অ্যানিমাল: এমন জান্তব সিনেমা কি শুধুই বিনোদন? কাদের জন্য?
Animal Movie Propaganda : 'ঘাঁটাস না, মালটার মাথা খারাপ' - বলে ছেড়ে দেব? যার মাথা খারাপ সে তো তার তারকাটামোর দাপট দেখিয়ে ৬৫০ কোটি টাকা কামানোর দিকে এগোচ্ছে!
ইনস্ক্রিপ্টে সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা-র ছবি 'অ্যানিমাল' নিয়ে লিখেছিলাম। লেখাটায় ভাঙ্গাবাবুকে 'ভঙ্গবাবু', তার ভক্তদের 'ভঙ্গভক্ত' এবং ছবির নামকে 'অ্যানিমেল' লেখা হয়েছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। লেখাটা টক্সিক এবং ভায়োলেন্ট ছিল ছবির টক্সিসিটি এবং ভায়োলেন্সের উল্টো প্রতিফলন হিসেবে; এই ছবিকে ব্লকবাস্টার উচ্চতা দিলে এই লেখাও গ্রহণযোগ্য হতে হবে, এই দাবিতে। এইবার বিবিধ জায়গায় কিছু মন্তব্য পড়ে তার উত্তর দিচ্ছি, উত্তর দিচ্ছি সমমনস্ক আরও অনেক সমালোচনার মন্তব্যের। এই ফলোআপটা আমাদের, সমালোচকদের করতে হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। আগের লেখায় বলেছিলাম, ছবিটা ফ্যাসিস্ট এবং ছবিটা নিয়ে উদযাপন ইঙ্গিত দেয় যে আমরা ফ্যাসিজমের দিকে এগোচ্ছি। বলেছিলাম যে, অধুনার massy ছবির মধ্যেই এই প্রবণতা নিহিত আছে।
প্রশ্ন ১ - ছবিটা নেহাতই 'বিনোদন' অথবা 'ফিকশন', এর মধ্যে 'বাস্তবের প্রতিফলন' বা 'পলিটিকস/জেন্ডার পলিটিকস' কেন ঢোকানো হচ্ছে?
এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে মজা লাগে, কারণ একই উত্তর কুড়ি বছর ধরে দিয়ে আসছি বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার রকমফের উপভোগ করি। যাই হোক, ... ঢুকেই তো আছে! ভাঙ্গাবাবু ঢুকিয়ে রেখেছেন এবং লোকাচ্ছেন না! 'অ্যানিমাল' নিজেই খুব তাত্ত্বিক ছবি, পলিটিকাল ছবি। এই ছবি নিজেই নিজের তত্ত্ব দেয়। নায়ক বহুবার জ্ঞান দেয় যে, পৌরুষ কী, নারীর ভূমিকা সমাজে কীরকম হবে এবং সমাজে 'পুরুষের পাওয়ার'-এর ভূমিকা কী ইত্যাদি।
'অ্যানিমাল' যে ফ্যান্টাসি সেই কথাটা আমার আগের রিভিউয়ের শুরুতেই বোধহয় বলা আছে। এই লেখায় আরও আলোচনা করব তার ফ্যান্টাসিধর্মীতার। প্রশ্ন হলো, যে কল্পনা করছে এবং যে সেই কল্পনায় আনন্দ পাচ্ছে সেই 'মানসিকতার' মানুষগুলো তো সত্যি? এই নারীবিদ্বেষী উগ্রপুরুষতান্ত্রিক ছবির কল্পনা দেখে যাদের আমার মতো রাগ হয়নি, বরং তৃপ্তি পেয়েছে, সেই মানসিকতা এবং মনসম্পন্ন মানুষগুলো তো বাস্তব? এইবার তারা বাড়ি ফিরে বউ পেটাবে না হয়তো কিন্তু বউ পেটাতে পারে এমন একজন নায়ককে সে হাততালি দিয়ে এসছে। মেয়েদের সিরিয়ালি অপমান করাকে হাততালি দিয়ে এসেছে। আমি এই বাস্তব লোকগুলি নিয়ে চিন্তিত।
আমি যদি একটা বিনোদনমূলক ফিকশন তৈরি করি যেখানে হিরো সারাক্ষণ বলে যে, বৃদ্ধ বাবা-মা সমাজের বোঝা, তাদের রাখতে গেলে বুঝিয়ে যাওয়া উচিত যে তারা সন্তানের জীবনে বোঝা এবং নায়ক সিরিয়ালি নিজের বাবা-মাকে অপমান করে - তাহলেও আপনি তার হিরোগিরিতে হাততালি দেবেন তো? আর কোনও সমালোচক এই মানসিকতার সমালোচনা করলে বলবেন তো যে এর মধ্যে সমাজের প্রতিফলন কেন দেখা হচ্ছে?
