৩৭ বছর বাদে টলল বিশ্বনাথন আনন্দের আসন! ভারতের সেরা দাবাড়ু ডি গুকেশের উত্থান কীভাবে?
Gukesh D. & Viswanathan Anand: ভারত থেকে একমাত্র বিশ্বনাথন আনন্দ সেই মুকুটের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। আনন্দ মোট পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
প্রায় ৪০ বছর ধরে ভারতীয় দাবার সেরা খেলোয়াড় ছিলেন কিংবদন্তি বিশ্বনাথন আনন্দ। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া থেকে শুরু করে ভারতকে একাধিক সাফল্য এনে দিয়েছেন বিশ্বনাথন। তার পাশাপাশিই নবীন তারকাদের জুগিয়েছেন নিরন্তর অনুপ্রেরণা। দাবাড়ু হয়ে ওঠার সমস্ত কৌশল শিখিয়েছেন ভারতের তরুণ প্রজন্মকে। রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ থেকে শুরু করে কোনেরু হাম্পিরা, সকলের 'আইডল' এই বিশ্বনাথন আনন্দই। কিন্তু এবার তাঁকেই পরাজিত হতে হয়েছে ১৭ বছরের এক কিশোরের কাছে। খোয়াতে হয়েছে ভারতের এক নম্বর দাবাড়ুর খেতাব। দীর্ঘ ৩৭ বছর বাদে অবসান ঘটেছে বিশ্বনাথন আনন্দের জমানার। ভারতের এক নম্বর দাবাড়ু হিসেবে বিশ্বনাথন আনন্দকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ১৭ বছর বয়সি গ্র্যান্ডমাস্টার ডি গুকেশ।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে এই ৬৪ খোপের লড়াইয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতে বাজিমাত করে দিয়েছেন এই কিশোর গ্র্যান্ডমাস্টার। ভারতের অন্যতম কনিষ্ঠ এই গ্র্যান্ডমাস্টার মাত্র ১৭ বছর বয়সেই জিতেছেন চেস অলিম্পিয়াড। এই বয়সেই হয়ে উঠেছেন ভারতীয় দাবার সব থেকে বড় তারকাদের মধ্যে একজন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় হওয়া রমেশ বাবু প্রজ্ঞানন্দকেও ভারতীয় র্যাঙ্কিংয়ে পিছনে ফেলেছেন তিনি। এই মুহূর্তে ভারতীয় দাবার তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন গুকেশ। দুই নম্বরে রয়েছেন বিশ্বনাথন আনন্দ এবং তিন নম্বরে রয়েছেন রমেশ বাবু প্রজ্ঞানন্দ।
প্রাক্তন গ্র্যান্ডমাস্টার বিষ্ণু প্রসন্নের কাছেই দাবার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন গুকেশ। তবে তাঁর অনুপ্রেরণা সব সময়ই বিশ্বনাথন আনন্দ। সেপ্টেম্বরের আগেই জানা গিয়েছিল বিশ্বনাথন আনন্দ পিছিয়ে যেতে চলেছেন গুকেশের কাছে পরাজিত হয়ে। সরকারি তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে আনুষ্ঠানিকভাবেই আনন্দকে টপকে ভারতের এক নম্বর দাবাড়ু হয়ে উঠলেন গুকেশ। FIDE ৱ্যাঙ্কিং তালিকায় এই মুহূর্তে ৮ নম্বরে রয়েছেন গুকেশ। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে ২৭৫৮ ফিডে পয়েন্ট। অন্যদিকে বিশ্বনাথন আনন্দ রয়েছেন বিশ্ব তালিকায় ঠিক তাঁর এক পয়েন্ট নিচে, ২৭৫৪ ফিডে পয়েন্ট নিয়ে।
আরও পড়ুন- আগামী দশ বছরে বিশ্ব দাবার রাশ ভারতের হাতেই, নিশ্চিত!
