সন্ত্রাস নাকি স্বাধীনতার লড়াই? কেন বারবার রক্তাক্ত বালুচিস্তান?
Balochistan Attack: রবিবার ভোর রাতে রারাশাম এলাকার জঙ্গি-হামলার পর কার্যত শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। তার পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই একের পর এক বড় বড় হামলা।
একদিন আগেই বালুচিস্তানে বাস থেকে নামিয়ে রীতিমতো পরিচয়পত্র দেখে দেখে খুন করা হয়েছে ২৩ জন পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দাকে। সেই ঘটনায় কার্যত শিউরে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। এই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক বার পঞ্জাব প্রদেশের মানুষদের সঙ্গে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ঘটেছে। রবিবার ভোররাতে বালুচিস্তানের মুসাখেলের ঘটনার পর নড়েচড়ে উঠেছিল প্রশাসন। তা সত্ত্বেও আটকানো গেল না। রবিবার ভোর রাতের পর সোমবার বালুচিস্তানে আরও বড় হামলায় কেঁপে উঠল গোটা পাকিস্তান। অন্তত ৬টি হামলায় মৃত্যু হল অন্তত ৭৪ জনের।
সোমবার সকাল থেকে পাকিস্তানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বালুচিস্তানে পর পর হামলা চালানো হয়। দিন কয়েক ধরেই সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথাচাড়া দিয়েছে বালুচিস্তানে। পুলিশ স্টেশন, রেললাইন ও রাস্তা লক্ষ্য করে প্রায় ৬টি হামলা চালায় জঙ্গিরা। যাতে নিরাপত্তাবাহিনী ও সাধারণ নাগরিক-সহ অন্তত ৭৩ জন নাগরিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। সর্বশেষ হামলার দায় নিয়েছে বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)।
আরও পড়ুন: বাস থেকে নামিয়ে তালিবানি কায়দায় খুন! পাকিস্তানে কেন বারবার জঙ্গি-নিশানায় পঞ্জাবের মানুষজন?
রবিবার ভোর রাতে বালুচিস্তান ও পঞ্জাব সীমান্ত সংলগ্ন মুসাখেল জেলার রারাশাম এলাকায় সবচেয়ে মারাত্মক হামলাটি ঘটে। বাস, ট্রাকের রাস্তা অবরোধ করে সেখানে দাঁড়িয়েছিল কয়েক জন সশস্ত্র জঙ্গি। এরপরে যাত্রীদের বাস, ট্রাক থেকে নামিয়ে পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখে তারপর। এবং সেখান থেকে পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দাদের বেছে নিয়ে তাঁদের খুন করা হয়। সেই হামলায় মোট ২৩ জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে ৩ জন বালুচিস্তানের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। সেই হামলার ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ।
তার পর সোমবারই কোয়েটা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে কালাত জেলায় ল এনফোর্সমেন্ট আধিকারিকদের নিশানা করে হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেই হামলায় অন্তত দশ জনের মৃত্যু হয়। এদিকে কোয়েট্টার দক্ষিণ-পূর্বে বোলান জেলায় চলে আরও একটি হামলা। যেখানে ৬ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে চার জন পঞ্জাবের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তরফে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, অন্য একটি হামলায় পাঁচ নিরাপত্তা আধিকারিক-সহ মোট ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই হামলায়। নিরাপত্তা বাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, পাল্টা হামলায় ২১ জন জঙ্গিরও মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।
এর আগেও বারবার এই ধরনের জঙ্গি হামলার মুখোমুখি হয়েছে বালুচিস্তান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিশানা করা হয়েছে সাধারণ মানুষ, ল এনফোর্সমেন্ট অফিসার বা পুলিশ-প্রশাসনকে নিশানা করে। গত বছর মে মাসেও নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে এমনই বড় ধরনের হামলা হয়েছিল। পঞ্জাবের কাছে মহাসড়ক, রেললাইনে নানাভাবে ক্ষয়ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে জঙ্গিরা। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে পঞ্জাবকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা।
কেন বারবার জঙ্গিদের নিশানার মুখে পঞ্জাব প্রদেশ? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পাকিস্তানের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী প্রদেশ পঞ্জাব। সে কারণেই কি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বারবার নিশানা করছে সেই জায়গাটিকে বারবার নিশানা করা হচ্ছে। কার্যত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তরফে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, বালুচিস্তানে বহিরাগতরা কোনও ভাবেই নিরাপদ নয়। চিন থেকে বহু নাগরিক বিভিন্ন কাজ নিয়ে প্রায়শই বালুচিস্তানে আসেন। পঞ্জাবের বাসিন্দা, নিরাপত্তা কর্মীদের পাশাপাশি তাঁদেরকেও নিশানা করার চেষ্টা করছে বিচ্ছিন্নতাকামীরা।
আরও পড়ুন: এবার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত! দেনায় ডোবা পাকিস্তানের জন্যে কী অপেক্ষা করছে?
রবিবার ভোর রাতে রারাশাম এলাকার জঙ্গি-হামলার পর কার্যত শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। তার পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই একের পর এক বড় বড় হামলা। রারাশামের হামলার পর ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আল জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে এই ঘটনার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন সরকার গঠন হয়েছে পাকিস্তানে। দেশের আর্থিক পরিকাঠামো সামলাতে হিমশিম পরিস্থিতি যে সরকারের। তার মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাথাচাড়া দেওয়ার অর্থ কি আদতে সরকারকেই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা? কী চাইছে আসলে বিচ্ছিন্নতাকামীরা। আদতে কি সন্ত্রাস না স্বাধীনতার লড়াই এটা বিচ্ছিন্নতাকামীদের? উঠছে সেই প্রশ্নও।
২০০০ সাল থেকেই পাকিস্তানে সক্রিয় রয়েছে বালুচ আর্মি লিবারেশন। অবশ্য শুরুটা হয়েছিল আরও আগেই। ১৯৭০ সালে এথনিক বালুচ গ্রুপের সঙ্গে পাকিস্তান মিলিটারির সংঘাত শুরু হয়েছিল প্রদেশের অধিকার নিয়ে। সেই থেকেই এই সংঘাত চলছে। ২০০৮ সালে জঙ্গি হিসেবে দেগে দেওয়া হয় বিএলএ-কে। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে বিএলএ-কে দেগে দেয় আমেরিকাও। বিএলএ দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি করে আসছে। প্রদেশের খনিজ ও গ্যাস সম্পদের শোষন নিয়েও পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের লড়াই দীর্ঘদিনের। বিদেশি শক্তি সমর্থিত সংস্থান প্রকল্পগুলি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে তারা। চিনের উপরে অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটাই নির্ভরশীল পাকিস্তান। সে ব্যাপারটিকেও ভালো ভাবে দেখে না বিএলএ। এই পরিস্থিতিতে বালুচিস্তানে চিনা নাগরিকদের উপর হামলার ঘটনার মাধ্যমে সেই বার্তাই কি দিতে চাইছে তারা আন্তর্জাতিক মহলে?