আরও পড়ুন- অ্যানিমেল : বন্দুক ও পুরুষাঙ্গের জান্তব আস্ফালন
প্রশ্ন ২ - ভায়োলেন্স, টক্সিক মেল, সাইকোপ্যাথ চরিত্র নিয়ে সিনেমা হওয়া উচিত নয়?
অবশ্যই হতে পারে! সত্যি বলতে কী, সিনেমার আদি কাল থেকে এইগুলো সিনেমার প্রিয় বিষয়। আমাদের এপিকের মহানায়করাও প্রচণ্ড ভায়োলেন্ট কাজকর্ম করেছেন। তাই এগুলো 'গল্প' ও 'কল্পনা' জিনিসটারই প্রিয় বিষয়। শেক্সপিয়রের সমস্ত ট্র্যাজেডির নায়ক টক্সিক; কিন্তু প্রতিটা নাটকে সেটাকে ক্রিটিকালি দেখার উপাদান রেখে দেওয়া আছে। পুরুষরা টক্সিক কীভাবে হয়, তাদের মানসিকতা কীরকম, তাদের বিশ্লেষণ করে দেখার গল্পও নাটক, উপন্যাস, সিনেমার ইতিহাসে একাধিকবার বলা হয়েছে। আগের লেখাতেই সেরকম দু'টি ক্লাসিক ছবির আলোচনা করেছি। এই রকম চরিত্র সিনেমার কেন্দ্রে থাকলেও সিনেমা তাকে ক্রিটিকালি দেখতে পারে। এখানে সেটা করা হয়নি। সন্দীপ ভাঙ্গা রেড্ডি এই চরিত্রকে গ্ল্যামারাইজ করেন, গ্লোরিফাই করেন, একদমই ক্রিটিকালি দেখতে চান না বরং সিম্প্যাথেটিকালি দেখতে আগ্রহী। 'ট্যাক্সি ড্রাইভার'-এ টক্সিক নায়কের 'এন্ট্রি সিন' তৈরি করা হয় না দাপুটে বিজিএম বাজিয়ে। 'আমেরিকান সাইকো' ছবিটা একজন মহিলার পরিচালিত, কর্পোরেট ক্যাপিটালিজমে একজন একজিকিউটিভ, যে পর্ন এবং সিরিয়াল কিলিং-এর ভিডিও চালিয়ে এক্সারসাইজ করে, সে কীভাবে দানবে পর্যবসিত হয় তার স্যাটায়ার। অতএব, এই ছবিগুলোয় ক্রিটিকাল দুরত্ব তৈরি করে ছবির ভাষাই। ‘অ্যানিমাল’-এ যতবার আপত্তিজনক কাজ করছে নায়ক, বা প্রতিক্রিয়াশীল কথা বলছে সেই দৃশ্য হাততালি পড়ার মতো করে তৈরি করেছেন লেখক-পরিচালক-এডিটর। যেমন, আমেরিকায় স্কুলে বন্দুক হাতে সাইকোপ্যাথের আবির্ভাব আধুনিক সমাজে রীতিমত চেনা আতঙ্ক; সেই আবির্ভাবকে তিনি হাততালি দেওয়ার মতো তৈরি করেছেন। অর্থাৎ নায়ক যা যা করে আর বলে তার প্রতি ভাঙ্গার যে সমর্থন আছে সেটার প্রমাণ চরিত্রটির গ্ল্যামারাইজেশন এবং নায়োকোচিতভাবে পেশ করা।
এই জন্যই আমি ছবিটাকে ফ্যাসিস্ট বলেছি - যে চরিত্র evil, ক্ষমতার গর্বে মাতাল সেই চরিত্রর প্রতি আমাদের মুগ্ধতা তৈরি করানোর জন্য। ধরে নিন, গোটা ছবিটা নায়কের অপদস্থ স্ত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো যেত, কিন্তু তাহলে রিভেঞ্জ ড্রামার তৃপ্তি আমরা পেতাম না। মূল মুশকিল হলো, একটা ভায়োলেন্ট রিভেঞ্জ ড্রামা (যেরকম বহু ছবি আমার প্রিয়) দেখাতে গিয়ে তিনি আলফা মেল তত্ত্বের প্রোপাগান্ডা করেছেন। অন্তত এক ঘণ্টা বাড়িয়েছেন তিনি এমন সব দৃশ্য দেখিয়ে যেগুলো না দেখালেও চলত। তার মানে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তিনি সচেতন এই ব্যাপারে।
