চলচ্চিত্রায়নের আগে রামায়ণের দশখানা ভার্সন পড়েন জাপানি পরিচালক! আর আদিপুরুষের বেলা?
Ramayan in Indian Movies: ভারতীয় সিনেমাতেও একেবারে শুরুর দিনে রাজা হরিশচন্দ্রের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে ছবি বানানো হয়েছিল, তার নাম লঙ্কা দহন।
প্রথমেই বলি দাশরথি রাম (কারণ আরও দুই বিখ্যাত রাম আছেন, পরশুরাম আর বলরাম) তিন রামের মধ্যে দ্বিতীয়। খুব সম্ভবত তিনি ঐতিহাসিক পুরুষ ছিলেন। কারণ সমকালীন আরও অন্য বিভিন্ন বইতে তাঁর উল্লেখ পাই। বৌদ্ধ জাতকেও তাঁকে ব্রাত্য করা হয়নি। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় কী হিসেবে তাঁর নাম আছে?
রাবণকে যুদ্ধে হারানো বীর বা ধর্মের মহারক্ষক হিসেবে নয়, তাঁর নাম আছে 'প্রজাপালক' হিসেবে। মানে তখনকার ভারতে, যখন রাজা মাত্রেই বিলাস আর একনায়কতন্ত্রের প্রতিভূমাত্র, তখন রাম এমন এক শাসনব্যবস্থা চালু করেন যাতে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশ প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। সরকারকে যাতে জনগণ 'আমাদের সরকার' ভাবতে পারে সে চেষ্টা প্রায় প্রথম থেকে তিনি করে গেছেন। মন্ত্রীদের কথায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন এবং কখনই নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না। রামরাজ্য আজও মিথ হয়ে আছে তাঁর একটাই কারণ, পৃথিবীতে সম্ভবত প্রথমবার এক রাজা for the people, by the people, of the people এক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান।
যিশুর জন্মের অত বছর আগে, গোটা ব্যাপারটা ভাবলেই তাক লেগে যায়! ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশের বীজ কিন্তু রামই প্রোথিত করে যান। আর এ ব্যাপারে নিজে এতটাই দৃঢ় ছিলেন তিনি যে, নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিলেন এক অন্ত্যজর কথায়। তাঁর শাসন বা বিচারে পক্ষপাত প্রকাশ পাচ্ছে এমন সন্দেহ যদি এক অন্ত্যজও প্রকাশ করেন তবুও আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে তিনি একলা চলেন। হনুমান বা জাম্বুবানের মতো প্রান্তিক মানুষদেরও তিনি বুকে টেনে নিতে পারেন। তুলসীদাস থেকে কম্বোন, এমনকী স্বয়ং বাল্মিকী অবধি রামের ধীরোদাত্ত গুণের পাশেই এই নরম, স্নেহশীল সত্ত্বাকে দেখিয়েছেন বারবার।
আরও পড়ুন- গান প্রতি ১৫ টাকা! গানের চাবুকে বলিউড শাসন করেছিলেন সামসেদ বেগম
ভারতীয় সিনেমাতেও একেবারে শুরুর দিনে রাজা হরিশচন্দ্রের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে ছবি বানানো হয়েছিল, তার নাম লঙ্কা দহন। পরিচালক, সেই দাদাসাহেব ফালকে। এই সিনেমাটি বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। সেই প্রথম রাম আর সীতা দুই ভূমিকাতেই অভিনয় করেন আন্না সালুঙ্কে। সেই সালুঙ্কে যিনি হরিশচন্দ্রে রাণী তারামতী সেজেছিলেন। কাহিনির শুরু রামের বনবাস থেকে। শেষ হনুমানের ল্যাজে লঙ্কার ভস্মীভূত হওয়া দিয়ে। একেবারে ঠিক ধরেছেন। এখন যে কথা বললেই পাঠকের প্রথমেই মনে আসে "কাপড়া তেরে বাপ কা…" ইত্যাদি জঞ্জাল। কিন্তু ফালকে কীভাবে সিনেমাটা হ্যান্ডেল করেছিলেন? পরিচালক ফালকে সার কথা শুরুতেই বুঝে গেছিলেন। তিনি জানতেন, একেবারে আধুনিক একটা মিডিয়ামের সঙ্গে রিলেট করাতে গেলে দর্শকদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে তাদের নিজেদের কম্ফোর্ট জোনে। এমন গল্প বলতে হবে, যা প্রায় জন্ম থেকে তারা শুনে আসছে। আর রামায়ণের চেয়ে ভালো গল্প আর কীই বা হতে পারে? ফালকে ক্লাসিক বললেন। আর বললেন ক্লাসিকের মতো করেই। যেখানে শোনার জার্কটুকু দর্শকের মালুমই হয় না। ফলাফল হাতেনাতে। লম্বা লম্বা লাইন পড়ত টিকিট কাউন্টারের সামনে। বস্তায় করে টাকা ভরে নিয়ে যেতে হতো প্রযোজকের অফিসে। সবাই দুই হাত তুলে ফালকের গুণগান করত।
কিন্তু কেন? সদ্য রিলিজ করা আদিপুরুষ এই জায়গাটাই ধরতে পারেনি হয়তো। যে কোনও ক্লাসিক, সেটা রামায়ণ, মহাভারত কিংবা অন্য যাই হোক না কেন, ক্লাসিক হয়ে ওঠে শব্দের ধারে ও ভারে। ক্লাসিক থেকে তার শব্দের ওজন সরিয়ে নিলে আর দশটা সাধারণ কাহিনি থেকে তার বিরাট কিছু তফাৎ থাকে না। রাজশেখর বসুর ভাবানুবাদে বাল্মীকির রামায়ণ থেকে দুই এক লাইন নিয়ে ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন এই জায়গাটা,
“সমুদ্র প্রতিধ্বনিত ও পর্বত কম্পিত করে কুম্ভকর্ণ বজ্রনির্ঘোষতুল্য মহানিনাদ করলেন। বানররা ভয়ে পালাচ্ছে দেখে অঙ্গদ বললেন, তোমরা নিজের বীর্ষ ও অভিজ্ঞতা বিস্মৃত হয়ে কোথায় ধাবিত হচ্ছ? এই বিভীষিকাকে আমরা বধ করব!”
