স্বাধীনতা দিবস হিসেবে কেন ১৫ অগাস্ট দিনটিকেই বেছে নেওয়া হলো
কেন ১৫ অগাস্টকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল? এই দিনের কি কোনওরকম বিশেষ গুরুত্ব ছিল ইংরেজদের কাছে?
স্বাধীনতা দিবস প্রকৃত অর্থে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একটি জাতীয় দিবস। প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতাকে ব্রিটিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে প্রাণ দিয়েছেন বহু বীর বিপ্লবী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একরকমভাবে ছিল লাখ লাখ ভারতবাসীর অব্যর্থ পরিশ্রমের ফসল। ১৯৪৭ থেকে ২০২২, মাঝখানে কেটে গিয়েছে ৭৫টা বছর। স্বাধীন ভারতের নীল আকাশে আজ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াল স্বাধীনতা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের তিরঙ্গা নিশান। গেরুয়া, সাদা আর সবুজের চাঁদোয়ায় ঢাকল ১৩৫ কোটি মানুষের মন।
১৯৪৭ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভারতের স্বাধীনতা দিবসে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। যেটিকে 'ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি' বলা হয়ে থাকে। এটি ছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সংসদে দেওয়া প্রথম ভাষণ। সেই থেকে প্রতি স্বাধীনতা দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লা থেকে পতাকা উত্তোলন করেন।
তবে আপনারা কি জানেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট কিন্তু এই পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। লোকসভার সচিবালয়ের একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, নেহরু ১৯৪৭ সালের ১৬ অগাস্ট লালকেল্লা থেকে স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। ভারত-পাকিস্তান সীমানাও ওই সালের ১৫ অগাস্ট ঘোষণা করা হয়নি। ১৭ অগাস্ট র্যাডক্লিফ লাইনের ঘোষণার সঙ্গে এই ভারত পাকিস্তানের বিভাজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ হাউজ অফ কমনস-এ ভারতের স্বাধীনতা বিল পেশ করা হয়েছিল। এই বিলে ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব ছিল। বিলটি ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই গৃহীত হয়েছিল। ১৪ অগাস্ট দেশভাগের পর ১৪ থেকে ১৫ অগাস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: শুধু দেশের মানুষ নয়, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ভারতে থাকা বিদেশিরাও
মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে কোনওভাবেই অংশ নিতে চান নি। কারণ ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন মহাত্মা গান্ধী অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালিতে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে উপবাস করেছিলেন। তবে ভাবার বিষয়, কেন ১৫ অগাস্টকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল? এই দিনের কি কোনওরকম বিশেষ গুরুত্ব ছিল ইংরেজদের কাছে? এই সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বিভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী-র পরামর্শমতো লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে অনেকের মতে, মাউন্টব্যাটেন মনে করেছিলেন, এই দিনটি তাদের জন্য শুভ। আসলে কি কারণ ছিল ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নেওয়ার? চলুন আরও একবার ফিরে যাওয়া যাক সেই ইতিহাসে।
পূর্ণ স্বরাজের দাবি
সময়টা ১৯২৯ সাল। সেই সময় কংগ্রেসের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ১৯২৯ সালের জাতীয় কংগ্রেসের একটি সভা থেকে পূর্ণ স্বরাজের ডাক দেন নেহরু। সেই সময় ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারি তারিখটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে। তবে, ১৯৪৭-এর পরে ব্যাপারটা পাল্টায়। ১৯৫০ সালের ওই দিনেই স্বাধীন ভারতের প্রথম সংবিধান কার্যকর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরু। সেই থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটি হয়ে যায় সাধারণতন্ত্র দিবস।
১৫ অগাস্ট দিনটি এল কীভাবে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে, তাদের হাতে আর খুব একটা বেশি সময় নেই। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলি জিন্না বুঝতে পারেন, তার কাছে খুব একটা বেশি সময় নেই। তার মৃত্যু প্রায় আসন্ন। তাই পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাধীনতা প্রয়োজন।
তাই মহম্মদ আলি জিন্না-র প্ররোচনায় দানা বাঁধে হিন্দু এবং মুসলিমের মধ্যে ধর্মীয় বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্টের দিন। মহম্মদ আলি জিন্না-র নেতৃত্বে মুসলিম লিগ ঘোষণা করে ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে-র। কলকাতায় ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগে, গণহত্যা, নারীদের ধর্ষণ- সবকিছুই চলে অতিমাত্রায়। স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা বেরোয় 'The Great Calcuta Killings' শিরোনাম দিয়ে।
উল্টোদিকে, ঠিক তার পরের দিন ১৭ অগাস্ট হিন্দু নেতারা মুসলিম লীগের এই নারকীয় হত্যালীলার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। পাল্টা আক্রমণ চালায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংগঠনগুলি। হিন্দু আক্রমণের চাপে সরে গেলেও মুসলিম লিগ নিজের জায়গায় তখনও স্থির থাকে। ফলে দেশভাগ নিয়ে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে তৈরি হয় একটা বড় সমস্যা। আর এই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কলকাতা। মুসলিম লিগ দাবি করে, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে পুরো পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতাকে সংযুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে, কংগ্রেস এবং হিন্দু সংগঠনগুলি এই দাবির বিরোধিতা করে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারেন, গোটা দেশে যেভাবে বিক্ষোভের পরিমাণ বাড়ছে, তাতে ১৯৪৮ পর্যন্ত আর অপেক্ষা করা যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এই প্রসঙ্গে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কথোপকথনকালে তাকে একটি পরামর্শ দেন কংগ্রেস নেতা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালে ৩০ জুন পর্যন্ত যদি ব্রিটিশরা অপেক্ষা করে তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশের হাতে কোনও ক্ষমতাই অবশিষ্ট থাকবে না। তার আগেই ভারত এবং পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাগ হয়ে যাবে। ভাবগতিক বুঝে মাউন্টব্যাটেন সিদ্ধান্ত নেন ১৯৪৭ সালেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন তিনি।