ছবিটা ফ্যাসিস্ট এই জন্যই যে তাবৎ অশুভ দিকগুলো স্পষ্ট জ্বলজ্বল করলেও আপনাকে মুগ্ধ হয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেকে সুপ্রযুক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কথা বলছেন। অর্জুন ভৈলি গানটা নিয়ে পঞ্জাব প্রদেশের একজন লেখক কী বলছেন, নীচের লিঙ্কে দেখতে পারেন। প্রসঙ্গত, নির্বাচনে জিতে বিজেপি চতুর্দিকে এই গানটা বাজিয়েই উদযাপন করেছে। ভালো করে দেখলে বুঝবেন, এই ছবিতে নায়কের অতিরিক্ত পিতৃপ্রেম ঠিকমত ব্যাখ্যা করা নেই, অন্তত এম্প্যাথি জাগানোর মতো নেই। ক্লাইম্যাক্সে যখন রণবিজয় এবং আব্রার রক্তারক্তি করছে তখন যে সুন্দর গানটা বেজে ওঠে, তার আবেগগত সূত্র তৈরি হয়নি, অতএব সেই সময়ে গানটার প্রয়োগ আরোপিত এবং এক্সপ্লয়েটেটিভ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফ্যাসিজমের একটা লক্ষ্য হলো, ক্ষমতাবানেরা তার মতো করেই অর্থ নির্মাণ করতে বাধ্য করবে, অন্য কোনও পার্সপেক্টিভ সে রাখবে না। থাকলেও সেটাকে সাইডলাইন করে দেওয়া হবে। 'অ্যানিমেল' নিয়ে লোকে যেভাবে মুগ্ধ হচ্ছে তাতে এই ফ্যাসিস্ট কাঠামোটা স্পষ্ট।
প্রশ্ন ৩ - এই ছবির 'কল্পনা', 'মানসিকতা' - মানে?
আগের লেখায় তো বিস্তারিত বলেছি। কয়েকটা বিষয় যুক্ত করি।
ছবিতে নায়কের পিতা দেশের সবচাইতে ধনী মানুষ, একজন শিল্পপতি। তাঁর শিল্পের নাম 'স্বস্তিক', লোগো স্বস্তিকা-আধারিত। একটা দৃশ্যে নায়ক আবার বোঝায় যে সেটা নাকি নাৎসিদের মতো নয়। অথচ, আগের দৃশ্যে একদম হিটলারি কায়দায় সে 'হেট স্পিচ' দেয়, সেটা ব্রডকাস্ট হয়, কারখানার কর্মী (এবং হলের দর্শক) হাততালি দেয় ফ্যাসিস্ট ভক্তদের মতো। এইবার ভাঙ্গাবাবু ভাবছেন যে ইমেজ, মিজঁসেন, ডিজাইন নিয়ে তিনি যেটা দেখালেন এত পাওয়ারফুলি, অন্য দৃশ্যে দুটো ডায়লগ দিয়ে নাকি যথোপযুক্ত কাউন্টার করা হলো যে লোগোটি নাৎসি লোগো থেকে ভিন্ন! হয়ে গেল ব্যাখ্যা? তিনি কি ফিল্মের গাঁজা খান, না আমি ফিল্মের ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?
