মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?

Snake Venom: হানি ব্যাজারের চামড়াই এত মোটা যে সাপের বিষ দাঁতের পক্ষে সম্ভব নয় সেই চামড়া ভেদ করা

তিনি বলেছিলেন এক ছোবলেই ছবি (অবশ্য আপনি যদি না স্টিভ লুডউইক হন। সেই রক মিউজি়ক গায়ক, যিনি প্রেমিকার বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণের কথা বেমক্কা ভুলে যেতেন। কারণ তিনি একাধিক সাপের বিষ শরীরে ইঞ্জেক্ট করে নেশা করে পড়ে আছেন)। অথচ জঙ্গলের বেশ কিছু প্রাণী দিব্যি সাপের বিষ শরীরে ঢোকার পর বা বিষাক্ত সাপের কামড় খাওয়ার পরও বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে থাকে। এ এক বিস্ময়। আমাদের বিষাক্ত সাপে কামড়ালে আমরা সময়ে চিকিৎসা না পেলে মারা যাবই অথচ বনের কিছু কিছু প্রাণী দিব্যি বেঁচে থাকবে! এমনটা কেন হতে পারে, সেই আলোচনায় আসার আগে একটা মজার ঘটনা বলা যাক।

১৯৭৬ সালে টেক্সাসের এগ্রিকালচার অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা একবার গবেষণার কাজে ল্যাবে রাখা একটি সাপকে Woodrat খেতে দেন। আবার যে-সে সাপ নয়, একদম rattle snake। সাপটা প্রথমে বিষদাঁত তুলে Woodrat-কে কামড়ানোর চেষ্টা করল। সাধারণত এই বিষদাঁত দিয়ে কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় শরীরের ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, লিভারে রক্ত জমাট বাঁধে এবং শেষমেশ হৃদযন্ত্র অচল হয়ে আসে। কিন্তু সেসব হওয়ার বদলে দেখা গেল সে দিব্যি Rattle snake-এর দিকে পিটপিট করে চেয়ে আছে।

Rattle Snake

এখানে বলে রাখা ভালো, Woodrat-ও মোটেই নির্বিষ নয়। তাই বলে সে Rattle snake-এর মতো প্রাণীকে কুপোকাত করতে পারে এমনটাও নয়। কারণ সে আকারে বেশ ছোটোই। কিন্তু দেখা গেল Woodrat-ও তার বিষদাঁত তুলে Rattle snake-কে কামড়ানোর চেষ্টা করছে। সেই ঘটনা থেকে যা মর্মোদ্ধার করা গেল তা হল, Rattle snake-এর মতো ভয়ানক বিষাক্ত সাপের ছোবলেও Woodrat-এর মতো খুদে রোডেন্ট মরে না। মোদ্দা কথা, Rattle snake-এর বিষের কাছেও সে অনাক্রম্য বা ইমিউন।

আরও পড়ুন- কোভিডের টিকাতেই ছিল মৃত্যুফাঁদ! বিস্ফোরক যে তথ্য আসছে প্রকাশ‍্যে

Woodrat

তবে কেবল Woodrat-ই নয় ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল, গৃহপালিত শূকর, হেজহগ, হানিব্যাজারকে সাপের বিষের সামনে প্রায় ইমিউন বলা চলে। তারা শুধু সাপের বিষের বিরুদ্ধে ইমিউনিটিই গড়ে তোলেনি, মজার বিষয় হল, এক একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে বিষের প্রতি অনাক্রম্যতা গড়ে তোলার ধরনও আলাদা আলাদা। যেমন ধরা যাক, হানি ব্যাজারের কথা। তাদের চামড়াই এত মোটা যে সাপের বিষ দাঁতের পক্ষে সম্ভব নয় সেই চামড়া ভেদ করা। বা ধরা যাক mongoose-এর কথা। তাদের কোশ এমন ভাবেই তৈরি যে সাপের বিষকে তারা একপ্রকার আটকেই দেয়।

মঙ্গুজ় ও কোবরার লড়াই

কী কী মলিকিউলার পদ্ধতি বা জেনেটিক গঠন থাকলে সাপের বিষের হাত থেকে বাঁচা যায়, তা এখনও গবেষকদের কাছে পুরোপুরি জানা না থাকলেও কিছু বিষয় থাকে যেগুলি সাপের বিষ থেকে কিছু কিছু প্রাণীদেরকে বাঁচায়। যার মধ্যে অন্যতম হল অ্যান্টিভেনম ব্লাড, কোশের মিউটেশন এবং সব শেষে পুরু চামড়া। মানে যথেষ্ট পুরু চামড়া!

