প্রশান্ত কিশোর নন, এই চাণক্যই তেলঙ্গানা তুলে দিল কংগ্রেসের হাতে

Sunil Kanugolu: জাতীয় রাজনীতির নয়া চাণক্য বললেও ভুল হবে না খুব। যিনি সঙ্গে থাকলে হয়তো কংগ্রেসকে ঠেকানো কঠিন হত কর্ণাটক, ছত্তীসগঢ় বা রাজস্থানেও, এমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।

রাজনীতির ময়দানে তিনি যেন কৃষ্ণ। যার পক্ষ নেবেন, ভোটের কুরুক্ষেত্রে জয় তাঁর। দক্ষ রাজনৈতিককুশলী হিসেবে এতদিন পরিচিত নাম ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তিনি ছুঁয়ে দিলে ঊষর জমিতেও ফুল ফুটে ওঠে। অন্তত ভোট ময়দানে তো বটেই। পিকে সঙ্গে থাকলে সে দলের জয় অনিবার্য। একেবারে তৃণমূল স্তরে নেমে সমীক্ষা চালানো থেকে এমন এমন সব কৌশল খুঁজে বের করেন তিনি ও তাঁর সংস্থা, যে বিরোধীরা মুখ লুকানোর জায়গা পান না। তবে পিকে যে একা নন, ভবিষ্যতে তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো উর্বর মস্তিষ্কও যে এসে গিয়েছে রাজনীতির মাঠে, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে তেলঙ্গানা। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে চারটি রাজ্যেই নিরঙ্কুষ জয় ছিনিয়ে নিয়েছে অপ্রতিরোধ্য বিজেপি। এমনকী কংগ্রেসের জেতা আসনও হাত থেকে গিয়েছে ফস্কে। ব্যতিক্রম শুধু তেলঙ্গানা। এ হেন গেরুয়া ঝড়ের মধ্যেও কীভাবে দক্ষিণের এই রাজ্যটিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কংগ্রেস? না, তাতে সনিয়া বা রাহুল গান্ধি কিংবা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের হাত নেই তেমন। বরং হাত পার্টির টিকে থাকায় প্রধান কি-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে অন্য একজনের হাত। তিনি সুনীল কানুগোলু। জাতীয় রাজনীতির নয়া চাণক্য বললেও ভুল হবে না খুব। যিনি সঙ্গে থাকলে হয়তো কংগ্রেসকে ঠেকানো কঠিন হত কর্ণাটক, ছত্তীসগঢ় বা রাজস্থানেও, এমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।

মোদি-ম্যাজিকের সামনে ধ্বসে গিয়েছে চারটি রাজ্যে কংগ্রেসের সমস্ত ভিত। কর্ণাটক নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল কংগ্রেস নিজেই। ছত্তীসগড়েও কংগ্রেসের গড় ছিল ভালোই মজবুত, রাজস্থানে এত এত নারীকল্যাণমূলক প্রকল্প, এতদিনের শাসন, সংশয় থাকলেও জয় যে একেবারে অসম্ভব, তেমনটাও ভাবেননি কংগ্রেস নেতৃত্ব। তবে এ সব রাজ্যে যে তাঁদের সঙ্গে কৃষ্ণ থুড়ি কানাগোলু সঙ্গে ছিলেন না। আগের ভোটে কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিরাট জয়ের নেপথ্যেও কিন্তু ছিল এই মানুষটির হাত। তার পরেই ২০২৩ বিধানসভা ভোটে রাজস্থান, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানা কংগ্রেসের ভোটকৌঁসুলি হিসেবে নিযুক্ত করা হয় কানুগোলুকে। তবে শেষপর্যন্ত রাজস্থান ও কর্ণাটক থেকে কানুগোলুকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেস। যে সিদ্ধান্তের জন্য আজ বোধহয় হাত কামড়াচ্ছে দল। কৃষ্ণের মতো তেলঙ্গানায় কংগ্রেসের ঝুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিনিয়ে এনেছেন যিনি, অনেকেই চেনেন না তাঁকে। অনেকেই জানেন না, এই নেপথ্য ব্যক্তির নাম।

আরও পড়ুন: কংগ্রেসের শোচনীয় হারের পর ইন্ডিয়ার বৈঠক, কেন যাচ্ছেন না মমতা?