স্বস্তিক ইন্ডাস্ট্রির দখল নিয়েই গোটা ছবির পারিবারিক কুরুক্ষেত্র হলো গল্পের বিষয়। নায়কের ঠাকুরদার ভাই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন; তার বংশের বর্তমান প্রজন্মের তিন ভাই ব্যবসায় তাদের অংশীদার কায়েম করতে চাইছে। তো, এই 'হিন্দুধারা' আর 'ইসলামধারা'-র মধ্যে corporate-kinship যুদ্ধ হলো মোদ্দা গল্প। অর্থাৎ, এরা পুঁজিপতি, গল্পটা হলো পুঁজির উপর পারিবারিক দখল নিয়ে - কর্পোরেট ওয়ারফেয়ার নিয়ে। ওইসব বাবার প্রতি ছেলের ভালোবাসা জাতীয় ফালতু সেন্টিমেন্টাল ন্যাকাকান্না, ট্রেলারে এগুলো দেখানো হলো লোক-ঠকানো। এইজন্যই ছবিটা কপট।
আমরা হয়তো মহাভারতেও এই গল্প শুনেছি। কিন্তু সেখানে 'ধর্ম' (না, এর মানে হিন্দুধর্ম নয়) বনাম 'অধর্ম' (মহাভারত-এর সময়ে ইসলাম ছিল না), এই পরিকাঠামোটা ছিল, এর কনফ্লিক্ট ছিল। এই ছবিতে সেটা আছে? এই ছবিতে তো নায়ক আর ভিলেন দুই তরফেই একইরকম জান্তব repulsive - তাহলে এই আদানি-আম্বানিদের ক্রিমিনাল ছেলেপুলে নিজেদের মধ্যে কেমন রক্তারক্তি, কামড়া-কামড়ি করছে তা দেখার আমাদের মতো মধ্যবিত্তের প্রয়োজন কী? নিজের 'কর্তৃত্ব' বজায় রাখতে গিয়ে পিতৃস্নেহে অবহেলিত রাজপুত্র খুনখারাবি গুন্ডামিতে অবতীর্ণ হলো, আমাদের নাকি সেটাও এম্প্যাথেটিকালি দেখতে হবে! আমি অবশ্য কারণ খুঁজে পাচ্ছি না দেখার, তাও। তাহলে এই দেশে আইন-পুলিশ নেই কেন? না থাকার যথাযোগ্য কারণ দিলে বিশ্বাস করব। সেটা কী?
এইবার ভাঙ্গার ফ্যান্টাসি, তাঁর কল্পনা বুঝি বরং। তিনি এমন একটা দেশ-সমাজ চান যেখানে কর্পোরেট-মিলিটারির রাজ চলে (সেই 'আত্মনির্ভর ভারত' গ্যাটলিং গানটা মনে আছে?) এবং তার মধ্যে সাইকোটিক পৌরুষের রাজ প্রশ্নাতীতভাবে দাপিয়ে বেড়ায়, এইটাই ওঁর ফ্যান্টাসি। তিনি এমন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে দেশের সবচাইতে বৃহৎ পুঁজিপতির সাইকোটিক ছেলের গুন্ডামির জঙ্গলরাজ চলবে। সেই দেশে পুলিশ থাকলেও এই সময়ে টিকিটি দেখা যাবে না! একটা কনফারেন্স হোটেলে খুল্লমখুল্লা র্যাম্পেজ করে এলেও (যেটা রূপকার্থে মানে হলো ব্যবসায় প্রতিপক্ষকে মাস-মার্ডার করা) আইনের নাগালের বাইরে থাকবে সে!
প্রশ্ন ৪ - ছবিটা ভালো না লাগলে ছবিটাকে ইগনোর করলেই হয়!
এই কথা যারা বলেন, তারা বোধহয় সিনেমার সমালোচনা কাজটাই পছন্দ করেন না, তাই না? ছবি ভালো লেগেছে, এটা বলা যেমন সমালোচকের কাজ, খারাপ লেগেছে এটা বলাটাও কাজ, তারপর কাজ হলো বুঝিয়ে বলা, কেন। “আমার ভালো/খারাপ লেগেছে ব্যস!” এরকম সাধারণ দর্শক বলতে পারেন, সমালোচক নয়। এই কাজটা বিশেষজ্ঞর। এখন যদিও আর এটা 'স্পেশালাইজড' কাজও নয়। আমি যেমন এই কাজটা 'শিখেছি', এখন তো না শিখে রাম-শ্যাম-যদু-মধু সবাই রিভিউ দেয়, রেটিং করে। তবে আমরা যারা বিশেষজ্ঞ, তারা স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা ছবিকে সমালোচনা করলে তাদের কাজে রাগ হয় কেন?
