মার্কো পোলো থেকে মুঘল পছন্দ সবারই! জানেন, কে প্রথম তৈরি করেছিল আইসক্রিম?

History of Ice Cream: ১৯ শতকের শেষের দিকে, আমেরিকা হয়ে ওঠে আইসক্রিম উদ্ভাবনের কেন্দ্রস্থল।

প্রচণ্ড গরম। ঠান্ডা তরলে শরীর ভিজিয়ে রাখা, আর ঠান্ডা পানীয় বা খাদ্যে শরীরের অন্দরকে শান্তি দেওয়া- এছাড়া দাবদাহে করণীয়ই বা কী! গ্রীষ্মকাল মানেই আইসক্রিমের বাড়বাড়ন্ত। এসকল তো জানা বিষয়, কিন্তু আইসক্রিম এল কোথা থেকে? বরফ দিয়ে, দুধ দিয়ে এমন সুস্বাদু খাবার কারা তৈরি করলেন প্রথম? জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, আইসক্রিমের উদ্ভাবনের নেপথ্যে রয়েছেন প্রাচীন চিনারা। মার্কো পোলো আইসক্রিম নিয়ে আসেন ইতালিতে, ক্যাথরিন ডি মেডিসি ফ্রান্সে এবং সেখান থেকে টমাস জেফারসন আমেরিকায় নিয়ে আসেন। তবে ঠিক কবে এই বিষয়টি তৈরি, বলা একটু কঠিন।

বরফযুক্ত পানীয় এবং মিষ্টান্ন প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই মেলে। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয়ার গ্রীষ্মের তাপ থেকে রক্ষা পেতে বরফের ঘর তৈরি করেছিল মানুষ। সম্ভবত ওয়াইন ঠান্ডা করার জন্য ব্যবহৃত হতো তুষার। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এথেন্সের রাস্তায় তুষার বিক্রি হয়েছিল। রোমান সম্রাট নিরো (৩৭-৬৭) তখন মধু দিয়ে বরফযুক্ত খাবার খেতেন। চিনের তাং রাজবংশেও বরফযুক্ত, কর্পূরযুক্ত জল আর মোষের দুধ থেকে তৈরি একটি মিষ্টি পানীয়ের উল্লেখ মেলে। চিনে প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানুষ বরফ, চাল এবং দুধের তৈরি আইসক্রিমের খুব প্রাথমিক এক সংস্করণ প্রথম খেয়েছিল। কয়েকশ বছর পরে, তাং রাজবংশের চিনা সম্রাটরা (৬১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) দৃশ্যত একই ধরনের খাবার খেতেন। সেই কারণে, তর্কাতীতভাবে বলাই যায় আইসক্রিমের জন্ম চিনে কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীতে এই পদটি নানাভাবে নানা স্থানে জনপ্রিয় হতে থাকে।

আরও পড়ুন- ঝিঁঝিঁ পোকা দিয়ে তৈরি আইসক্রিম! হু হু করে কেন বিকোচ্ছে এই বিচিত্র খাবার?

ঠান্ডা খাবার ইসলামি বিশ্বেও জনপ্রিয় ছিল। শরবৎ কথাটি এসেছে তুর্কি শব্দ থেকেই। বরফ দিয়ে শরবৎ ঠান্ডা করা, বা শরবৎ তৈরির সময় বরফ মেশানোর চল তো ছিলই। কয়েক শতাব্দী আগে ঠান্ডা সিরাপে ভার্মিসেলি নুডলস মিশিয়ে ফার্সি পর ফালুদাহ তৈরি হতো। ভারতে, মুঘল সম্রাটরা কুলফি খেতেন। কুলফি খানিক আধা-আইসক্রিমই বলা যায়।

প্রকৃতপক্ষে, কুলফির প্রথম রেকর্ড বলছে, এটি ইউরোপে ঠান্ডা শরবৎ এবং আইসক্রিমের প্রাচীনতম প্রমাণের প্রায় সমসাময়িক। দুই ক্ষেত্রেই একটিই বিষয় ছিল সাধারণ। বরফ লবণের সঙ্গে মিশে গেলে এক্সোথার্মিক রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করে, যা সাধারণ জলের চেয়ে অনেক কম হিমাঙ্ক তৈরি করে। বরফের স্ফটিকগুলি সহজেই বিভিন্ন তরল সংমিশ্রণে তৈরি হয়। বরফের স্ফটিকের আকার যাতে অনেক বেশিই বড় না হয়ে যায় সেই জন্য নিয়মিত নাড়াচাড়া করা হতে থাকলে হিমায়িত ফেনা তৈরি হয়।