সুনীল কানুগোলু। মিডিয়া ও প্রচারের আলোয় কমই ধরা দেন মানুষটি। ব্যক্তিজীবনের কথাও তেমন ভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে আসতে দেননি কখনও। মানুষ তাঁকে চেনে লাজুক, প্রচারবিমুখ হিসেবেই। কর্ণাটকের বাল্লারি জেলায় জন্ম সুনীলের। পরে সেখান থেকে পড়াশোনার জন্য চলে আসেন চেন্নাই। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকায় পড়তে যান কানুগোলু। সেখানেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। বিদেশের রঙিন জীবন, মোটা টাকার মাইনের চাকরির হাতছানি দূরে ঠেলে ২০০৯ সাল নাগাদ দেশে ফেরেন কানুগোলু। ম্যাকিন্জি নামক একটি কানাডার আর্থিক সংস্থায় পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন। মোট তিনটি সংস্থায় ডিরেক্টর পদে কাজ করেছেন কানুগোলু। তবে সেই তিনটি সংস্থাই অবশ্য এখন বন্ধ।

পরবর্তীকালে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ডস নামে একটি সংস্থা খোলেন কানুগোলু। সেখান থেকে রাজনৈতিক ময়দানে প্রবেশ তাঁর। প্রাথমিক ভাবে বিজেপিকে রাজনৈতিক পরামর্শ দিতেন তিনি। সিটিজেন ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ন্যান্স (ক্যাগ)-এরও অংশ ছিলেন তিনি এক সময়। তবে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ভোটপ্রচারের দায়িত্ব যায় ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের কাছে। তার পরেও ২০১৮ সাল পর্যন্ত অমিত শাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছেন কানুগোলু। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কর্ণাটক-সহ একাধিক রাজ্যে বিজেপির হয়ে ছিনিয়ে এনেছেন জয়ও। কিন্তু পিকে-র প্রতি বিজেপির বেশি নির্ভরতাই কি টলালো বিজেপির সঙ্গে কানুগোলুর পাকাপোক্ত সম্পর্ক? ২০২১ সাল নাগাদ কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধি ও পুত্র রাহুল দেখা করেন কানুগোলুর সঙ্গে। কংগ্রেসের ভোটকৌঁসুলি হিসেবে নিযুক্ত হল তাঁর সংস্থা মাইন্ডশেয়ার অ্যানালিটিক্স সার্ভিসেস। ২০২২ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গান্ধী কানুগোলুকে ২০২৪ লোকসভা ভোটের দায়িত্ব দেন। রাহুলের এই ভারত জোড়ো যাত্রা-র নেপথ্যেও কিন্তু ছিল এই ব্যক্তির মস্তিষ্কই।

Who is Sunil Kanugolu, Congress poll strategist responsible for historic win in Telangana?

কর্ণাটকে কংগ্রেসকে জয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার পিছনে কৃতিত্ব ছিল এই মানষটিরই। এর পরেই তেলঙ্গানায় ভোট সামলানোর ভার দেওয়া হয় কানুগোলুকে। আর সেই দায়িত্বটা যে তিনি দক্ষতার সঙ্গেই সামলেছেন, তার প্রমাণ ২০২৩ বিধানসভার ভোচের ফলাফল। তার দৌলতে কেসিআরের আসন টলিয়ে তেলঙ্গানার সিংহাসন দখল করেছেন কংগ্রেস নেতা রেভানাথ রেড্ডি। অবশ্য তিনিই শেষপর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার পাবেন কিনা তা এখনও সংশয়ে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, গোড়াতেই কানুগোলু বুঝে গিয়েছিলেন, একটি বড় অংশের ভোটভাগ মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও-এর গদি সামলাতে সাহায্য় করবে। ফলে  প্রথম থেকে সেদিকেই বেশি নজর দিয়ে রাজ্যে বিজেপির প্রভাব কমানোর চেষ্টা করেছিলেন কানুগোলু। শুধু কি তাই, ওয়াই এস রাজাশেখর রেড্ডির মেয়ে ওয়াইএস শর্মিলাকে রাজ্যের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার জন্য রাজি করান তিনি। আর সেটা ছিল তাঁর মোক্ষম চাল। শর্মিলাকে তিনি এই কথাটা বোঝাতে সফল হন যে, কেসিআরকে গদিচ্যুত করার জন্য তাঁর ভোট থেকে সরে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজনীয়।  তা নাহলে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে চলে যেতে পারত শর্মিলার ঝুলিতে। সেক্ষেত্রে বিপদে পড়ত কংগ্রেস। পাশপাশি 'অভয় হস্তম' প্রকল্পে পাঁচটি গ্যারান্টি যোগ করার পরামর্শও এসেছিল কানুগোলুর দলের কাছ থেকেই। যা এই ভোটে বিশেষ কার্যকরী হয়েছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। দশ বছর ধরে তেলঙ্গানার সিংহাসন দখলে রেখেছিল বিআরএস। তাদের গদিচ্যুত করে তখত দখলের কাজ মোটেই সহজ হত না কংগ্রেসের পক্ষে। এ বারের ভোটে তেলঙ্গানায় ১১৯টি আসনের মধ্যে ৬৪টিই জিতেছে কংগ্রেস। বিআরএস পেয়েছে মাত্র ৩৯টি আসন। বিজেপি ৮টি আর এআইএমআইএম জিতেছে মাত্র ৭টি আসন। আর এই জয় সহজ হত না কানুগোলুকে ছাড়া। আর এই সত্য বোধহয় এক বাক্যে মানবেন কমবেশি সকলেই।