এই অসুস্থ কল্পনার মানসিকতার বিরুদ্ধে আমি লিখব না কেন? এই ছবিটা প্রশংসাযোগ্য কেন? ছবিটা আমাদের উপর এটা চাপিয়ে নির্মাতারা আপনাদের পকেট থেকে টিকিটের দাম নিয়ে প্রফিট করবেন, এইবার আমি, আমার মতো লেখক আপনাদের কাছ থেকে এক টাকা না নিয়েও প্রফিট ছাড়াই সেটা নিয়ে লিখে সমালোচনা করলে কমেন্টে কমেন্টে আমার ভোকেশনের লোককে খিস্তোনো হয় কেন? তাহলে আপনারা 'অ্যানিমাল'-কে নেহাত বিনোদন হিসেবে যারা দেখেন আর আমাদের সমালোচনায় বিরক্ত হন, বলুন যে, যে জিনিসগুলোয় আমার আপত্তি আছে সেগুলো আপনারা আপত্তিজনক নয়, ঠিক মনে করেন।
এই ছবি যিনি কল্পনা করেন, যারা তার সহায়তা করেন, তারপর যারা সেটা দেখে মুগ্ধ হয়, সেলিব্রেট করে - আমি তাদের 'মানসিকতা' নিয়ে চিন্তিত। আমার মনে হয়, এই 'মানসিকতা' সমাজের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করবে। সেইজন্যই আমি 'ইগনোর' করিনি। আমার জীবিকা ফিল্ম পড়ানো, আমি নিয়মিত ফিল্ম নিয়ে লিখি, সেই জন্য এই বক্সঅফিস সাফল্যকে আমি এড়িয়ে যাই না। এব, আমি সংখ্যাগুরুর মতামতকে সবসময়ে 'ঠিক এবং গ্রহণযোগ্য' বলে মনেও করি না। 'এত লোক যেটা করছে' সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে ঠিক বলে গ্রহণ করতে হবে, তা মনে করি না, ছবির ক্ষেত্রেও নয়, সমাজের ক্ষেত্রেও নয়। কারণ সেই ভাবনা সংখ্যালঘুদের ক্ষতি করে অনেক সময়, আমাদের দেশে নিরন্তর করে চলেছে।
আমার প্রশ্ন - একটা ছবি ফ্যাসিস্ট হবে, মিসোজিনিস্ট হবে, অসুস্থ টাইপের ক্যাপিটালিস্ট হবে, কমিউনাল হবে (পরের ছবি 'অ্যানিমাল পার্ক'-এর খলনায়কও মুসলমান), যেখানে এই প্রতিটা পয়েন্ট না হয়েও ছবিটার গল্প বলা যেত; তাহলে ছবিটাকে খিস্তি না করার কারণ কী? তাহলে ছবিটা পলিটিকাল নয় কেন? তাহলে ছবিটাকে পলিটিকালি কাউন্টার করব না কেন? 'ঘাঁটাস না, মালটার মাথা খারাপ' - বলে ছেড়ে দেব? যার মাথা খারাপ সে তো তার তারকাটামোর দাপট দেখিয়ে ৬৫০ কোটি টাকা কামানোর দিকে এগোচ্ছে!
প্রশ্ন ৫ - Massy ছবি কি অবধারিত এরকমই হবে?