১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্বনাথন আনন্দ প্রথমবার ভারতের শীর্ষস্থান দখল করতে পেরেছিলেন। সেই সময় তাঁর সবথেকে কাছের প্রতিদ্বন্দ্বী দিব্যেন্দু বড়ুয়াকে পরাজিত করে এই খেতাব জিতে নেন আনন্দ। এর ঠিক এক বছর পরে ১৯৮৭ সালে ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হন বিশ্বনাথন আনন্দ। দিব্যেন্দু এই খেতাব পেয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। এরপর আনন্দ ২০০০-২০০২ সাল পর্যন্ত FIDE চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন এবং ২০০৭ সালে অবিসংবাদিতভাবে আবারও গ্র্যান্ডমাস্টারের শিরোপা জিতে নেন। ২০১৩ সালে ম্যাগনাস কার্লসনের কাছে পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ বছর পর্যন্ত তিনিই ছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। আর ৩৭ বছর ধরে ভারতীয় দাবার শীর্ষে তাঁর রাজত্ব অবিচ্ছিন্নভাবে অব্যহত ছিল।
পারেননি হরিকৃষ্ণন, কিন্তু পারলেন গুকেশ
এই প্রথমবারই যে দেশের কোনও একজন তরুণ দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দকে টপকে এগিয়ে গিয়েছেন এমন নয়। এর আগে ২০১৬ সালে পি হরিকৃষ্ণন আনন্দকে পিছনে ফেলে এক নম্বরে চলে এসেছিলেন এক সময়। সেই সময় লাইভ রেটিং অনুসারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের এক নম্বর তারকা দাবাড়ু। তবে তিনি নিজের স্থান বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। কিছুদিনের মধ্যেই এই স্থান হারিয়ে ফেলেন তিনি। তাঁকে ছাপিয়ে আবারও উপরে উঠে আসেন বিশ্বনাথন আনন্দ। তবে এবারে, ব্যাপারটা কিছুটা অন্যরকম। লাইভ রেটিং অঙ্কের সুবিধা পেয়েছেন গুকেশ। রেটিং অনুযায়ী তিনি এই মুহূর্তে চলে এসেছেন ৮ নম্বরে এবং বিশ্বনাথন আনন্দ পৌঁছে গিয়েছেন ক্রমতালিকায় ৯ নম্বরে।
যদিও গুকেশের এই উন্নতির বিষয়টি আগে থেকেই আঁচ করে নিয়েছিলেন বিশ্বনাথন আনন্দ। ২০২৩ সালের জুলিয়াস বেয়ার জেনারেশন কাপ শুরু হওয়ার আগে তিনি গুকেশের সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন যাতে তাঁকেই ভারতের প্রতিনিধি করা হয় এই প্রতিযোগিতায়। এর জন্য তিনি ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার তানিয়া সচদেবের সঙ্গেও কথা বলেন। একটি লাইভ অনুষ্ঠানে তানিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় আনন্দ বলেন, "আমি হয়তো তাঁর কোচ নই, কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছি। তাঁর মধ্যে একটা সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমস্ত টুর্নামেন্টে এবারে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে এরকম খেলোয়াড়দেরই নির্বাচন করা উচিত।"
চেন্নাইয়ের দাবাড়ু কারখানা
তবে, গুকেশের এই সাফল্যের পিছনে তাঁর বিদ্যালয়ের অবদান কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। গুকেশ উঠে এসেছেন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই থেকে। এই শহরের সঙ্গে দাবার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে আগে থেকেই। ভারতের ৮৩ জন গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে ২৯ জন তামিলনাড়ুর বাসিন্দা ছিলেন। ১৮ বছর বয়সে বিশ্বকে চমকে দেওয়া দাবাড়ু রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দও আদতে চেন্নাইয়ের বাসিন্দা। আর এই ২৯ জন দাবাড়ুর মধ্যে ১৫ জনের পথচলা শুরু হয়েছিল মোগাপেয়ারের স্কুল ভেল্লামাল বিদ্যালয় থেকে। বলা হয় এই স্কুলটি নাকি ভারতের দাবাড়ু তৈরির কারখানা। এই স্কুলের দুইজন ছাত্র আর প্রজ্ঞানন্দ এবং ডি গুকেশ এখন ভারতীয় দাবার সবথেকে বড় তারকা।
