দেওয়ালে অধিকার নেই রাজনৈতিক দলের! পঞ্চায়েত ভোটের আগে দাবিতে কেন অনড় রাজ্যের কুড়মিরা?
Kurmi Protest Joy Goram: কুরমি নেতাদের সাফ কথা, 'আগে দাবিপূরণ, তার পরে রাজনীতি।' রাজ্য যেভাবে গড়িমসি করে কুড়মিদের দাবি এড়িয়ে চলছেব দিনের পর দিন, তার দায় এড়াতে পারবে না এ রাজ্যের বিরোধীরাও।
আন্দোলন, বিক্ষোভ এ দেশে কোনও বড় ব্যাপার নয়। সেসব দমিয়ে দেওয়াও কোনও নতুন কথা নয়। শুধু এ দেশে কেন, যুগ যুগ ধরে আর্তের কণ্ঠস্বর ধামাচাপা দিয়েই সরকার চলেছে, দেশ চলেছে, সভ্যতা এগিয়ে চলেছ। এমনটাই দস্তুর। আর বিশেষত আর্ত যদি পিছিয়ে পড়া অনুন্নত জনগোষ্ঠীর মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। প্রায়শই কুড়মিদের আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যায় রেলচলাচল। এখানে-সেখানে ধর্মঘট করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন কুড়মিরা, চিৎকার করতে থাকেন। তবে সেসব চিৎকার, আন্দোলনের স্বর শাসকের কান অবধি পৌঁছয়। কিন্তু মরমে? না অতদূর পৌঁছয় না। বরং আপাত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয় কোনও রকমে। তার পর আসে ভোটের মরসুম। তখন শাসকের চোখ-কান-নাক, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটু বেশিই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। রাস্তার গর্ত চোখে পড়ে, আন্দোলনের শব্দ কানে এসে বাজে। এমনই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
বছর খানেক ধরে বারবার কানে এসেছে কুড়মিদের বিক্ষোভ, আন্দোলনের কথা। একাধিক বার একটানা রেল অবরোধ করেছেন কুড়মিরা। দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে চলেছে লাগাতার বিক্ষোভ মিছিল। কুড়মিদের আন্দোলনের ঠেলায় বারবার বাতিল করতে হয়েছে একাধিক দূরপাল্লার ট্রেন। আজ থেকে নয়, একাধিক দাবি নিয়ে বারবার সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন কুড়মিরা। অনুরোধ-উপরোধেও ভেজেনি চিঁড়ে। মেলেনি গুরুত্ব। মেলেনি কারণ এ কোনও রাজনৈতির দলের আন্দোলন নয়। এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নেই। বরং রয়েছে একটি সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রশ্ন। তবে যে কথাটি এতদিন তেমন ভাবে কানে না নিলেও চলে যাচ্ছিল, সেই আন্দোলন কিন্তু ইদানীং বেশ ভাবাচ্ছে প্রশাসককে। কেন? কারণ ভোটব্যাঙ্ক। পঞ্চায়েত ভোট আসতে আর কয়েকদিন। আর বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ড, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের একটি বড় অংশের ভোটব্যাঙ্ক কিন্তু এই কুড়মিরা। তাই, এখন বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামালেই নয়। ফলে কুড়মিদের আন্দোলন যে এখন অনেক বেশি ফুটেজ পাবে, তাতে আর সন্দেহ কী!
আরও পড়ুন: আজও বহাল আন্দোলনের ইতিহাস, জানেন কীভাবে এল ‘নন্দীগ্রাম’ নামটি?