ভারতের স্বাধীনতা এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন
ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন দাবি করেছিলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনটি এগিয়ে আনার মধ্য দিয়ে তিনি দাঙ্গা এবং রক্তপাত অনেকাংশে এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে তাঁর দাবি ছিল সম্পূর্ণ ভুল। মাউন্টব্যাটেন আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখেছিলেন, "যেখানেই সাম্রাজ্যের শাসনের অন্ত হয়েছে, সেখানেই রক্তপাত হয়েছে।" ল্যারি কলিনস এবং ডমিনিক লা পিয়েরের লেখা 'ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট' বইতে বলা হয়েছে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজেই স্বাধীনতার তারিখ হিসেবে ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি তারিখ বেছে নেওয়া হবে স্বাধীনতার জন্য। তাহলে ১৫ অগাস্ট তারিখটিকে তিনি কেন বেছে নিয়েছিলেন? জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, এই ১৫ অগাস্ট তারিখটিকে বেছে নেওয়ার কারণ, সেদিন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাপানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এবং মাউন্টব্যাটেন সেই সময় ছিলেন মিত্রবাহিনীর সেনাপতি। তাই সেই দিনটি ছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের জন্য অত্যন্ত শুভ। এই কারণেই মূলত ১৫ অগাস্ট তারিখটিকে আরো একটি কারণে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৫ অগাস্ট
১৯৪৫ সালে শেষ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির একটি দেশ জাপান আত্মসমর্পণ করে। সেই বছর জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরপর দু'টি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর জাপানের লড়াই ক্ষমতা প্রায় শেষ হয়ে যায়। ওই বছরই জাপানের সম্রাট হিরোহিতো রেডিওর মাধ্যমে দেওয়া একটি বক্তৃতায় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানান। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে বসে ওই ঘোষণা শুনছিলেন। সেই দিনটির কথা কখনওই ভুলতে পারেননি লর্ড মাউন্টব্যাটেন। কারণ সেই সময় তিনি ছিলেন মিত্রবাহিনীর সেনাপতি। আর ঘটনাচক্রে দিনটি ছিল ১৫ অগাস্ট। কয়েকজন ইতিহাসবিদ মনে করেন, মাউন্টব্যাটেন ১৫ অগাস্ট দিনটিকে শুভ বলে বিবেচনা করেছিলেন এবং এই জন্যই তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য ওই তারিখটিকে বেছে নিয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাপানের সম্রাট হিরোহিতো একটি রেকর্ড করা রেডিও ভাষণ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে জুয়েল ভয়েস ব্রডকাস্ট নামে পরিচিতি পেয়েছিল সারা বিশ্বে। এখনও বেশ কিছু জায়গায় খোঁজ করলে এই ব্রডকাস্টের কিছু অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। সেই রেডিও ভাষণে মিত্রশক্তির কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করেছিলেন জাপানের তৎকালীন সম্রাট। মাউন্টব্যাটেন স্মরণ করেছিলেন, সেদিন তিনি সেই ভাষণ শুনেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে বসে। মিত্রশক্তির সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে জাপানের আত্মসমর্পণের নথিতে ১৯৪৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরও করেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ হাউজ অফ কমনসে ভারতের স্বাধীনতা বিল পেশ করা হয়। এই বিলেই ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিলটি ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই গৃহীত হয় এবং ১৪ অগাস্ট দেশভাগের পর ১৪-১৫ অগাস্টের সন্ধিক্ষণে মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
ভারত এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস আলাদা হলো কীভাবে?
আইন অনুযায়ী কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ রাজ শেষ হয়েছিল ১৫ অগাস্টেই। কিন্তু পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ অগাস্ট। এখন ভাবনার বিষয়, ভারত স্বাধীন হওয়ার একদিন আগে কীভাবে পাকিস্তান স্বাধীন হতে পারে? সত্যি কথা বলতে গেলে, পাকিস্তান কিন্তু ১৫ অগাস্টই স্বাধীন হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা বিলে ভারত এবং পাকিস্তান দু'টি দেশকেই ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ১৫ অগাস্ট তারিখেই স্বাধীনতা দিবস পালন করেছিল পাকিস্তান। প্রথম ভাষণে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলি জিন্না বলেছিলেন, "১৫ আগস্ট স্বাধীন, সার্বভৌম, পাকিস্তানের জন্মদিন।"
কিন্তু পাকিস্তানের এই ১৪ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস পালনের বিষয়টির পিছনে একটি ধর্মীয় দিক রয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান ১৪ অগাস্ট তারিখটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট রাতটি ছিল ইসলামিক ক্যালেন্ডারের রমজান মাসের ২৭ তারিখ। আর সাল ছিল ১৩৬৬ হিজরি। ২৭তম রমজানের রাতটিকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত পবিত্র রজনী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আর সেই থেকেই ১৪ অগাস্ট দিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গ্রহণ করে পাকিস্তান।