ফুল হাতে পায়ের নীচে বসে রাজ কাপুর, তবুও কেন মুখের ওপর 'না' বলেছিলেন সুচিত্রা সেন?
Suchitra Sen Raj Kapoor : সঙ্গে অভিনয় তো বটেই; প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্যও তিনি অনন্যা। আক্ষরিক অর্থেই বাংলা নয়, ভারতের সিনে ইতিহাসের একটা অধ্যায়ও বটে তিনি।
তাঁর কথা সামনে আসলে কেবল অভিনয় কিংবা সৌন্দর্য নয়, উঠে আসে প্রবল ব্যক্তিত্বের কথা। যে ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকেই মাথা নুইয়ে আসে। তাঁর কথা বললে অবধারিতভাবে আরেকজনও চলে আসেন, কিংবদন্তি অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বো। সুচিত্রা সেন আসলে বাঙালির যাবতীয় সংস্কৃতি, সিনেমা, স্পর্ধার মধ্যে লুকিয়ে আছেন। বাংলার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। আর হবেন নাই বা কেন! তিনি যে মহানায়িকা! বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ‘ম্যাডাম সেন’। যিনি নিজেকে জায়গা নিজে তৈরি করেছিলেন, ধরেও রেখেছিলেন সেই তেজে। অমন ভুবনমোহিনী রূপ আর হাসি, সঙ্গে অভিনয় তো বটেই; প্রবল ব্যক্তিত্বের জন্যও তিনি অনন্যা। আক্ষরিক অর্থেই বাংলা নয়, ভারতের সিনে ইতিহাসের একটা অধ্যায়ও বটে তিনি।
সুচিত্রা সেন বললেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চলে আসবে উত্তম কুমারের নাম। দু’জনের জুটি তৈরি করেছিল একের পর এক ইতিহাস। যার সাক্ষী থেকেছিল আপামর বাংলা। মনে রাখবেন, এটা সেই সময়, যখন নায়করাই পর্দায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেতেন। নায়িকাদের থেকে বেতনও বেশি হতো তাঁদের। এখনও যে পরিস্থিতি একেবারে উল্টে গিয়েছে তা নয়, তবে বদল এসেছে। আর সেই বদলের শুরুটা হয়েছিল সুচিত্রা সেনের হাত ধরেই। শ্যুটিংয়ে কোনও কারণে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে চলে যাওয়া মানে সিনেমা ‘প্যাক আপ’। পরিচালকেরও মাথায় হাত।
কেন? তিনি যে ‘ম্যাডাম সেন’! তাঁর মুখের ওপর কোনও কথা চলে নাকি! একসময় সুচিত্রা সেনের দাবিও ছিল পারিশ্রমিক উত্তম কুমারের সমান করার। এও বলেছিলেন, পোস্টারে যেন ‘উত্তম-সুচিত্রা’ না যায়; সবসময় লেখা থাকবে ‘সুচিত্রা-উত্তম’। ‘ফেমিনিজম’ শব্দটি আধুনিক পৃথিবীতে প্রায়শই ব্যবহার করা হয়। নারীর অধিকার, নারী স্বাধীনতার কথা বলা হয়। আজ থেকে অন্তত ৪০-৫০ বছর আগে সেই কাজটাই শুরু করেছিলেন সুচিত্রা সেন। এমনি এমনি সম্মান নয়; নিজের প্রতিভায়, পরিশ্রমের জেরে অর্জিত সেই গৌরব, সেই সিংহাসন।
আরও পড়ুন : আদৌ কোনও বাইকে চড়েননি উত্তম-সুচিত্রা! কীভাবে শ্যুটিং হয়েছিল সপ্তপদী ছবির বিখ্যাত দৃশ্য?