এটাকেই যদি এভাবে বলি,“সাগরে প্রতিধ্বনি তুলে আর পাহাড় কাঁপিয়ে কুম্ভকর্ণ বিশাল আওয়াজ করলেন। বানররা ভয়ে পালাচ্ছে দেখে অঙ্গদ বললেন, “তোমরা নিজেদের সাহস আর অভিজ্ঞতা ভুলে কোথায় যাও? এই ভয়টাকে আমরা মেরেই ছাড়ব।” তাতে মানে এক থাকলেও যাকে বলে মুড, তার বারোটা বাজছে। রামানন্দ সাগর যখন টিভির জন্য রামায়ণ বানান, তখনও তিনি এই মুডটা যাতে বজায় থাকে তার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। অরুণ গোভিল বা দীপিকা চিকলিয়া সেই অর্থে একেবারে নতুন মুখ। অরুণকে দেখে বিরাট ফাইটার মনে হয় না, কিন্তু দিন শেষে সেই রামায়ণ এক অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। নিদাঘ দুপুরে কুয়োর ঠান্ডা জলের মতো। রামের গোটা কাহিনিই এই অদ্ভুত সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। কোভিডের সময় এই রামকাহিনি তাই আমাদের অশান্ত মনকে নতুন করে শান্ত করেছিল।
আরও পড়ুন- ৩৬৮ দিন লোকেশনে এসে বসেছিল সকলে, আসেননি চ্যাপলিন! যেভাবে তৈরি হলো সিটি লাইটস…
এই প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসছে ইয়ুগো সাকোর অ্যানিমেশন রামায়ণের কথা। 'দ্য লিজেন্ড অব প্রিন্স রামা' নামে এই অ্যানিম ছবি রিলিজ করেছিল নব্বইয়ের দশকে। সাক্ষাৎকারে আদিপুরুষের লেখক মনোজ জানিয়েছেন, তিনি বাল্মিকী আর তুলসীদাসের বাইরে কোনও রামায়ণ পড়েননি। সংস্কৃত তিনি জানেন না, নিজেই বলেছেন। অর্থাৎ হিন্দিতেই তিনি দু'খানি রামায়ণ পড়েছেন। এদিকে জাপানি ইয়ুগো সিনেমা বানানোর আগে পড়েছিলেন রামায়ণের দশখানা ভার্সান। ১৯৮৩ থেকে প্রায় দশ বছরের রিসার্চের ফল তাঁর ছবি। সিনেমার হিন্দি ভার্সানে গলা দিয়েছিলেন অরুণ গোভিল, দারা সিং থেকে অমরীশ পুরী। গান গেয়েছিলেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সাধনা সরগম। এখনও সিনেমটা ইউটিউবে দেখা যায়। প্রথমেই যেটা নজরে আসে, তা হলো অদ্ভুত এক সারল্য। ক্রৌঞ্চ বিরহী কবি বাল্মিকী এই কাহিনি লেখার পিছনে যে কারুণ্য আছে, রামায়ণের গোটা আখ্যান জুড়ে পরতে পরতে তা বয়ে চলে। রামায়ণের পাঠ অন্তে রাম স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন, সীতার পাতালপ্রবেশ হয়, লক্ষ্মণকে রাম পরিত্যাগ করলে তিনি সরযূ নদীর ধারে ধ্যানে বসে দেহত্যাগ করেন। মিলনেচ্ছু দুই বকের একজনের মৃত্যুর হাহাকার দিয়ে যে কাহিনির শুরু তার শেষেও অদ্ভুত এক বেদনা জড়িয়ে থাকে পাঠককে। রামায়ণ তাই কালোত্তীর্ণ।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করে নিতে হয়, সাগর বা ইয়ুগো রামায়ণের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারলেও টিম আদিপুরুষ একেবারেই তাতে ব্যর্থ। রাম রাবণের যুদ্ধ, কিংবা রামের বীরত্ব অবশ্যই রামায়ণের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়। সিনেমাতেও হয়। তাই যারা মহাকাব্যকে পর্দায় তুলে আনতে চান, তাদের দায়িত্ব অনেক। সত্যিই তো, ক'জন আর আজকাল মূল রামায়ণ বা তার সারানুবাদ পড়েন! কিন্তু ভেবে দেখুন তাদের মধ্যে কেউ বা অনেকে যদি আদিপুরুষ ছবিতে রামায়ণকে দেখতে চান, তবে কী ভয়ানক গোলযোগ বাঁধবে! দর্পণে প্রতিবম্ব তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু সেই দর্পণ যদি নিজেই বিকৃত হয়, তবে যা তৈরি হয়, তাতে দেবতার দানব হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আদিপুরুষ এমনই এক বিকৃত দর্পণের নাম।