আরও পড়ুন- শতরঞ্জের খেল! আরও ‘প্রজ্ঞা’ তৈরি হচ্ছেন ভারতেই
চেন্নাইয়ের অভিভাবকরা যদি দেখেন, তাঁদের সন্তানের মধ্যে দাবার প্রতি আগ্রহ রয়েছে তাহলে সন্তানকে নিয়ে তারা পৌঁছে যান এই ভেল্লামাল বিদ্যালয়ে। চেন্নাইয়ের বেশিরভাগ স্কুলে 'এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি' হিসেবে দাবা রয়েছে এমনিতেই। যখন জয়রাম জয়ললিতা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সেই সময় থেকেই প্রতিটি স্কুলে দাবা শেখানোর চল শুরু হয়েছিল। ২০১৩ সালে চেন্নাইয়েই অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ। বিশ্বনাথন আনন্দ, ম্যাগনাস কর্লসেনের মতো তারকার অংশ নিয়েছিলেন সেই প্রতিযোগিতায়। আর এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরেই গোটা চেন্নাই জুড়ে শুরু হয় সেভেন টু সেভেনটিন অনুষ্ঠানে আয়োজন। আর এই অনুষ্ঠানই হয়ে ওঠে ভারতীয় দাবার ইতিহাসে এক অন্যতম মাইলস্টোন। এই অনুষ্ঠানের আওতায় যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা আসতে পেরেছিলেন, তাঁরাই এখন সারা বিশ্বে ভারতের নাম উজ্জ্বল করছেন।
সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
তবে গুকেশের যাত্রা এখানেই শেষ নয়। শুধুমাত্র ভারতের এক নম্বর হলেই তো আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না। তাই এবার সামনের লড়াই আরও কঠিন। ইতিমধ্যেই এই সেরার হাইওয়েতে ঢুকে পড়েছেন প্রজ্ঞানন্দ। ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টে বিশ্বের আটজন সেরা প্রতিযোগী যোগ দেবেন। বাকুর বিশ্বকাপ থেকে প্রথম তিনজন স্থানাধিকারী এই যোগ্যতা অর্জন করেছেন। প্রজ্ঞানন্দ এই তিনজনের মধ্যে একজন। এই বিশ্বকাপে আরও কতগুলি যোগ্যতা অর্জনকারী প্রতিযোগিতা রয়েছে। বিশ্বকাপে হয়তো গুকেশ কার্লসেনের কাছে হেরে গিয়েছেন। কিন্তু সুযোগ এখনও শেষ হয়নি। অন্যান্য টুর্নামেন্ট থেকেও এই প্রতিযোগী তালিকায় সুযোগ পাওয়া যায়। এবার সেই সমস্ত টুর্নামেন্টেই নিজের লক্ষ্য স্থির করেছেন গুকেশ। এই প্রতিযোগিতা যিনি জিতবেন তিনি মুখোমুখি হবেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের।
আর সব শেষে হবে শীর্ষ দ্বৈরথ! সেই প্রতিযোগিতায় যিনি জিতবেন তিনিই হবেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ভারত থেকে একমাত্র বিশ্বনাথন আনন্দ সেই মুকুটের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। আনন্দ মোট পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এই মুহূর্তে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চিনের ডিং লিরেন। ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টে যদি গুকেশ প্রবেশ করতে পারেন এবং জিততে পারেন, তবে তিনিই হবেন লিরেনের 'চ্যালেঞ্জার'।