল আমলেই হয়েছিল, সে ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে দিয়েছেন কৃষ্ণরাম দাস 'কালিকামঙ্গল'-এ'-এ ‘আরংসাহা ক্ষিতিপাল’ এবং নবাব ‘সারিস্তা খাঁ’ অর্থাৎ ভারতের সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং বাংলার সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁ- এই দুই ঐতিহাসিক শাহপুরুষের কথা উল্লেখ করেন।
কৃষ্ণরাম কালিকামঙ্গল কাব্যে বেশ কয়েকবার কলকাতার নাম উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্যের হলো, তিনি যখনই জন্মগ্রাম নিমতার বা নিমিতার কথা লিখছেন, তখনই প্রসঙ্গক্রমে কলকাতার কথা উল্লেখ করছেন:
অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়/ধরণী নাহিক তুল/ জাহ্নবীর পূর্ব্বকুল/নিমিতা নামেতে গ্রাম যায়।
বা,
ভাগীরথীর পুর্ব্বতীর অপুরুব নাম/কলিকাতা বন্দিনু নিমিতা জন্মস্থান।
বা,
সপ্তগ্রাম সরকার/কলিকাতা নাম তার/পরগণা অনুপন ক্ষিতি।/সাবর্ণি চৌধুরী জায়/সর্ব্বলোকে গুণ গায়/পশ্চিমে আপনি ভাগীরথী।।
আমরা দেখলাম, বর্তমান দমদম বিমানবন্দরের কাছে নিমতা জনপদের কবি যখনই নিমতার কথা বলছেন, তিনি কিন্তু প্রতিবারই নিকটের শহর, উপনিবেশ-পূর্ব কলকাতার নাম উচ্চারণ করছেন। সেটা তিনি করছেন, কেননা, কলকাতা তখন নিশ্চয়ই সেই সময়কার মুঘল অর্থনীতির অন্যতম সরতাজ, সপ্তগ্রামের সমতুল বিখ্যাত জনপদ হয়ে উঠেছে। ফলে নিজের পাড়ার সঙ্গে তার প্রতিবেশী বিখ্যাত জনপদের নামজুড়ে তিনি তার ছটায় নিজের জন্মস্থানকে আলোকিত করতে চাইছেন। তাঁই তাঁর লেখায় নিমতার সঙ্গে সঙ্গেই বারবার কলকাতার নাম উঠে আসছে।
কৃষ্ণরামের সমসাময়িক আরেক কবি সনাতন ঘোষাল বিদ্যাবাগীশ। তাঁর নাম পাচ্ছি সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম বইতে। সনাতন ঘোষাল বিদ্যাবাগীশ সেই সময়ের পৌরাণিক ওডিশি শহর কটকে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের কয়েকটা স্কন্দ বাংলায় অনুবাদ করছিলেন। কাব্য রচনার সময়টা কী? প্রথম স্কন্দ শেষে তিনি লিখছেন:
কাল কলানিধি বিষ্ণুপদ কাল শশী।/ শাকে মিত্র তুলা ধরে পদ্মকান্ত বসি।।/ কৃষ্ণপক্ষ রবি তিথি তৃতীয় প্রহরে।/ সমাপ্ত হইল গ্রন্থ কটক নগরে।
কাল অর্থে সময়। অঙ্কস্য বামাগতি ধরে তাঁর সাহিত্য রচনাকাল হল ‘কলানিধি বিষ্ণুপদ কাল শশী শকাব্দ’ - কলানিধি= চন্দ্র ১, বিষ্ণুপদ= আকাশ ০, কাল= ঋতু ৬, শশী ১ অর্থাৎ, ১৬০১ শক, ১৬৭৯-'৮০ খ্রি:। নবম স্কন্দ অনুবাদ শেষের সময় তিনি আরেকটা ইঙ্গিতে ছেড়ে যাচ্ছেন:
