৯০% অক্ষম, হুইলচেয়ার ছাড়া নড়তে পারেন না! ১০ বছর জেলে কেন কাটাতে হলো শিক্ষক সাইবাবাকে?

G.N. Saibaba Released: সাইবাবা শারীরিক দিক থেকে ৯০% অক্ষম। গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় জেরবার হয়ে জীবনের গত এক দশক কাটাতে হলো তাঁকে।

১০ বছর ধরে তীব্র যন্ত্রণা সয়েছেন। হুইলচেয়ারে বন্দি, দেহের নব্বই শতাংশই অকেজো! তবু তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী! অন্তত রাষ্ট্র একজন শিক্ষককে এভাবেই দেখেছিল। অবশেষে, ৫ মার্চ, বম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক জি এন সাইবাবা এবং অন্য আরও পাঁচজনকে মাওবাদী যোগসূত্রের অভিযোগ থেকে খালাস করেছে। বিচারপতি বিনয় জি জোশী এবং বিচারপতি বাল্মীকি এস মেনেজেসের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সাইবাবা সহ সাংবাদিক প্রশান্ত রাহি, মহেশ টিকরি, হেম কেশবদত্ত মিশ্র এবং বিজয় নান টিকরিকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত করেছে৷ এই মামলায় জড়িত ষষ্ঠ ব্যক্তি পাণ্ডু নরোতে জেলে থাকাকালীনই চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে ২০২২ সালের অগাস্ট মাসে মারা যান।

গত দুই বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার নাগপুর বেঞ্চ সাইবাবা এবং অন্যদের বেকসুর খালাস করেছে। ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর বিচারপতি রোহিত বি দেও এবং অনিল পানসারের সমন্বয়ে গঠিত একই আদালত গদচিরোলি সেশন কোর্টের রায়কে বাতিল করেছিল। সাইবাবার স্ত্রী বসন্ত একটি বিবৃতিতে বলছেন, দীর্ঘ ১০ বছর সংগ্রামের পর অবশেষে বিচার হলো। কিন্তু কেন জীবনের দশটা বছর এমন শরীর নিয়ে জেলে কাটাতে হলো সাইবাবাকে?

আরও পড়ুন- সদগুরু থেকে রামদেব: ভেকধারী ‘বাবা’দের যেভাবে কাজে লাগায় বিজেপি

অভিযোগ ছিল, সাইবাবা ভারতের নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) সংগঠন রেভলিউশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (আরডিএফ) সেক্রেটারি ছিলেন। ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে এই আরডিএফ নিষিদ্ধ। এই মামলায় সাইবাবাকে প্রধান আসামি করা হয়। ২০১৩ সালে তাঁর বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত করা ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলির মধ্যে নাকি ষড়যন্ত্রমূলক ২৪৭ পাতা, একটি মেমরি কার্ডে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যকলাপের সঙ্গে সাইবাবার গভীর সম্পর্কের প্রমাণ মিলেছিল। ২২ জন সাক্ষীর বক্তব্যের ভিত্তিতে নিম্ন আদালতে তাঁর সাজা হয়। এদের মধ্যে একজনই ছিলেন স্বাধীন সাক্ষী; বাকিরা সবাই পুলিশের সাক্ষী।

জিএন সাইবাবা ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। ২০২১ সালে যে কলেজে তিনি কাজ করতেন অর্থাৎ রাম লাল আনন্দ কলেজ, তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়। ২০০৩ সালে এই কলেজে যোগদান করেছিলেন জি এন সাইবাবা। ইংরেজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়ে। অভিযোগ ওঠে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। মহারাষ্ট্র পুলিশ গ্রেপ্তারও করে তাঁকে।

২০১৪ সালে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর, তার পরিবার মাত্র অর্ধেক বেতন পেয়েছে। শেষমেশ ২০২১ সালের ৩১ মার্চ ওই কলেজের অধ্যক্ষ পাকাপাকিভাবে তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর প্রাপ্য সমস্ত পরিষেবাও বন্ধ করে একটি স্মারকলিপিতে সই করেন।

