আফ্রিকার চিতা ধরে রাখা যাবে ভারতের অরণ্যে?
Cheetah in India: ভারতে আফ্রিকার চিতা আনার সমস্যাগুলি কী কী?
ভারত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল ১৯৫২ সালেই। আর তার পঞ্চাশ বছর পরে ভারতে চিতা ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু করল ভারত সরকার। ১৭ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনে আটটি চিতা সুদূর নামিবিয়া থেকে ভারতের বুকে পা রাখতে চলেছে। তাদের ঠাঁই হবে মধ্যপ্রদেশের কুনো ন্যাশানাল পার্কে।
নরেন্দ্র মোদির পশুপ্রেমের কথা তাঁর ভক্তদের মুখে মুখে ঘোরে। পশুপ্রেমী (ও ক্যামেরাপ্রেমী) মানুষটিকে 'ম্যান ভার্সাস ওয়াইল্ড'-এর মতো টিভি শো-তেও দেখেছি আমরা। শোনা যায়, পশুপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী কিশোর-অবস্থায় পুকুর থেকে কুমিরও ধরেছিলেন। তাই তাঁর জন্মদিনকেই শুভ দিন হিসেবে ধরে ভারতের মাটিতে পা রাখছে চিতারা।
'প্রোজেক্ট চিতা'- র লক্ষ্য, চলতি বছরেই ১০ অক্টোবর নাগাদ আরও বারোটি চিতা ভারতে আনা। এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে ভারত সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে আরও পঞ্চাশটি চিতা ভারতে আনার। যাদের রাখা হবে ভারতের বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্কে।
আরও পড়ুন: দুই প্রিয় বন্ধু্, দুই ভাই, জানা যাক ভারতে আসা অতিথি ৮ চিতার পরিচয়
ন্যাশনাল টাইগার কনজা়র্ভেশন অথরিটির ১৯-তম বৈঠকে এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করেছিলেন কেন্ত্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব। তিনি জানিয়েছেন, স্বাধীন ভারতে যে চিতা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, তা আবার পদার্পণ করতে চলেছে ভারতে; জানা যাচ্ছে 'দ্য হিন্দু'-র সূত্রে।
যদিও অতিমারীর কারণে ভারতে চিতাদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা সাময়িকভাবে বানচাল হয়ে গিয়েছিল, জানাচ্ছেন ন্যাশনাল টাইগার কনজা়র্ভেশন অথরিটি-র এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি।
যদি বলা যায়, ভারতে চিতা ফিরিয়ে আনার মূল পরিকল্পনা কার, তাহলে অবশ্যই বলতে হয় এন. কে. রঞ্জিত সিং-এর কথা। চিতা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা একান্তই তাঁর 'ব্রেন চাইল্ড'। রঞ্জিত সিং প্রাক্তন আইএএস অফিসার এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষক। তিনি দীর্ঘকালব্যপী মধ্যপ্রদেশের ফরেস্ট অফিসারের পদেও আসীন ছিলেন। ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি।
সুন্দরবন টাইগার রিজা়র্ভের প্রাক্তন রিসার্চ অফিসার তিষ্য দাশগুপ্ত ইন্সক্রিপ্ট-কে জানিয়েছেন, "মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাতের বেশ কিছু অংশ ইরানীয় চিতার বসবাসের পক্ষে কিছুটা উপযুক্ত হওয়ায়, রঞ্জিত সিং চেয়েছিলেন ভারতে ইরানীয় চিতা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে।"
ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকেই ভারতে চিতা ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু হয়। ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র বর্তমান ডিন যাদবেন্দ্রদেব ঝালা ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক-কে জানিয়েছেন, তিনি নিজেও ছাত্রাবস্থা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ভারতে একদিন চিতা ফিরে আসবে।
যাদবেন্দ্রদেব ঝালা ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক-কে জানিয়েছেন, ভারতে চিতা আনলে ইকোট্যুরিজ়ম বিস্তার লাভ করবে তো বটেই, তার পাশাপাশি অন্যান্য পশুদের সংরক্ষণও আগের তুলনায় ভালোভাবে হবে। উন্নত হবে আঞ্চলিক অর্থনীতিও। কারণ চিতা ভারতে থাকলে, চিতার মুখ চেয়েই বর্তমান ভারত সরকার মোটা টাকা বিনিয়োগ করবেন চিতার সংরক্ষণের জন্যে। তাতে সংরক্ষিত হবে অন্যান্য প্রাণী, লাভ হবে সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের, জানিয়েছেন ঝালা।
কিন্তু যে চিতা স্বাধীন ভারতে নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো, সেই চিতাই কি আমরা আদতে ফিরিয়ে আনতে চলেছি?
