দিনের শেষে ভরসা সেই 'বাহা শাড়ি', শহুরে মঞ্চ কি সত্যিই লোকনাট্যের সঙ্গে সুবিচার করেছে?
Folk drama theatre in Bengal : আমরা যাকে লোকসংস্কৃতি বলে গ্রহণ করি সেটি প্রকৃত লোকজীবনের থেকে অনেকটাই দূরে, শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা।
প্রসেনিয়ামে লোকনাট্যের সঙ্গে সুবিচার করা হচ্ছে কি না, এটা বোঝার আগে বুঝে নিতে হবে লোকনাট্য কাকে বলে ও তার ব্যাপ্তি কতটা। আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয় লোকনাট্যর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “লোকনাট্য লোকজীবনের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুখে মুখে রচিত এবং অভিনীত নাটক। কোনও পৌরাণিক কিংবা ঐতিহাসিক কাহিনী তার ভিতর প্রবেশ করা সঙ্গত নয়। তার কাহিনীতে পূর্ববর্তী কোনও ধারা কিংবা ঐতিহ্যও থাকে না”।
বরুণ কুমার চক্রবর্তী এই সূত্রে বলেছেন-
“আমরা গণতন্ত্রের সংজ্ঞার অনুকরণে বলতে পারি লোকেদের দ্বারা অনুষ্ঠিত, লোকেদের জন্য অভিনীত, লোকেদের দ্বারা আদৃত মূলত লোক বিষয়ক যে নাটক তাই হল লোকনাট্য”।
এঁদের ভাবনার সূত্র থেকে মোটামুটি লোকনাট্য সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শহুরে প্রসেনিয়াম মঞ্চে যে জিনিসটিকে লোকনাট্য বা লোক আঙ্গিক বলে অবিরাম শহুরে দর্শককে বেচার ও খাওয়ানোর চেষ্টা চলে, সেটি আদৌ কতটা লোকনাট্যর গুণ সম্পন্ন হয়। যদি বরুণ বাবুর সংজ্ঞা ধরেই মেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে – না এইসব নাটক বিশেষ জনগোষ্ঠীর ‘লোক’দের দ্বারা অনুষ্ঠিত, না ‘লোক’দের জন্য অভিনীত। কিছু শহুরে মানুষ (সবাই নয়) তাদের শহুরে মনন দিয়ে লোকসংস্কৃতিকে কিছুটা বুঝে এবং অনেকটা না বুঝে শহুরে মানুষের সন্ধ্যা উদযাপনের জন্য শহুরে মানুষদের মতো করে একটি নাট্যনির্মাণ করেন যাকে ‘লোক আঙ্গিকের নাট্য’ হিসাবে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়। লোকনাট্যর শিল্পীদের যে মনন, দর্শন, তাঁদের জীবনচর্যা কোনোটাই এই নাট্য নির্মাণে থাকেনা এবং থাকা সম্ভবও নয়। কিছুটা বাহ্যিক আহার্য অভিনয়ের উপর ভিত্তি করে (ট্রাইব সুলভ কস্টিউম, ধামসা মাদল ও ওই জাতীয় কিছু লোক-বাদ্যযন্ত্র, মুখোশ প্রভৃতি) একটা লোকনাট্যর রূপ দান করার চেষ্টা হয় মাত্র নাটকগুলোয়।
অবশ্যই সব নাট্য প্রয়োজনা এই দোষে দুষ্ট নয়। ‘মারীচ সংবাদ’, ‘মাধব মালঞ্চি কইন্যা’, ‘নাচনী’ প্রমুখ নাটক সত্যিই অবিস্মরণীয় এবং বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের মাইলফলক। তবে গত ১০-১৫ বছরে শহুরে মানুষের বিনোদন বিষয়ক ভোক্তা হৃদয় হঠাৎ অনেকটা বাঁক বদল করেছে। আমাদের শিশুকালেও সম্ভবত ব্যাপারটা এরকম ছিল না, আমাদের কৈশোর যৌবনে উত্তীর্ণ হতে হতে গোটা চিত্রটাই পরিবর্তিত হতে দেখা গেল। শহুরে মানুষ ‘লোক-সংস্কৃতি’ রক্ষা করার হাতিয়ার হিসাবে দেওয়ালে মাদুর লাগানো, বাউল গান হিসাবে ‘তোমায় হৃদমাঝারে রাখব’ শোনা, সিরিয়াল দেখে ‘বাহা শাড়ি’ পরা ইত্যাদিকে বেছে নিতে শুরু করল। স্বাভাবিকভাবেই বাহ্যিকভাবে লোক-সংস্কৃতি আরোপিত প্রযোজনাগুলির দিকে থিয়েটারের দর্শক ঝুঁকলো। এটা মনে রাখতে হবে যে থিয়েটারের দর্শক মূলত কিন্ত শহুরে খেতে পরতে পাওয়া শিক্ষিত জনগণ। এই মানুষদের মনে লোকনাট্য ও লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে যে ধারণা আছে সেটা অনেক অংশেই ওয়ান ডাইমেনশনাল বা এক পাক্ষিক। এটাও সম্ভব যে শহুরে দর্শকের কাছে লোক নাট্যের যা ধারণা সেটির সঙ্গে গ্রামের লোকজীবনের প্রকৃত লোক-সংস্কৃতি ও লোক নাট্যের ধারণার যোজন খানেক পার্থক্য।