২০১৭ সালের মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের গদচিরোলি জেলার একটি দায়রা আদালত তাঁকে এবং অন্যদেরকে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। এই অভিযুক্তদের মধ্যে একজন সাংবাদিক এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও ছিল।

পুলিশ জানিয়েছিল, সাইবাবার নামে তাঁর মেয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের একটি চিঠি, একটি তার কলেজের চিঠি এবং হায়দরাবাদের একটি প্রতিষ্ঠানের চিঠি ছিল। 'প্রকাশ' নামে লেখা চিঠিগুলির মধ্যে মাওবাদী নেতৃত্বদের চিঠিও নাকি ছিল যেখানে তিনি তাঁর প্রতিবন্ধকতা, দিল্লিতে তাঁর হতাশা এবং পরিচালকের কাজের বদলে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কাজ করার ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। আদালত সাইবাবা এবং অন্যান্যদের কঠোর বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (ইউএপিএ) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেছিল।

আরও পড়ুন- উমর খালিদের বক্তব্য কি সত্যিই উসকানিমূলক? মনে করেন না অনেকেই

বিচারপতি রোহিত দেও এবং অনিল পানসারের বম্বে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ পরবর্তীতে সাইবাবার দায়ের করা একটি আপিলের অনুমতি দেয় এবং দণ্ডিত ট্রায়াল কোর্টের ২০১৭ সালের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করার অনুমতিও দেয়। ওই আদালতই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।

সাইবাবার স্ত্রী বসন্ত বারেবারেই জানিয়েছিলেন হুইলচেয়ার ছাড়া নড়তে পারেন না সাইবাবা। সাইবাবা একাধিক প্রাণঘাতী অসুস্থতায় ভুগছেন, যার মধ্যে রয়েছে লেফট ভেন্ট্রিকুলার ডিসফাংশন, হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিতে পাথর, মস্তিষ্কে সিস্ট, অগ্ন্যাশয়ের সমস্যা, কাঁধের পেশি এবং বাহুর দুর্বলতা এবং স্নায়ুর সমস্যার ফলে তাঁর দেহের উপরের অঙ্গগুলির আংশিক পক্ষাঘাত। সব মিলিয়ে সাইবাবা শারীরিক দিক থেকে ৯০% অক্ষম। গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় জেরবার হয়ে জীবনের গত এক দশক কাটাতে হলো তাঁকে। তাঁর স্ত্রী, বসন্ত স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে সাইবাবার মুক্তি চেয়ে রাজ্য এবং উচ্চ আদালতে একাধিক আবেদন করেছিলেন। মরিয়া হয়ে বসন্ত বলেছিলেন, সাইবাবাকে যদি অবিলম্বে জেল থেকে মুক্তি না দেওয়া হয় তবে তিনি মারা যেতে পারেন।

ভারতীয় কারাগারে মৃত্যুর সম্ভাবনা অবাস্তবও নয়। কারণ পাণ্ডু নারোতে ছিলেন সাইবাবারই সহ-অভিযুক্ত, ২০২২ সালে সোয়াইন ফ্লুতে মারা গিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ, চিকিৎসা করানো হয়নি তাঁর। ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্টস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর প্রায় ২০০০ মানুষ জেলে মারা যান। রাষ্ট্র একজন অসুস্থ শিক্ষককে জেলে রাখল, ১০ বছর পর যখন তিই ফিরলেন প্রায় পুরোই অথর্ব। এই দশ বছর, তাঁর চাকরি, তাঁর স্বপ্ন সমস্তই শেষ। প্রতিবছর এভাবেই রাষ্ট্রের সমালোচনাকারী বহু স্বরকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। উমর খালিদ বা সাইবাবা, শাসক ভয় পেলে ইউএপিএ অস্ত্রই প্রয়োগ করে।

More Articles