নাহ, তা আদতেও নয়। ১৯৪৭ সালে কোরাবি-র মহারাজা তিনটি চিতা শিকার করে, শোনা যায়, সেটাই ভারতে দেখা যাওয়া শেষ চিতা; এমনটাই জানা যাচ্ছে ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক সূত্রে। ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করা হয় চিতাকে।
ভারতে ছিল ইরানীয় চিতা (Acinonyx jubatus venaticus), আর ভারতে যে চিতা নামিবিয়া থেকে আনা হচ্ছে, তা হল আফ্রিকান চিতা (Acinonyx jubatus jubatus)। তিষ্য দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, ভারতে এর আগে কখনও ইরানীয় চিতা ব্যতীত অন্য কোনও চিতা বসবাস করেনি। এবং এই প্রথম আফ্রিকান চিতা ভারতে বসবাস করবে।
এখনও অবধি কেউ জানে না, আফ্রিকান চিতা ভারতের বাস্তুতন্ত্রে কতটা খাপ খাওয়াতে পারবে। এবং তা জানার কোনও উপায়ও এতদিন ছিল না, যেহেতু ভারতে এর আগে যেহেতু আফ্রিকান চিতা ছিল না। তাই আপাতত পরীক্ষামূলকভাবেই তাদের একটি এনক্লোজা়রে রাখা হবে। "এনক্লোজা়রে রেখে চিতল ছেড়ে তাদের শিকার করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে কিছুটা", জানিয়েছেন তিষ্য দাশগুপ্ত।
তারপরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে ন্যাশনাল পার্কের উন্মুক্ত ক্ষেত্রে। "সেখানে চিতার গলায় কলার পরিয়ে তাদের মনিটরিং করা হবে; এই পুরো বিষয়টির তত্ত্বাবধানে থাকছে ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং ন্যাশানাল টাইগার কনজা়র্ভেশন অথরিটি। পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশ বনদফতরও তদারকি করবে বিষয়টি," সংযোজন করেছেন দাশগুপ্ত।
এশিয়াটিক চিতা বা ইরানীয় চিতার সাথে আফ্রিকান চিতার তফাৎ কোথায়?
প্রথমে বলা যাক, এশিয়াটিক ও আফ্রিকান চিতা পৃথিবীর কোথায় কোথায় পাওয়া যায়। এশিয়াটিক চিতা কেবল ইরানেই পাওয়া যায় এই মুহূর্তে। অন্যদিকে আফ্রিকান চিতা প্রায় আফ্রিকাজুড়ে এক সময় পাওয়া গেলেও এই মুহূর্তে তাদের পাওয়া যায় আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণে নামিবিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পশ্চিমে আলজিরিয়াতে, তা আবার বর্তমানে আলজিরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বেই সীমাবদ্ধ। মধ্য আফ্রিকার চাদ, এবং পশ্চিম আফ্রিকার এথিওপিয়া, কেনিয়া, তানজা়নিয়ার কিছু অংশে।
আফ্রিকান চিতার তুলনায় এশিয়াটিক চিতা আয়তনে ছোট, কিন্তু এদের গলা খুব দৃঢ়। পাশাপাশি এদের গায়ের লোম ঘন। এবং পা অপেক্ষাকৃত সরু। অনেকের ধারণা, আফ্রিকান চিতা এশিয়ান চিতার তুলনায় ধীরে দৌড়য়, তবে সেই ধারণা সঠিক কি না, সেই পরীক্ষা এখনও করা হয়নি। আফ্রিকার চিতার ক্ষেত্রে মুখমন্ডলে ছোপগুলি তুলনামূলকভাবে অনেক স্পষ্ট। শুধু মুখমন্ডলই নয়, সারা গায়ে ছোপগুলি বেশ ঘনভাবে ছড়িয়ে থাকে আফ্রিকান চিতার ক্ষেত্রে। এশিয়াটিক চিতার ক্ষেত্রে যা অবার দেখা যায় না।
তবে আফ্রিকান চিতার খাদ্যাভাস কিন্তু বেশ বৈচিত্রপূর্ণ, এশিয়াটিক চিতার ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়।
চিতার জন্য কতটা উপযুক্ত পরিস্থিতি ও বাস্তুতন্ত্র এই মুহূর্তে ভারতে রয়েছে?