প্রথম ইউরোপিয় আইসক্রিম এবং জলের বরফ (শরবৎ) সম্ভবত ১৬০০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইতালিতে তৈরি করা হয়েছিল (ক্যাথরিন ডি মেডিসি ফ্লোরেন্স ত্যাগ করার এবং ফ্রান্সের রানি হওয়ার এক শতাব্দী পরে)। ১৬২০-এর দশকে এবং মধ্য শতাব্দীতে প্যারিস, ফ্লোরেন্স, নেপলস এবং স্পেনের ভোজসভার অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য ছিল আইসক্রিম। ১৬৭২ সালে ইলিয়াস অ্যাশমোল জানিয়েছিলেন, আগের বছর একটি ভোজসভায় রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে এক প্লেট আইসক্রিম পরিবেশন করা হয়েছিল। ১৬৯৪ সালে আন্তোনিও লাতিনি কুমড়োর মিছরি দিয়ে তৈরি দুধের শরবতের একটি রেসিপি প্রকাশ করেছিলেন।

আইসক্রিম বিষয়টি ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকদের সঙ্গেই আটলান্টিক অতিক্রম করে এবং ১৭৪৪ সালের প্রথম দিকে ঔপনিবেশিক মেরিল্যান্ডের ফার্স্ট লেডি আইসক্রিম পরিবেশন করেন। জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৮৪ সালে মাউন্ট ভার্ননে তাঁর এস্টেটের জন্য একটি আইসক্রিম প্রস্তুতকারক যন্ত্র কিনেছিলেন। ওই একই বছর প্যারিসের কূটনীতিক টমাস জেফারসন সম্ভবত আইসক্রিমের স্বাদ পেয়েছিলেন প্রথম। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন, জেফারসন কমপক্ষে ছয়বার তাঁর প্রাসাদে আইসক্রিম পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর প্রচুর লেখার মধ্যে জেফারসন মাত্র দশটি রেসিপি লিখেছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল ফ্রেঞ্চ-স্টাইল ভ্যানিলা আইসক্রিম, ডিমের কুসুম দিয়ে তৈরি হতো সেই আইসক্রিম।

আরও পড়ুন- ১১ বছরের খুদের আবিষ্কারে মজেছিল গোটা বিশ্ব, যেভাবে এসেছিল কাঠি আইসক্রিম

১৯ শতকের শেষের দিকে, আমেরিকা হয়ে ওঠে আইসক্রিম উদ্ভাবনের কেন্দ্রস্থল। ফিলাডেলফিয়ার একজন ওষুধ প্রস্তুতকারক ১৮৭৪ সালে প্রথম আইসক্রিম সোডা মিশ্রিত করেন। আইসক্রিম সানডে তৈরি হয়েছিল ১৮৮১ সালে। এমন নামের নেপথ্যে রয়েছে সম্ভবত 'নীল আইন'। এই আইনের জেরেই রবিবার শহরে সোডা পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। প্রথম ভোজ্য আইসক্রিম কাপ জনপ্রিয় হতে শুরু করে ১৮৮০-র দশকে। সেই সময়েই মিল্কশেককে মূলত স্বাস্থ্য পানীয় হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯০৪ সালের সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে প্রথম ওয়াফেল কোন খ্যাতি অর্জন করে। ডেয়ারি কুইন এবং কারভেল দুই কোম্পানিই ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম সফট-সার্ভ আইসক্রিম তৈরি করার দাবি করে। হিমায়িত দই বাজারে আসে ১৯৭০-এর দশকে। সেই কোন কাল থেকে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা আইসক্রিমের লোভে ও প্রেমে না পড়ে থাকতে পারেনি মানুষ! অবাক লাগবে জেনে, আন্টার্কটিকায় আইসক্রিম আমদানি করা হয়। সেখানে আইসক্রিম মেশিন বসানো রয়েছে। ম্যাকমুর্ডো স্টেশনে কর্মরত বিজ্ঞানীদের কাছে এক বিখ্যাত স্থান এই আইসক্রিম পার্লার।

More Articles