কী আছে তাজমহলের বিতর্কিত ২২টি ঘরে?
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার আগ্রা সার্কেলের একজন আধিকারিক জানিয়েছেন, এই কাঠামোগুলো তাজমহলের পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সময়ে সময়ে এএসআই সমীক্ষা চালিয়েছে।
তাজমহল বনাম তেজো মহালয় বিতর্কের মাঝেই এবার বিতর্কিত ২২টি কক্ষের ছবি প্রকাশ করল আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। বেশ কিছু বছর ধরেই বিজেপির তরফে দাবি করা হয়েছে, তাজমহল আসলে তেজো মহালয়। তাজমহলে সম্রাট শাহজাহান নির্মিত বেগম মমতাজের সমাধির নিচে আসলে ছিল এক প্রাচীন শিবলিঙ্গ। মুঘলরা সেই মন্দির ও শিবলিঙ্গ ধ্বংস করে তার ওপর নির্মাণ করেছে তাদের স্থাপত্য। সম্প্রতি 'তাজমহলের নেপথ্যে রয়েছে তেজো মহালয়', এই দাবি নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন অযোধ্যার বিজেপি নেতা রজনীশ সিং। এলাহাবাদ হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাজমহলের ভেতরের বাইশটি কক্ষ খোলার আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। মামলার শুনানিতে বিচারপতি সুভাষ বিদ্যার্থী এবং দেবেন্দ্রকুমার উপাধ্যায়ের বেঞ্চ জানিয়েছিল, "এই জাতীয় বিষয়গুলি একান্তই পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ এবং ইতিহাসবিদদের বিতর্কের বিষয়। এই ধরনের কোনও সাম্প্রদায়িক বিতর্ক আদালত আর গ্রহণ করবে না।"
এর পরেই কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া তাজমহলের অন্দরের ঘরের ছবি প্রকাশ করে। এএসআই ছবিগুলো প্রকাশ করে একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, "এই কুঠুরিগুলোতে কোনও গোপনীয়তা নেই। মূল কাঠামোর অংশ হিসেবেই এইগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রাচীনকালের অনেক স্থাপত্যেই এর নমুনা পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে দিল্লিতে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি।এএসআইয়ের কর্মীরা নিয়মিত এই কক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং তারা দেওয়ালে সন্দেহজনক কিছুই পাননি।"
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাজমহলে প্রায় প্রতিদিন এক লক্ষের ওপর লোক আসেন। ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তাজমহলের এই নিচের ঘরগুলিতে প্রবেশাধিকার দিলে তা সংরক্ষণের কাজে অসুবিধে হতে পারে। সেই কারণেই দীর্ঘদিন তালা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এই ঘরগুলো।
আরও পড়ুন: কুতুব মিনার নিয়েও বিতর্ক! কারা, কেন ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করতে ?
প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক কে. কে. মুহাম্মদ এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার উত্তর শাখার প্রাক্তন আঞ্চলিক পরিচালক এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, "তাজমহলের বেসমেন্টে আমি কোনও ধর্মীয় মোটিফ লক্ষ্য করিনি। আগ্রার তাজমহল, হুমায়ুনের সমাধি এবং দিল্লির সফদরজং এর সমাধিতে ও এই ধরনের কক্ষগুলি দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোকে মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে আলাদা করে কোনও ধর্মীয় নিদর্শন নেই।"
আবার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার আগ্রা সার্কেলের একজন আধিকারিক জানিয়েছেন, এই কাঠামোগুলো তাজমহলের পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সময়ে সময়ে এএসআই সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে শিবলিঙ্গ বা প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, এমন কোনও কিছুই তাদের সমীক্ষায় উঠে আসেনি। তাজমহলের ইতিহাস বলতে গিয়ে কে. কে. মুহাম্মদ জানিয়েছেন, শাহজাহানের রাজত্বকালের সরকারি হিসেব খাতা বাদশাহনামাতে তাজমহলের প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৬৩১ সালে সম্রাট শাহজাহানের চতুর্দশ সন্তান কন্যা গৌহর বেগমের জন্মের সময় তাঁর স্ত্রী মুমতাজ বেগমের মৃত্যু হয়। এরপরেই স্ত্রী-শোকে কাতর শাহজাহান এই সমাধিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ১৬৩২ সাল থেকে ১৬৪৮-এর মধ্যে তাজমহলের মূল কাঠামো নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। তার পরের পাঁচ বছরের মধ্যে বাইরের বাগান ও অন্যান্য অংশ নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৬৫৩ সালে সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ হয় তাজমহলের। তাজমহল নির্মাণের নেপথ্যে ছিলেন একাধিক স্থপতি। পারস্যের স্থপতি ওস্তাদ ইসা চত্বরের নকশা করেন। তাজমহলের বড় গম্বুজটির নকশা করেছিলেন অটোমান থেকে আসা ইসমাইল খান। লাহোরের স্থপতি কাজিম খাঁ প্রধান গম্বুজের চূড়ায় অবস্থিত স্বর্ণদণ্ডটি নির্মাণ করেন। এছাড়াও গোটা তাজমহল নির্মাণের নেপথ্যে কাজ করেছিলেন চিরঞ্জিলাল এবং আমানত খাঁ, যাঁদের নাম খোদাই করা আছে তাজমহলের মূল প্রবেশ পথে।
মুঘল জমানার বিভিন্ন সময়ে স্থাপত্যরীতির মিশেলে নির্মিত হয়েছিল তাজমহল। গম্বুজাকৃতি, জালিস ইত্যাদি সমস্ত রকমের মুঘল স্থাপত্যশৈলি ব্যবহার করেই শাহজাহান তার প্রিয় বেগমের জন্য তাজমহল নির্মাণ করেন, যা পৃথিবীর একটি অনন্য সৃষ্টি।
তাজমহল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত এএসআই-এর আগ্রা সেল জানিয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যমুনার নদীখাত লাগোয়া ভূগর্ভস্থ ঘরগুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়েছিল। সেই সময়ই তাজমহলের ছবি তোলা হয়। বর্তমানে ওঠা বিতর্কের সমাধান ঘটাতেই তারা এই ছবি প্রকাশ্যে এনেছে।