ভারতের বেশ কিছু বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞর মতে ভারতে আফ্রিকান চিতা আনার বিষয়টি একেবারেই অপরিণত একটি সিদ্ধান্ত। তাঁদের আশঙ্কা, চিতাগুলিকে যেখানে রাখা হবে, সেই পরিসরের বাইরে তারা সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়াবে। ফলে বিগ ক্যাট গোত্রের অন্যান্য প্রাণীরা তাদের শিকার করতে পারে। কিছু না হলেও চোরাশিকারি বা স্থানীয়রাও হত্যা করতে পারে তাদের।
তিষ্য দাশগুপ্ত আরও জানাচ্ছেন, "ভারতে পশু ও মানুষের সংঘাতকে বাদ দিলেও যে চিন্তার বিষয়টি থেকে থাকে, তা হলো লেপার্ডের ভয়। চিতার সব থেকে বড় শিকারি বা প্রিডেটর হল লেপার্ড। আফ্রিকাতেও তারা প্রিডেটরের মুখোমুখি হয়। কিন্তু ভারতে তারা নতুন। নতুন পরিবেশে এসে, শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে কীভাবে বাঁচতে হবে, এক্ষেত্রে তাদের সময় লাগতে পারে।"
একথা অনেকেরই জানা বিগ ক্যাটস-দের মধ্যে সবথেকে দূর্বলতম হলো চিতা। সেখানে লেপার্ড বেশ হিংস্র এবং শক্তিশালীও তো বটেই।
ভারতে আফ্রিকান চিতা আনার দ্বিতীয় সমস্যা হল, বাসভূমির সমস্যা। তিষ্য দাশগুপ্তর মতে, "আফ্রিকান চিতা থাকে মরু অঞ্চলের দিগন্ত-বিস্তৃত ঘাসজমিতে। ভারতে এত বিস্তৃত ঘাসজমি নেই।"
সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ স্টাডিজ়-এর এমেরিটাস ডিরেক্টর উল্লাস কারান্থ ন্যাশানাল জিওগ্রাফিককে জানিয়েছেন, তিনি 'প্রজেক্ট চিতা'-র বিরুদ্ধে অবশ্যই নন। তবে এই পরিকল্পনা যেন বিদেশ থেকে চিতা এনে, তাদেরকে ভারতের মতো জনবহুল একটি দেশে ফেলে দেওয়ার মতো।
এর আগেও ইন্সক্রিপ্ট-এর তরফে বিভিন্ন প্রাণী সংরক্ষণবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে সংঘাত, বা ম্যান-অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট প্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি সমস্যা। সে গির অরণ্যের এশিয়াটিক লায়নই হোক, বা সুন্দরবনের বাঘ, কিংবা দক্ষিণ ভারতের হাতি- সব ক্ষেত্রেই এই মানুষ ও প্রাণীর সংঘাতের বিষয়টি নজরে এসেছে।
ভারতের এই মুহূর্তে যে সমস্ত প্রাণীরা ইতিমধ্যেই বিপন্ন, তাদের কী হবে?
ভারতে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যক প্রাণীর অবস্থা সংকটজনক। দ্য গ্রেটার অ্যাডজাট্যান্ট স্টর্ক, ওয়েস্টার্ন হুলক গিবন, লায়ন-টেইল্ড ম্যাকাক, এশিয়াটিক লায়ন, কাশ্মিরী রেড স্ট্যাগের মতো প্রাণী পড়ছে এই তালিকায়। পাখিদের মধ্যে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড, বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, বিভিন্ন প্রজাতির শকুন, লেসার ফ্লোরিকান, ফরেস্ট আউলেট, সাদা পেটওয়ালা হেরন, ল্যাপউইং ছাড়াও একাধিক পাখির অবস্থা বিপন্ন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশর বক্তব্য, অন্য পরিবেশ থেকে একটি নতুন পরিবেশে চিতাদের আনার আগে আমাদের ভাবা দরকার, ভারতে একাধিক প্রাণী সংকটের মুখে। অনেক প্রাণী আছে, যারা এই মুহূর্তে ভারতে বিলুপ্তপ্রায়। আমরা তাদের সংরক্ষণের আদর্শ পরিবেশ গড়ে তুলে দিতে পারিনি। শুধু তাই নয়, আমরা এখনও তাদের সংরক্ষণ নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নয়। আমাদের কি উচিৎ ছিল না, বাইর থেকে প্রাণী আনার আগে, একবার পরখ করে দেখা, বর্তমানে বিপন্ন প্রাণীদের টিকিয়ে রাখার অবস্থা (এবং মানসিকতা) আমাদের আদৌ আছে কি না।