ভারতের উদ্দেশ্যে আসা ইজরায়েলের জাহাজ ছিনতাই, বন্দি যাত্রীরা! কারা এই হাউথি?
Houthis Ship Hijack : হাউথিদের স্লোগানে লেখা থাকে "ঈশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ, আমেরিকার মৃত্যু, ইজরায়েলের মৃত্যু। ইহুদিদের অভিশাপ দাও, ইসলামের জয় হোক।"
ইয়েমেনের হাউথি বিদ্রোহীরা রবিবার লোহিত সাগরের শিপিং রুটে ইজরায়েলয়ের সঙ্গে সংযুক্ত একটি কার্গো জাহাজ ছিনিয়ে নিয়েছে, জাহাজের যাত্রীরা অপহৃত। জাহাজটি ভারতেই আসার কথা ছিল। ওই জাহাজের ২৫ জন ক্রু সদস্য আপাতত হাউথিদের কবলে। জাহাজটির জাপানি নিয়ন্ত্রক এনওয়াইকে লাইন জানাচ্ছে, ছিনতাইয়ের সময় জাহাজটিতে কোনও পণ্য ছিল না। জাহাদের ক্রু সদস্যরা কেউ ফিলিপাইনের বাসিন্দা, কেউ বা বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ইউক্রেন এবং মেক্সিকো থেকে এসেছেন। কিন্তু হঠাৎ এই জাহাজটি ছিনতাই করা হলো কেন? এউ হাউথিরাই বা কারা?
জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনাটিকে ইজরায়েল-গাজার যুদ্ধ থেকে পৃথক করে দেখা যাচ্ছে না। উল্টে আশঙ্কা বেড়েছে যে, ইজরায়েল-হামাসের যুদ্ধে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে এই 'জাহাজ হাইজ্যাক'! জাপানের বিদেশমন্ত্রী ইয়োকো কামিকাওয়া জানাচ্ছেন, টোকিও বিষয়টি নিয়ে সরাসরি ইজরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এমনকী সরাসরি হাউথিদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে। টোকিওর আহ্বান সৌদি আরব, ওমান, ইরান এবং অন্যান্য দেশগুলি এই হাউথি জঙ্গি গোষ্ঠীকে জাহাজ এবং ক্রু সদস্যদের মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করুক।
হাউথি কারা?
হাউথি গোষ্ঠী ইয়েমেনের জায়েদি শিয়া সম্প্রদায়ের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ইরান এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে সমর্থন জোগায়। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে শিয়া ইসলামের জায়েদি সম্প্রদায়ের এক ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলন থেকেই এই গোষ্ঠীর জন্ম। তবে এরা নজরে আসে প্রথম ২০১৪ সালে। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের সুন্নি-সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এই গোষ্ঠী।
২০১৪ সালের একটি অভ্যুত্থানে আবেদ রাব্বো মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল হাউথিরা এবং তখন থেকেই সৌদি আরবের সমর্থনে ক্ষমতাচ্যুত প্রশাসনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে হাউথিরা। বর্তমানে উত্তর ইয়েমেনের বেশিরভাগটাই হাউথিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের নেতৃত্বে শান্তি প্রচেষ্টার মধ্যে ইয়েমেন এখন প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় আপেক্ষিকভাবে শান্ত। সৌদি আরব এডেনে অবস্থিত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে সমর্থন করে। সৌদি আরবই এই যুদ্ধ থামানোর জন্য হাউথিদের সঙ্গে আলোচনা করছে। ইয়েমেনি এই গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ 'সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী' হিসাবেই মনোনীত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ২০২১ সাল পর্যন্ত এই গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীই মনে করত, তবে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসে সরকারিভাবে মনোনীত সন্ত্রাসবাদীদের তালিকা থেকে হাউথিদের সরিয়ে দিয়েছে।
হাউথিরা কেন ইজরায়েল বিরোধী?