প্রথমে বলা যাক অ্যান্টিভেনম ব্লাডের কথা। এদেরকে অ্যান্টিভেনিনও বলা হয়। সাপের বিষ বা ভেনমকে নিউট্রালাইজ় (এবং নিষ্ক্রিয়) করতে পারে এমন যে কোনও পদার্থকে বলে অ্যান্টিভেনিন। মূলত রক্তকোশে মিউটেশনের কারণে এই বিষয়টি ঘটে। আবার কোশপর্দার গায়ে কিছু কিছু রিসেপ্টর থাকে, যারা সাপের বিষকে কিছুতেই নিজেদের গায়ে আটকাতে দেয় না। রিসেপ্টর হল কোশের গায়ে লেগে থাকা প্রোটিনের দরজা। রিসেপ্টর যতক্ষণ না উন্মুক্ত হচ্ছে, কোনও পদার্থ কিছুতেই কোশের ভেতর ঢুকতে পারবে না। আবার সব পদার্থের উপস্থিতিতে রিসেপ্টর উন্মুক্ত হয় না। ঠিক তালা-চাবির মতো খাপে-খাপে বসলেই, কোনও একটি পদার্থ এসে রিসেপ্টরটি খুলে যায়। আবার কিছু কিছু রিসেপ্টর থাকে সাপের বিষকে কিছুতেই আটকাতে দেয় না নিজের সঙ্গে। ফলে কোশের ভেতরে বিষটির ঢোকার পথ বন্ধ হয় যায়। ঠিক যেমনটা দেখা যায় গৃহপালিত শূকরের ক্ষেত্রে।

হানিব্যাজারের মতোই গৃহপালিত শূকরের স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে সাপের বিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। তার পাশাপাশি রিসেপ্টরের কথা আগেই বলা হয়েছে, যারা শুরুতেই কোশে প্রবেশ করা থেকে বিষকে বাধা দেয়। আবার দেখা গেল, কিছু কিছু প্রাণীর জিনে এমন কিছু মিউটেশন বা রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে কোশটি সম্পূর্ণ ভাবে বিষের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা গড়ে তোলে। ঠিক যেমনটা দেখা যায় mongoose-এর ক্ষেত্রে। যাদের রক্তকোশ ভেনম বা সাপের বিষকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দেয়। অথচ ঠিক এই ঘটনা যদি মানুষের ঘটত, এতক্ষণে রক্তকোশ, শরীরের প্রোটিন, উৎসেচক সব ভেঙে যেত।

আরও পড়ুন- উন্নয়নের কোপে পরিবেশ ধ্বংসের মাশুল! কোন ভয়াবহ সংকট আসন্ন

আর যদি কোনও প্রাণীর ত্বক সত্যিই খুব পুরু হয়, তাহলে সাপের বিষ দাঁতের পক্ষে বেশ কষ্টকর সেই মোটা ত্বককে ভেদ করে ঢোকা। সেক্ষেত্রে ত্বকই অনেকটা বিষের বিরুদ্ধে বর্ম হিসেবে কাজ করে। যেমনটা আবার দেখা যায় হানি ব্যাজারের ক্ষেত্রে। তবে শুধু মোটা ত্বকই নয়, হানি ব্যাজারের ক্ষেত্রে রক্তে অ্যান্টিভেনমও উপস্থিত থাকে। শুধু সাপই নয়, হানি ব্যাজার মৌমাছির বিষের বিরুদ্ধেও অনাক্রম্য। এমনতা তো হতে হবেই, নাম শুনেই বোঝা যায় সে মধু খায়। আর মধু খেতে তাকে চাক ভাঙতেও হয়। তবে শুধু মধু খেয়েই যে সে ক্ষান্ত থাকে তা নয়, হানি ব্যাজার আদতে সর্বভুক। সে বিষাক্ত সাপও শিকার করে খায়। বিষাক্ত সাপও খাব, অথচ তার বিষ সহ্য করব না, সে আর কেমন করে চলে! অগত্যা প্রকৃতিই হানি ব্যাজারকে সেই ভাবে গড়েপিটে নিয়েছে, যাতে সে সর্বভুক হয়েও নিজেকে অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

হানি ব্যাজার

আরেকটি প্রাণী হল ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল। কেই বা ভেবেছিল কাঠবেড়ালির মতো খুদে প্রাণীও সাপের বিষের হাত থেকে বাঁচতে পারে! তবে শুধু ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেলই নয়, ট্রি স্কুইরেল, চিপমাঙ্ক, উড়ন্ত কাঠবেড়ালি বা প্রেইরি ডগস এরা প্রত্যেকেই সাপের বিষের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছে ইমিউনিটি।

ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেলের মূল শত্রু র‍্যাটল স্নেক। Rattle snake যখন খোলস ছাড়ে সেই খোলসকে খেয়ে নেয় ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল। কিন্তু তারপরের কাজটি আরই অদ্ভুত! খোলসটি খাওয়ার পরেই নিজের এবং তার ছানাদের শরীর জিভ দিয়ে চেটে দেয় ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল। তাতে নিজের গায়ে তো বটেই, ছানাদের গা থেকেও এর গন্ধ ছাড়ে। সেই গন্ধেই rattle snake-সহ বিভিন্ন বিষাক্ত প্রাণীকে তারা নিজেদের থেকে দূরে রাখে।

ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল

এদিকে rattle snake যখন ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেলকে আক্রমণ করে, তখন ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেল হিংসাত্মক ভাবে নিজের লেজকে নাড়াতে থাকে। এই ভাবে লেজ নাড়ালে লেজ থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। rattle snake-এর কাছে কিন্তু ইনফ্রারেড রশ্মি প্রচণ্ড ভয়ের। ফলে খুদে হলেও কী হবে ক্যালিফোর্নিয়া গ্রাউন্ড স্কুইরেলের এই অভিনব পদ্ধতি rattle snake-এর মতো বিষাক্ত সাপকেও তাদের থেকে দূরে রাখে।

More Articles