গগনযুগল ঋতু সমুদ্রকুমার।/ শাক পরিমিত বীর বিক্রম বাজার।।
গগনযুগল দু'টি ০, ঋতু ৬, সমুদ্রকুমার = চন্দ্র ১, ১৬০০ শকাব্দ ১৬৭৮-'৭৯ খ্রি:।
নবম স্কন্দ শেষে সনাতন ঘোষাল নিজের পরিচয়ে আবশ্যিকভাবে কলকাতার নাম জুড়ছেন। তিনি লিখছেন,
কলিকাতা ঘোষাল বংশে কৃষ্ণানন্দ।/ তাঁর পুত্রভুবনবিদিত রামচন্দ্র।।/ তাঁহার মধ্যম পুত্র করি শিশু লীলা।/ ভাষাভাগবত বিদ্যাবাগীশ রচিলা।
হুগলির মুঘল ব্রিটিশ যুদ্ধ যখন শেষ হয়েছে, ব্রিটিশরা কলকাতায় আসার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, শোভা সিঙ্গির হ্যাঙ্গাম যখন দেড় দশক দূরে, তখনও কলকাতা থেকে দূর প্রবাসে থাকা কলকাতার এক বিখ্যাত পরিবারের পৌত্র কটকে বসে যখন পুরাণ অনুবাদ করছেন, তখনও তিনি কলকাতার স্থানমাহাত্ম্য ভুলছেন না। অর্থাৎ সনাতন ঘোষাল যখন কাব্য রচনা করছেন, তার বহু আগে থেকেই কলকাতা বিখ্যাত ভৌগোলিক এলাকা, না হলে কলকাতা থেকে ৫০০ কিমি দূরে বসে এক কবি নাহক কলকাতার গুণ গাইতেন না। আমরা ধরে নিতেই পারি, সনাতনের ঠাকুরদার জন্ম হয়েছিল মুঘল আমলের মধ্যগগনে আকবর বাদশার শেষ বা জাহাঙ্গির বাদশার শুরুর সময়ে– তিনিও ‘কলকাতার ঘোষাল বংশ’স-র সন্তান, অর্থাৎ তিনি যে পরিবারে জন্মাচ্ছেন সেই পরিবার আরও পুরনো, হতে পারে সুলতানি আমলের।
আমরা জানি, গোবিন্দপুর আর সুতানুটিকে গিলে খাওয়া ঔপনিবেশিক কলকাতার পাশের শহর সুতানুটি ছিল সুতার বাজার, হয়ত আড়ংও। তাঁতিরা তাঁত চালাতেন, দক্ষ মহিলারা শক্ত হাতে সুতো কাটতেন, হয়ত তুলো চাষও হত। এখান থেকে সুতো/বোনা কাপড় রপ্তানি হতো। হয়তো কলকাতা ছিল মূল বাণিজ্যকেন্দ্রও। ওপরে দুটো উদাহরণেই দেখলাম, সুতানুটির পাশের জনপদ কলকাতা বেশ বর্ধিষ্ণু এলাকা। অথচ ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস জানাচ্ছে কলকাতা একটা সাধারণ গ্রাম ছিল– উপনিবেশের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় তার রূপ পরিবর্তন ঘটে। সনাতন ঘোষালের কাব্যের খতিয়ান থেকে জানছি, ১৬০০ বা তার অনেক আগেই এখানে ব্রাহ্মণদের মতো পরান্নভোগী অর্থাৎ বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থায় অ-ভদ্রলোকদের উৎপাদনের উদবৃত্তে ভরণপোষণ করা ঘোষাল এবং চৌধুরী উপাধিধারী অন্তত দুটো বড়, প্রখ্যাত অভিজাত পরজীবী পরিবারের সন্ধান পাচ্ছি, যারা বহুকাল এই শহরে জাঁকিয়ে বসেছে। কালিকামঙ্গল-এর উদ্ধৃতিতে আগেই বলেছিলাম, কলকাতাতেই ১৬৭৬-'৭৭-এ ‘সাবর্ণি চৌধুরী’-দের বাসের উদাহরণ পাচ্ছি, যাদের ‘সর্ব্বলোকে গুণ’ গাইত। অর্থাৎ, সাবর্ণ চৌধুরীরা ব্রিটিশ ইতিহাসের প্রমাণে শুধু হালিশহর, বারাসাত বা বঁড়শেতেই রাজত্ব করত না, তাদের কলকাতাতেও বাস ছিল। এই ইতিহাস আমরা জানি না।