না। বুদ্ধি দিয়ে করলে, করতে চাইলে সাবভার্ট করা যায়। দক্ষিণে অনেক উদাহরণ আছে। এই বছরেই অ্যাটলির 'জওয়ান' মুক্তি পেয়েছে। সেই ছবিটাও স্ট্যান্ড আপ কমেডির ধরনেই বানানো হয়েছে। চিত্রনাট্য, প্লট বেশ আলগা। শাহরুখ খান এক এক বার এক এক রকম বেশভূষা ধারণ করে আমাদের এন্টারটেইন করছেন এবং গুঁজে দিচ্ছেন তার মধ্যে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার সমালোচনা, এই হলো ছবির আলগা আঙ্গিক। 'মাসি' ছবি ধরন অবলম্বণ করার ফলেই দেখা যাচ্ছে, তিনি এতগুলো 'ইস্যু' নিয়ে কথা বলতে পারছেন যেগুলো 'অন্য' ছবির ধরনে বলতে গেলে এক একটা ইস্যু নিয়ে এক একটা ছবি করতে হতো!
এই ছবির একটা দৃশ্য আছে যেখানে বিজয় সেতুপতির চরিত্রটির মাধ্যমে একদম জলবৎ সহজভাবে বোঝানো হচ্ছে যে এখনকার ক্যাপিটালিজমে মোদি সরকারের মতো সরকাররা বিভিন্ন দেশে কীভাবে বিভিন্ন পুঁজিপতিদের খেলার মাঠ নিশ্চিত করে দেয় দৃষ্টি অন্যথা ঘুরিয়ে রেখে। দৃশ্যটা আমাদের দেশের বামপন্থী দলেরা ব্যবহার করতে পারতেন বটে কিন্তু তারা ঠিক জনগণের সংস্কৃতিকে ব্যবহার করতে শেখেননি, বুঝতেও শেখেননি।
ছবির শুরুতে যখন শাহরুখকে একজন স্মৃতিহীন যোদ্ধা হিসেবে পেশ করা হচ্ছে অত্যন্ত সুচতুরভাবে উত্তর-পূর্বের কোনও পাহাড়ি উপজাতীয় গ্রামে মিলিটারিদের মতো দেখতে একদল লোকের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে দেখানো হচ্ছে। একদমই বাস্তবোচিত নয়, পাল্প কল্পনার ধাঁচে। কিন্তু ইমেজের নিজস্ব একটা দ্যোতনা থাকে, ন্যারেটিভ- যাই বলুক না কেন। ভাঙ্গা যতই টোকেন ব্যাখ্যা দিন যে তার স্বস্তিকা নাৎজি চিহ্ন নয়, তার দৃশ্যের উপস্থাপনা আরও জোরালোভাবে বোঝায় যে, দৃশ্যটা ফ্যাসিজম-আকাঙ্খীই। সেইভাবেই 'জওয়ান'-এর দৃশ্যটি এক ঝলক আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায়, এখন মণিপুরে কী হচ্ছে।
'জওয়ান'-এর আসল তুরুপের তাস হলো এই ছবিতে নারীচরিত্রের ব্যবহার। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক 'ফ্ল্যাশব্যাক' আসে আজাদের মেয়েদের দলের ক্রোধের কারণ মনে করিয়ে, এ তো আপনাদের দেখা। আমি অন্য একটি প্রসঙ্গ বলব। এই ছবিতে একটি ইউটোপিয়া আছে। যে কোনও ইউটোপিয়ার কল্পনার মতোই তা অলীক ও অবাস্তব এবং সেইজন্যই আইডিয়া হিসেবে সুন্দর। সেই ইউটোপিয়া কোথায়?
সেই ইউটোপিয়া হলো এই ছবির মেয়েদের জেল। যেখানে পিতৃতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র সমস্ত তন্ত্র সাসপেন্ডেড হয়ে যায়। যেখানে আজাদের জন্ম হয়েছিল, যেখানে আজাদ বড় হয়েছে, যেখানে হয়তো সে থাকে, যেখান থেকে মাঝেমধ্যে তার মেয়েবাহিনী নিয়ে সে 'বাকি ভারত'-এ রবিনহুডি নাশকতা করতে যায়। যেখানে তার স্মৃতিহীন, খানিক রিটার্টেড বাবা থাকতে আরম্ভ করলে আর ঠিক বাকি ভারতের কোনও অঞ্চলের মতো 'প্যাট্রিয়ার্ক' হিসেবে থাকবে না।
এভাবেও massy ছবি করা যায় ...।
আবার বলে রাখলাম, 'অ্যানিমাল' ছবিটা দেখিনি, দেখব না। ছবিটার জন্য আমার কলম আর মধ্যমা রইল।