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা যায়। গত ১৪ নভেম্বরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড দীপা চট্টোপাধ্যায় ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’। বক্তা ছিলেন নট দেবশঙ্কর হালদার। বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল মঞ্চে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে সেতু তৈরি করা। এই প্রসঙ্গে দেবশঙ্কর ২০০৩ সালের একটি ঘটনা বলেন। বাংলার একটি গ্রামে ‘নান্দীকার’ তাদের দু'টি নাটক নিয়ে একটি নাট্য উৎসব করতে যায়। একটি নাটক ‘শেষ সাক্ষাৎকার’, যেটি ছিল একটি আরবান ড্রামা। অন্যটি ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ যে নাটকটিতে গ্রামের গল্প, গ্রামের মানুষের গল্প আছে। নান্দীকারের কথামতো উদ্যোক্তারা একটি অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করেন, যার মূল উপকরণ বাঁশ। নান্দীকার ভাবে যে, যেহেতু গ্রামের দর্শক, তাই তাদের শহুরে নাটক পছন্দ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেইজন্য তারা প্রথমদিন দর্শক ধরে রাখার জন্য গ্রাম কেন্দ্রিক নাটক ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত নেন। ততদিনে ‘সোজন’-এর অনেকগুলি শো হয়ে যাওয়ার কারণে অভিনেতাদের একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল, কোন জায়গায় হাততালি পড়া উচিৎ। কিন্তু দেখা গেল, সেই গান বাজনা সংবলিত গ্রামের গল্প মঞ্চে দেখে গ্রামের মানুষ কোনওরকম প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। গোটা অভিনয়তে একবারের জন্যও হাততালি পড়ল না।
এই রিঅ্যাকশনের পর নান্দীকারের মানুষজন খুব হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মনে একটা ভয় চেপে বসেছিল যে পরদিন এই ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ দেখে ‘আরবান’ নাটক লোকজন আর দেখবেন না। কিন্তু এক্ষেত্রেও আবার ফল হল উল্টো। দেখা গেল সেই শহুরে নাটক গ্রাম্য জনতা আরও বেশি গ্রহণ করলেন। অভিনেতাদের সঙ্গেও দর্শকদের একটা যোগ স্থাপন হল।
এখন থেকে একটা খুব স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে। আমরা যে বস্তুটিকে লোকসংস্কৃতি বলে গ্রহণ করি সেটি প্রকৃত লোকজীবনের থেকে অনেকটাই দূরবর্তী ও একদমই শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। একে আদতেও ‘ফোক লোর’(Folklore) বলা যায় না, যা বলা যায় তা হল ‘ফেক লোর’ (Fakelore)। কারণ এইসকল অভিনেতা, নির্মাতা ও শিল্পীরা সেই লোকজ যাপনের মধ্যে বেড়ে ওঠেননি, সেই যাপনকে ধারণ করে বেড়ে ওঠেননি। কাজেই যখন সেই উপস্থাপন প্রকৃত লোকজীবনের মধ্যে গিয়ে পড়ে তখন দর্শক তার সঙ্গে নিজেদের রিলেট করতে পারেন না। দেবশঙ্কর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, ‘সোজনে’র যে বাঁশের সাঁকো একাডেমির মঞ্চে একটা অন্যরকম প্রতীতি তৈরি করে। গ্রামের বাঁশের মঞ্চে সেই বাঁশের সাঁকো আলাদা কোনও প্রতীতি তৈরি করে না।
এই আলোচনা থেকে যে জায়গাটায় পৌঁছনোর চেষ্টা করা হল। আমরা শহুরে নাট্যমঞ্চে যে বিষয়টিকে লোক-সংস্কৃতি বা লোকনাট্য বলে চিনি সেটা আদতে কতটা লোকনাট্যের দর্শন দ্বারা পরিচালিত? আর কতটা লোকনাট্যর বাহ্যিক আড়ম্বর দ্বারা ‘সারফেস লেভেল’এ চালিত? এইটাও বোঝার চেষ্টা করা হল, যে চোখ দিয়ে আমরা শহুরে সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি বিচার করছি, সেই চোখটি সম্পূর্ণভাবে শহুরে চোখ, সেই চোখ দিয়ে নিরপেক্ষ ও সঠিক বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।