ইংরেজরা আসার পরে কলকাতার জন্ম এবং তার বন্দরের রমরমা, এই হিসেবটাতেও মোটা লাল কালির ঢ্যাঁড়া পড়ে ১৬৬০-এ আওরঙ্গজেবের রাজত্বের প্রথম আমলে ডাচ বণিক ভ্যান ডেন ব্রোকের মানচিত্র দর্শনে, সেখানে কলকাতা বা 'Calcutta' বন্দরের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় পূর্বে উল্লিখিত সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার প্রবন্ধে বলছেন, "বহুকাল হইল কলকাতার অধিবাসী বিখ্যাত আরমানী শ্রীযুক্ত Mesrov J Seth মেস্রোভ সেথ্ মহাশয় কলকাতার আরমানী গির্জায় সংযুক্ত গোরস্থানে প্রাচীন আরমানী সমাধি ফলকগুলির মধ্যে একখানিতে নিম্নপ্রমানে লিপি পাঠ করেন– এই সমাধি ফলক হইতেছে দানশীল বণিক সুকিয়াস্এর পত্নী Rezaneebeh রেজা বীবার।" কবরে যে তারিখ দেওয়া হয়েছে, তার থেকে এই সমাধিটা ১৬৩২ সনের প্রমাণ হয়। অর্থাৎ, জাহাঙ্গিরের সময়ে হুগলি বন্দরের এতই রমরমা যে, বন্দর স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ করেন সম্রাট তাঁর দপ্তরের মাধ্যমে, সেসময়ে কলকাতায় আরমানি বণিকেরা বাস করছে, অর্থাৎ ব্যবসাও করছে।
আমার ধারণা অনুসারে ব্রিটিশ-পরবর্তী সময়ে সব থেকে বেশি আলোচ্য মুঘল যুগের কবি যিনি, সেই মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে ব্রিটিশপূর্ব কলকাতার কথা জ্বলজ্বল করছে:
ধালিপাড়া মহাস্থান/ কলকাতা কুচিনান/দুই কুলে বসাইয়া বাট/ পাষাণে রচিত ঘাট/ দুকুলে যাত্রীর নাট/ কিঙ্করে বসায় নানা হাট।
এই পাঠটি বেশ কয়েকটা সংস্করণে মিলেছে। ফলে এই রচনাতেও কলকাতা প্রক্ষিপ্ত, অর্বাচীন- এমন কথা বলা যাবে না। মুকুন্দরাম ১৬২৪-এ, অর্থাৎ জাহাঙ্গির শাহের আমলে হুগলি থেকে পর্তুগিজ উচ্ছেদের চার বছর আগে লেখা শেষ করছেন।
আমরা আরও একটু পিছোই। সালটা ১৫৮৫। সে বছরই শেষ হয় আইন ই আকবরি সংকলন। আকবর শাহ সম্রাটের ভরা রাজত্ব। তিনি আরও বিশ বছর রাজত্ব করবেন। আইন-ই আকবরির দ্বিতীয় খণ্ডে সরকার বা মহাল বা পরগণাগুলোর তালিকায় সাতগাঁও সরকারের অধীনে কলকাতার নাম লিখছেন। সুখময় মুখোপাধ্যায় আইন-ই আকবরিতে কলকাতা ভৌগোলিক খণ্ডের নামের উল্লেখ বিষয়ে 'ইংরেজ-পূর্ব যুগের কলকাতা' প্রবন্ধে বলছেন, এর আগে বহুবার আইন-ই-আকবরিতে কলকাতা নামের উল্লেখের কথা বলা হলেও ঐতিহাসিকরা, সমাজতাত্ত্বিকরা একে লিপিকরের প্রমাদ হিসেবে দেখেছেন। তাদের দাবি, লিপিকরদের ভুলে কালনা বা পলতার জায়গায় কলকাতা হয়েছে। আকবরের সময় যে সুবা বিভাগ পাওয়া যাচ্ছে, সেটা তার প্রায় ১০০ বছর পরেও তাঁর নাতির পুত্র আওরঙ্গজেব শাহের সময় অক্ষুণ্ণ ছিল। আকবর যে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে যান, সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত সম্রাটরা শাসন করেছেন। কালিকামঙ্গলে উল্লিখিত আছে:
অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়/ধরণী নাহিক তুল/ জাহ্নবীর পূর্ব্বকুল/নিমিতা নামেতে গ্রাম যায়।
বা,
সপ্তগ্রাম সরকার/কলিকাতা নাম তার/পরগণা অনুপন ক্ষিতি।/সাবর্ণি চৌধুরী জায়/সর্ব্বলোকে গুণ গায়/পশ্চিমে আপনি ভাগীরথী।।
শুধু ব্রিটিশ-পূর্ব কলকাতার নামই নয়, কলকাতার বহুবাজার পাড়ারও উল্লেখ পাচ্ছি জনৈক কৃষ্ণদাসের 'নারদপুরাণ' কাব্যে। তিনি স্ব-পরিচয় পর্বে লিখছেন,
আপনি কনিষ্ঠ মোর রামকৃষ্ণ নাম।/ সাকম কলকাতা বহুবাজারে ধাম।।
এর পরেই তিনি লিখছেন:
দশ দশ শত নিরেনব্বুই সালে।/ মাহ জৈষ্ঠ মাসে এই পুস্তক রচিলে।।
১০৯৯ বঙ্গাব্দ, ১৬৯২ খ্রি:। শুধু কলকাতা নয়, কলকাতার মধ্যে বহুবাজারও বিখ্যাত স্থান।
১৭৮৮-তে গোলাম হোসেনের লেখা 'রিয়াজুসসালাতিন'-এ কলকাতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে:
সে স্থানে কালীমূর্তি ছিল, তার পুজোর খরচ নির্বাহের জন্যে ঐ অঞ্চলের আয় নির্ধারিত ছিল। বাংলায় কর্তা শব্দের মানে হল প্রভু। তাই ঐ স্থান কালীকর্তা কিন্তু উচ্চারণে ব্যতিক্রম হয়ে কলিকাতা নামে পরিচিত হয়েছে।
'রিয়াজুসসালাতিন' যখন লেখা হয়, তখন কলকাতা প্রতিষ্ঠিত শহর। ফলে এই শহরের নাম সম্বন্ধে চালু মূল মিথগুলো তিনি অনেক ভালো জানবেন।
ওপরে উল্লিখিত বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে বলতে পারি, কলকাতা শুধু লুঠেরা ইংরেজদের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে তৈরি হয়নি, এর উদ্ভব অনেক অনেক পুরনো। কলকাতার প্রাচীনত্ব আরও অনেক ঐতিহাসিকতায় আছন্ন। কলকাতার প্রাচীনত্ব প্রমাণে যে প্রত্নতাত্ত্বিক বয়ান দিয়ে আমরা প্রবন্ধ শুরু করেছিলাম, কখনও সেই প্রমাণ-দেবীর কোলেই আমাদের হয়তো কখনও না কখনও ফিরে যাওয়ার সুযোগ হলেও হতে পারে, এই আশায় প্রবন্ধে ইতি টানলাম।