তফসিলি উপজাতির মর্যাদা চেয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন কুড়মিরা। আর তার জন্য চাই কালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (CIR)-র অনুমোদন। শুধু তাই নয়, কুড়মিদের ধর্ম 'সারনা'-কে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও তুলেছেন তাঁরা। পাশাপাশি তাঁদের ভাষা কুড়মালি-কে সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও জানিয়েছে কুড়মিরা। তবে বারবার আবেদন সত্ত্বেও ফল মেলেনি। চিঁড়ে ভেজেনি বিক্ষোভ-আন্দোলনেও। হিন্দু ধর্ম বা সমাজের মেইনস্ট্রিম শাখার সঙ্গে মেল খাননা কুড়মিদের। বরং তাঁদের সংস্কৃতি অনেক বেশি সাঁওতাল বা আদিবাসী সংস্কৃতির ধারঘেঁষা। নিজস্ব ধর্ম, নিজস্ব ভাষা রয়েছে তাঁদের। রয়েছে মোড়ল কেন্দ্রীক বিচার ও শাসন ব্যবস্থা। যা অনেকাংশেই আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত জনগণনায় তাঁদের আদিবাসী হিসেবেই চিহ্নিত করা হত। কিন্তু ১৯৫০ সালে হঠাৎ সেই পরিস্থিতি বদলে যায়। তাঁদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয় আদিবাসী তকমা। কেন তা পরিষ্কার নয়। ১৯৫১ সাল থেকে জনগণনার খাতায় সাধারণ জাতি হিসেবেই পরিচয় দেওয়া হত কুড়মিদের। তার পর থেকে প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার খাতায় সেই ট্যাগ আর পাল্টায়নি। যা নিয়ে ক্ষোভ জমতে করে ধীরে ধীরে। সত্তরের দশকে এই নিয়ে প্রথমবার আন্দোলনে নামে কুড়মিরা। পরবর্তীতে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তকমা মিললেও আদিবাসী তকমা সেই তিমিরেই। সেই থেকেই চলছে বিক্ষোভ-আন্দোলন। ২০১৭ সালে কালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে সমীক্ষা করিয়ে রাজ্য সরকার বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিল। তার উপর ভিত্তি করে বিস্তারিত তথ্য রাজ্যের কাছ থেকে চেয়ে পাঠায় কেন্দ্র। তবে তার পরে আর বিষয়টি এগোয়নি। অভিযোগ, রাজ্য গড়িমসি করে বিষয়টি ফেলে রেখেছে। যার বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে কুড়মিরা।
দেশের নাগরিক হয়েও শুধুমাত্র রূপগত তারতম্যের জন্য 'অ-ভারতীয়' বলে দেগে দেওয়ার যে প্রবণতা আমাদের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে, তা আজকের নয়। ভারতের উত্তর-পূর্বের (নর্থ ইস্ট) মানুষদেরও এখনও যেভাবে প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় ভারতীয় নাগরিকত্বের, তা সত্যিই লজ্জাজনক। প্রায় প্রতিটি পদেই 'চিঙ্কি', 'চাইনিজ', 'চিনাম্যান চ্যাংচুং'-এর মতো নানা নাম আর কটূবাক্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় তাঁদের। কারণ তাঁদের মুখের গড়ন সংখ্যাগরীষ্ঠের সঙ্গে মেলে না। আর এখানেই পিছিয়ে পড়ে তাঁরা। অনেকটা তেমনই অবস্থা কুড়মিদেরও। তাঁরা যে বহিরাগত নন, শতকের পর শতক ধরে ছোটনাগপুর মালভূমির উঁচু-নীচু পাহাড়ি জলাজঙ্গলেই তাঁদের বাস। পরে তাঁরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজ্যে ছিটকে যায় তাঁরা। এ রাজ্যের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাস কুড়মিদের। কমবেশি আশি-পঁচাশিটির কাছাকাছি গোষ্ঠী রয়েছে এই সম্প্রদায়ের। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব এলাকার ভোট অনেক ক্ষেত্রেই নির্ণায়কের ভূমিকা নেয়। হিসেব বলছে, কমবেশি ৩০টি বিধানসভা আসন ও ৪টি লোকসভা আসনের ভোটবাক্সে কথা বলেন কুড়মিরা। বাঁকুড়ার রানীবাঁধ, রাইপুর এবং তালড্যাংরা- এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে ও বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে কিন্তু কুড়মিরা। ফলে এই পঞ্চায়েত ভোটের আগে কুড়মিদের ক্ষোভ খুব একটা সুবিধার হবে না শাসকের জন্য।
সামনের শনিবার পঞ্চায়েত ভোট। এই সুযোগটা ছাড়ছেন না কুড়মি নেতারাও। পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে বহুদিন ধরেই গুটি সাজিয়েছেন তাঁরা। পঞ্চায়েত ভোটের আগে জনজাতি তালিকাভুক্ত করার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করে আসছেন কুড়মি সমাজ। শেষপর্যন্ত নবান্নের সঙ্গে বৈঠকে বসেন কুড়মি নেতারা। তাতে আন্দোলন উঠলেও কোনও সমাধানসূত্র মেলেনি। এর মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হয়েছে অন্যান্য আদিবাসী সংগঠনগুলিও। তাঁদের আবার দাবি, কুড়মিদের মতো অ-আদিবাসীদের জনজাতি তালিকাভুক্ত করা যাবে না। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের আগে মহা গ্যাঁড়াকলে পড়েছে সরকার পক্ষ।