তবে কেবল বাংলা সিনে জগতই নয়, বলিউডও সাক্ষী থেকেছিল মহানায়িকার এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের। বাংলায় অগুনতি ছবি করলেও বলিউডের মাটিতে খুব বেশি ছবি করেননি সুচিত্রা সেন। ১৯৫৫ সালে প্রথমবার বলিউডের পর্দায় উঠে আসেন তিনি, আর বিপরীতে কে? দিলীপ কুমার! মুক্তি পেয়েছিল ‘দেবদাস’। বাকিটা ইতিহাস। দিলীপ কুমার, বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে ‘পারো’র ভূমিকায় সুচিত্রা সেন ছিলেন অনন্য। তাঁর বাঙালি উচ্চারণে হিন্দি শুনে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন দিলীপ কুমারও। এর পাঁচবছর পর ফের একটি হিন্দি ছবি, নাম ‘বোম্বাই কা বাবু’। একদিকে সুচিত্রা, অন্যদিকে দেব আনন্দ।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল সুচিত্রা-সঞ্জীব কাপুরের ‘আন্ধি’। মহানায়িকার কেরিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সিনেমায় বেশ কঠিন চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন। যদিও সুচিত্রার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান প্রত্যেকে। মনে করা হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আদলে তৈরি করা হয়েছিল ম্যাডাম সেনের চরিত্রটি। গুলজারের পরিচালনায় মুক্তি পাওয়া এই ছবিটিকে একসময় ব্যানও করে দেওয়া হয়েছিল। তবে এসবের বাইরেও থেকে গিয়েছে আরও একটি গোপন ঘটনা। না, এই ঘটনা কোনও পর্দায় উঠে আসেনি। কিন্তু সুচিত্রা সেনের গাম্ভীর্য, তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রবলভাবে উঠে আসে এখানে। যে ঘটনার অন্যপিঠে রয়েছেন আরেক কিংবদন্তি, রাজ কাপুর।
তখন সুচিত্রা সেন মধ্যগগনে। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। এমন সময়ই তাঁর কাছে সিনেমার অফার আনেন খোদ রাজ কাপুর। তাঁর সম্পর্কে নতুন করে বলার নিশ্চয়ই অবকাশ নেই। তিনি চান, সুচিত্রা সেন তাঁর সিনেমার প্রধান নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করুন। এমন সৌন্দর্য যার, তাঁকে পর্দায় না ধরলে যে অন্যায় হবে! কিন্তু রাজ কাপুর তখনও সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তবে জেনে গেলেন খানিক পরেই।
আরও পড়ুন : গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় প্রথম গানেই কিস্তিমাত, কেন হারিয়ে গেলেন ‘গায়িকা’ সুচিত্রা সেন
এক সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা সেন বলেছিলেন সেই ঘটনার কথা। ছবির নায়িকার রোল অফার করতে সটান তাঁর বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজ কাপুর। যেই সুচিত্রা নিজের সোফায় বসলেন, অমনি এক কাণ্ড করে বসলেন রাজ। সুচিত্রার পায়ের নীচে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন। আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। হাতে থাকা গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিলেন মহানায়িকার দিকে। এমন সৌন্দর্যের সামনে মাথা নত করে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন সুচিত্রা সেন। এবং তখনই, রাজ কাপুরের মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন, তিনি দুঃখিত। কিন্তু এই সিনেমায় অভিনয় করতে তিনি পারবেন না। তাঁর চেহারায় যেন ফুটে বেরোচ্ছিল ব্যক্তিত্বের ঝলক। রাজ কাপুরের মতো অমন সুপারস্টারও হকচকিয়ে গেলেন। পরে সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা বলেছিলেন, তাঁর রাজ কাপুরের স্বভাব মোটেও ভালো লাগেনি। এক পুরুষ ফুলের তোড়া এনে মেয়ের পায়ের কাছে এসে বসে পড়বে, এমন চরিত্রবানদের তিনি কখনই পছন্দ করতেন না। সুচিত্রাই বলেছেন, চেহারা নয়, মানুষের ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তা আর বুদ্ধিমত্তাই তাঁকে আকর্ষণ করে। সেখানে রাজ কাপুরের এই স্বভাব একেবারেই মানতে পারেননি সুচিত্রা সেন। তাই একেবারে মুখের ওপরই না করে দিয়ে বেরিয়ে যান।