কিন্তু যে কানুগোলু ম্যাজিকে তেলঙ্গানায় অপ্রত্যাশিত জয় ছিনিয়ে আনল কংগ্রেস, তাকে কেন বাদবাকি রাজ্যের ভোটে ব্যবহার করা হল না? গত বিধানসভা ভোটেও কিন্তু কর্ণাটকে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন কানুগোলু। তার ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। কর্ণাটকের মসনদ জিতে নিয়েছিল কংগ্রেস। পুরস্কার হিসেবে কর্ণাটক সরকার তাঁকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেয়। জানা গিয়েছে, রাজস্থানে বিধানসভা ভোটের আগে নিজের সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছিলেন কানুগোলু। সেই রিপোর্টও রাজস্থান কংগ্রেসের কাছে জমা দেন তিনি। যেখানে তাঁর সংস্থার তরফে জানানো হয়েছিল, রাজস্থানের বেশ কয়েকজন বিধায়ক ও মন্ত্রীর উপরে ক্ষুব্ধ রাজ্যের মানুষ। প্রার্থী তালিকায় বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। তবে রাজস্থানের মুখ্য়মন্ত্রী অশোক গেহলট সেই প্রস্তাব উড়িয়ে দেন বলে খবর।

আরও পড়ুন: জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারছেন না রেবন্ত রেড্ডি! তেলঙ্গানাতে কংগ্রেসের মধ্যেই ফের সংঘাত কেন?

শুধু রাজস্থান নয়, কানু গোলুর সমীক্ষার রিপোর্টকে হাওয়ায় উড়িয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের সভাপতি কমলনাথও। উল্টে কমলনাথ নাকি নিজের লোকেদের দিয়ে চার-চার বার সমীক্ষা চালান কর্ণাটকে। সেই রিপোর্ট জমাও পড়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। যেখানে ক্ষমতায় ফেরার কথা উল্লেখ করেছিলেন কমলনাথ। বলাই বাহুল্য, কানুগোলুর সমীক্ষায় ছিল অন্য কথা। যা কানে তোলেনি কর্ণাটক কংগ্রেস। এমনকী ছত্তীসগঢ়েও নিজেদের সমীক্ষারিপোর্ট পেশ করে ভূপেশ বাঘেলকে সতর্ক করেছিলেন ভোটকুশলী কানুগোলু। বাঘেলও একই ভুল করেছেন গেহলট ও কমলনাথের মতো। বাকি চার রাজ্যেও ভোটকুশলী হিসেবে কানুগোলুকে রাখার কথা হলেও শেষপর্যন্ত সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর কাঁধে ছিল তেলঙ্গানার ভার। আর সেই তেলঙ্গানাতেই বাজিমাত করে তিনি প্রমাণ করে দিলেন তিনি শুধু দক্ষই নন, তিনি নির্ভুল। নাহলে তেলঙ্গানার মতো রাজ্যে প্রথমবার ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া সম্ভব হত না কংগ্রেসের পক্ষে। সামনেই পাখির চোখ ২০২৪ লোকসভা ভোট। বিধানসভা ভোটে চার রাজ্যে কংগ্রেসের শোচনীয় হারের পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে জোট 'ইন্ডিয়া'-র ভবিষ্য়ৎ নিয়েও। যেখানে এখনও পর্যন্ত কোনও ইস্য়ুতেই একমত হতে পারছে না কোনও দলই। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে রুখতে কানুগোলুর মতো ভোটকুশলীর মস্তিষ্ককে কি ব্যবহার করতে চাইবে বিজেপিবিরোধী জোট? নাকি অপ্রতিরোধ্যই থেকে যাবে মোদি-ম্যাজিক, সেটাই এখন দেখার।

More Articles