এদিকে কুড়মিদের সংস্কৃতি কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন। নিজস্ব ধর্মাচরণের রেওয়াজ রয়েছে তাঁদের। প্রকৃতি উপাসনাই তাঁদের ধর্মের মূল কথা। পাহাড়, গাছ, মাটি, জলের উপাসনা করেন তিনি। তাঁদের ধর্মের নাম সারনা। প্রতিটি গ্রামে প্রাচীন গাছকে কেন্দ্র করে রয়েছে একটি করে দেবস্থান। যাকে স্থানীয়রা বলে থাকেন গরাম থান। সেখানে নির্দিষ্ট দিনে প্রকৃতির পুজো করেন। তাঁদের প্রতিটি আচার বা ধর্মীয় রীতির মধ্যে প্রাচীনতার ছাপ স্পষ্ট। নিজস্ব ভাষা কুড়মালির পাশাপাশি রয়েছে তাঁদের নিজস্ব নাচ-গানের আঙ্গিক। তাঁদের প্রধান উৎসব করম উৎসব। এছাড়াও নানা ছোটবড় আচার-অনুষ্ঠান লেগেই থাকে সারাবছর জুড়ে। দেবস্থানে ছোট ছোট পোড়ামাটির হাতিঘোড়ার মূর্তি বা 'ছলন' রাখার রীতি রয়েছে তাঁদের। 'গরাম' শব্দটার উৎস সম্ভবত 'গ্রাম' থেকেই। আসলে গ্রামদেবতাকেই মানেন কুড়মিরা। এই গ্রামদেবতা সব শক্তির উৎস ও বিঘ্নবিনাশক। আর সেই গরাম দেবতাকে স্মরণ করেই 'জয় গড়াম' স্লোগান ব্যবহারের রীতি রয়েছে কুড়মি সমাজে।
আরও পড়ুন: বিশ্বের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন ঘটেছিল এই বাংলায়, জানেন কীভাবে জন্ম হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার
গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যরাজনীতিতে কান পাতলেই একাধিক জয়ধ্বনির শব্দ শোনা যায়। যা কার্যত স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে দিনে দিনে। বিজেপির 'জয় শ্রীরাম' থেকে শাসকের 'জয় বাংলা', যে যার সুবিধা মতো জয়ধ্বনি বেছে নিয়েছেন, দেদার ব্যবহারও করছেন সেসব। আর তার প্রতিষেধক হিসেবেই কুড়মিরা বেছে নিয়েছেন একেবারে নিজেদের একটি স্লোগানধ্বনি। যা আসলে ব্যবহার করা হয় তাঁদের ঈশ্বরের জয়গান করতেই।
সম্প্রতি মেদিনীপুর থেকে শুরু করে ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়ার কুড়মি অধ্যুষিত গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে 'জয় গরাম' লেখা পোস্টার, দেওয়াল লিখন। এ আসলে কুড়মি মাহাতোদের সমাজ আন্দোলনের ধর্মীয় স্লোগান, যা তাঁরা ব্যবহার করছেন তাঁদের পতাকাতেও। প্রতিটি দেওয়াল লিখনের নিচে তাঁরা লিখে দিয়েছেন বিধিবদ্ধ সতর্কতা। যেখানে বলা হয়েছে, 'দেওয়ালে কোনও রকম রাজনৈতির প্রচার নিষিদ্ধ'। কোথাও আবার লেখা হয়েছে 'আমার দেওয়াল আমারই থাক।'
ইতিমধ্যেই আন্দোলনে বেগ আনতে একসঙ্গে হাত মিলিয়েছে তিনটি কুড়মি সংগঠন। যার নাম দেওয়া হয়েছে 'ঘাঘর ঘেরা'। ঘাঘর ঘেরা কেন্দ্রীয় কমিটির তরফেই দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে এমন অভিনব প্রতিবাদের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের আগে এই পদক্ষেপের জেরে প্রচারের তেমন সুযোগই পাচ্ছে না রাজনৈতিক দলগুলি। ঘাড়ের একেবারে কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর এই সময়ে এই ব্যাপারটিকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না অভিজ্ঞমহল। এখানেই শেষ নয়, গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক সমাবেশে ১২ দফা কর্মসূচি নিয়েছে ঘাঘর ঘেরা। তার মধ্যে অন্যতম হল, কোনও রাজনৈতিক দলকেই কুরমি গ্রামে কোনও রকম কর্মসূচি করতে দেওয়া হবে না। করা যাবে না ভোটপ্রচার। কুরমি নেতাদের সাফ কথা, 'আগে দাবিপূরণ, তার পরে রাজনীতি।' রাজ্য যেভাবে গড়িমসি করে কুড়মিদের জনজাতিভুক্তির স্বপক্ষে সংশোধিত সিআরআই রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে না, তার দায় এড়াতে পারবে না এ রাজ্যের বিরোধীরাও। জনজাতি ও কুড়মিদের দাবিপূরণের সদিচ্ছা দুই সরকারেরই নেই বলেই অভিযোগ করেছেন তারা। আর তার ফলাফল ভালো হবে না বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের। এই পরিস্থিতিতে ওই সব এলাকাগুলির ভোটবাক্সে কুরমি আন্দোলনের প্রভাব কতটা পড়বে, সেটাই ভাবাচ্ছে রাজ্য-রাজনীতিকে।