হাউথি আন্দোলন কট্টরপন্থী ইসলামি আদর্শকে সমর্থন করে। সময়ের যত এগিয়েছে হাউথিদের আমেরিকা-বিরোধী, সৌদি-বিরোধী এবং ইজরায়েল-বিরোধী বক্তব্য আরও কঠোর ও তীব্র হয়েছে। হাউথিদের স্লোগানে লেখা থাকে "ঈশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ, আমেরিকার মৃত্যু, ইজরায়েলের মৃত্যু। ইহুদিদের অভিশাপ দাও, ইসলামের জয় হোক।"
ইজরায়েলি বাহিনী এবং হামাসের মধ্যে ৭ অক্টোবর থেকে যুদ্ধ চলছে। ইয়েমেনি এই গোষ্ঠী ৩১ অক্টোবর জানায়, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে যোগ দিয়েছে তারাও। হাউথিদের দাবি, ইজরায়েলে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে তারাও।
হাউথিরা অ্যাক্সিস অফ রেজিস্ট্যান্সে অন্য মিত্রশক্তির সঙ্গেই যোগ দিয়েছে। অ্যাক্সিস অফ রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে এই অঞ্চলে ইরান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী এবং সরকারগুলির সমিতি। এই সমিতিরই অন্যান্য প্রধান সদস্য হচ্ছে, হামাস এবং হিজবুল্লাহ।
হাউথিরা ইয়েমেনের জলসীমায় ইজরায়েলি জাহাজগুলিকেও নিশানা করার হুমকি দিয়েছে। ইজরায়েলকে দেওয়া এইসব হুমকি এবং হাউথিদের ইজরায়েল-বিরোধী অবস্থান দেশিয় সমর্থন পায় প্রচুর। ইরান সরাসরি এই গোষ্ঠীকে সাহায্য করে।
এই মাসের শুরুর দিকেই হাউথিরা ইয়েমেনের আঞ্চলিক জলসীমার উপর দিয়ে উড়ে আসা একটি মার্কিন ড্রোনকে ধ্বংস করে। হাউথিদের বক্তব্য তাদের বাহিনীর উপর গুপ্তচরবৃত্তি করছিল আমেরিকা। ওয়াশিংটন যদি সরাসরি ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষে জড়িত হয় তাহলে তা আমেরিকার জন্য খুব একটা ভালো হবে না, জানিয়েছেন হাউথি নেতা।
কেন হাউথিরা ওই জাহাজ হাইজ্যাক করল?
হাউথি জঙ্গিরা জানিয়েছে ইজরায়েলের সঙ্গে যোগ থাকার কারণেই জাহাজটি হাইজ্যাক করেছে তারা। গাজার হামাস শাসকদের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইজরায়েলের মালিকানাধীন বা ইজরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত জাহাজগুলিকেই নিশানা করতে থাকবে হাউথিরা। জঙ্গি গোষ্ঠীটি বলেছে, ইজরায়েল বা ইজরায়েলের সঙ্গে চুক্তি করা সমস্ত জাহাজই ছিনিয়ে নেবে তারা। তবে এই জাহাজের ক্রু সদস্যদের সঙ্গে ইসলামিক মূল্যবোধ অনুযায়ীই আচরণ করবে হাউথিরা।
হাউথিদের প্রধান আলোচক ও মুখপাত্র মহম্মদ আবদুল-সালাম অনলাইনে এক বিবৃতিতে জানান, ইজরায়েলিরা কেবল ক্ষমতার ভাষাই বোঝে। তাই ইকরায়েলি জাহাজ আটক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তব পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিয়েছে ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা কী আর সামুদ্রিক যুদ্ধ পরিচালনায় কতখানি দক্ষ এই গোষ্ঠী।
হাউথিরা কোন সামুদ্রিক পথকে নিশানা করছে?
মিশরের সুয়েজ খাল থেকে আরব উপদ্বীপকে আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাব এল-মান্দেব প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত লোহিত সাগরই হাউথিদের লক্ষ্য। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং শক্তি সরবরাহের মূল বাণিজ্যিক পথ এটিই। এই কারণে গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মার্কিন নৌবাহিনী লোহিতসাগরে একাধিক জাহাজ মোতায়েন করেছে।
২০১৯ সাল থেকে সমুদ্রে বেশ কয়েকটি জাহাজ এমন আক্রমণের শিকার হয়েছে। ইরান বিশ্বশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির সমস্ত সীমা লঙ্ঘন শুরু করলেই বাড়তে থাকে এই হাইজ্যাকিং। দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাস জঙ্গি গোষ্ঠীর নজিরবিহীন হামলার পর গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে ইজরায়েল যে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে তার পর হাউথিদের এই জাহাজ আটক বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে বলেই আশঙ্কা কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের।