ছ'বার বিশ্বকাপ! কোন ম্যাজিকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়া?
Australia Wins Cricket World Cup 2023 : যে মাঠের এক লক্ষ কুড়ি হাজার দর্শকের গগনভেদী চিৎকারে অস্ট্রেলিয়ার বেহাল দশা হবার কথা ছিল, সেই মাঠ বেশিরভাগ ম্যাচ জুড়েই পড়ে রইল জবুথবু হয়ে।
আজ থেকে ন'টা দশক আগে ক্রিকেট মাঠ দাপিয়ে যাওয়া স্ট্যান ম্যাকেবের নাম শুনলে অস্ট্রেলিয়ার যেকোনও ক্রিকেট-রসিক আজও অবনত হয়ে আসেন। ক্রিকেটের ইতিহাস জুড়ে এত নামজাদা ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিয়ার হয়ে রান করেছেন, পরিসংখ্যানের হিসেবে তাদের অনেকের চাইতেই ঢের সাদামাটা ম্যাকেবকে কিন্তু আলাদা একটা সম্মানের আসন চিরকাল দেওয়া হয়। ম্যাকেবের মাত্র ছ'টা সেঞ্চুরি আছে টেস্টে। কিন্তু তার মধ্যে প্রথম আর শেষ সেঞ্চুরিদুটোকে রাখা হয় অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলোর মধ্যে। বডিলাইন সিরিজের প্রথম সিডনিতে ডন-বিহীন অস্ট্রেলিয়া যখন লারউডের নারকীয় গতির শর্ট পিচ বোলিংয়ে একেবারে দিশেহারা, তখন ম্যাকেব এসেই অসীম সাহসে রীতিমতো আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ইংলিশ বোলিংকে সচকিত করে দেন। তাঁর উল্টো দিকে উইকেট পড়ছিল একের পর এক, তিনি থামেননি। হুক আর কাট মেরে বিষাক্ত বাউন্সারের মহড়া একা টেনে নিয়ে গেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ হারলেও তাঁর অপরাজিত ১৮৭ ক্রিকেটীয় বীরগাথার তালিকায় চিরস্থায়ী আসন করে নেয়। ম্যাকেবের শেষ সিরিজে টেন্ট ব্রিজে ইংল্যান্ডের বিরাট ফার্স্ট ইনিংস টোটালের সামনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং বিশেষ প্রতিরোধ গড়তে পারছিল না। একা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেই ম্যাকেব। তিনি যখন নেমেছিলেন তখন অস্ট্রেলিয়া ভদ্রস্থ ১১১/২। কিন্তু ম্যাকেবের পার্টনারদের মধ্যে কেউই টিকতে পারছিলেন না। রাইট আর ফার্নসের দুর্ধর্ষ স্পেল সামলে ম্যাকেব সেবার করেছিলেন ২৩২ রান, এবং তাও দস্তুরমতো আক্রমণাত্মক ব্যাট করে। অস্ট্রেলিয়া ৪১১ রানে অল আউট হয়ে গেছিল। শোনা যায়, ক্যাপ্টেন ব্র্যাডম্যান নাকি ম্যাকেবের ব্যাটিং চলাকালীন গোটা টিমকে ডেকে এনে এই অদ্ভুত ইনিংস চাক্ষুষ করতে বলেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া এই ম্যাচটাও জেতেনি, এমনকী সেই ইনিংসের জোরে ফলো-অনও এড়াতে পারেনি, কিন্তু ম্যাকেবের ইনিংস রয়ে গেছে অবিস্মরণীয়।
অস্ট্রেলিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকেই জিতছে। জেতাটা তাদের কাছে অভ্যেসের মতো হয়ে এসেছে। ওয়ানডে ক্রিকেটেও এই নিয়মের বিশেষ বাত্যয় ঘটেনি। বিপক্ষকে পিষে দিয়ে জিতে আসার মধ্যেও চিরাচরিত অজি দম্ভ ধরা পড়ে ঠিকই, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে অস্ট্রেলিয়া সেইসব মুহূর্তের ক্রিকেটীয় প্রদর্শনকে নিয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছে যেসব মুহূর্তে তাদের জয় ততটা নিশ্চিত ছিল না। কতকটা সে কারণেই বোধ করি, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের সত্যযুগে সবচেয়ে বড় তারকার নাম ভিক্টর ট্রাম্পার। ভদ্রলোকের টেস্ট গড় ছিল চল্লিশেরও নিচে। কিন্তু যেসব দিনে সেই ঢাকা না দেওয়া পিচের যুগে ভেজা উইকেটে কেউ ব্যাট হাতে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতেন না, ভিক্টর ট্রাম্পার অবলীলাক্রমে হাঁকাতেন একের পর এক বাউন্ডারি, খেলে আসতেন ম্যাচ জেতানো ইনিংস।
আরও পড়ুন- কোথায় হলো ভুল? কেন ১০ ম্যাচ জিতেও ফাইনালে হার বিরাট-রোহিত-শামিদের?
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হাতে বল লেগে ট্র্যাভিস হেডের আঙুলের হাড়ে চিড় ধরেছিল বিশ্বকাপ শুরুর ক'টা দিন আগেই। তাঁকে সিলেক্টরেরা স্কোয়াডে রেখেছিলেন দেখে জল্পনা-কল্পনাও কম হয়নি। অবশেষে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি মাঠে ফেরেন। এসেই করেন ঝোড়ো শতরান। তারপর সেমিফাইনাল আর ফাইনালের ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন বিভাগেই তুলনাহীন এক্সেলেন্স দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ছয় নম্বর বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর হয়ে ওঠেন।
ট্র্যাভিস হেডের আগেও বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানেরা সেঞ্চুরি করেছেন। কিন্তু পন্টিং আর গিলক্রিস্টের ফাইনালে মারা শতকের দিনগুলোয় অস্ট্রেলিয়া ছিল পুরোদস্তুর ফেভারিট। আজকে তা নয়। অল্প রানে তিন উইকেট পড়ার পর হেডের সেঞ্চুরি তাই আন্ডারডগ অস্ট্রেলিয়ার মুষ্টিবদ্ধ হুংকারের মতো। যে তকমা তাদেরকে মানায় না, অথচ মাঝেমাঝে এসে চেপে বসে সেই তকমার বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সফল প্রতিবাদের মতো এই হুংকার। জেতার কথা যেসব দিনে, সেসব দিনে জেতার পাশাপাশি জেতার যেদিন কথা নয় সেদিনও জেতাটাই আসল চ্যাম্পিয়ন দলের লক্ষণ।
জেতার কথা যেসব দিন নয়, সেসব দিনে জেতার চ্যালেঞ্জ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন কেউ কেউ। প্যাট কামিন্স সেরকমই একজন। তাঁর কেরিয়ার অনেক ওঠাপড়ার ভেতর দিয়ে গেছে। অধিনায়ক হিসেবে তিনি ম্যাচের আগে বলেছিলেন, এমন বিশাল মাঠে বিরোধী দলের হয়ে গলা ফাটাতে থাকা গ্যালারিকে চুপ করিয়ে দেবার অনুভূতি তাঁর কতটা প্রিয়। বিরাট কোহলি যখন আউট হলেন তাঁরই বলে, গোটা মাঠ সেই অসহ্য নৈঃশব্দের সাক্ষী থাকল। তাঁর ১০-০-৩৪-২ ফিগার দেখতে তেমন আহামরি না হলেও ফাইনাল ম্যাচে গুরুত্বের নিরিখে অমূল্য। ক্রিকেটের ইতিহাস জুড়ে ব্যাটসম্যানেরাই ক্যাপ্টেন হয়ে এসেছেন বেশিরভাগ সময়ে। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কদের মধ্যে ফাইনালে তাক লাগানো পারফরমেন্সের যে তালিকা, সেই তালিকায় লয়েডের শতক, পন্টিংয়ের শতক আর ধোনির অপরাজিত ৯১ রানের পাশে জ্বলজ্বল করা উচিত কামিন্সের বোলিং।
অবশ্য শুধু বোলিং ছাড়াও কামিন্স দলকে অনেক কিছু দিয়েছেন। টস জিতে ব্যাটিং না নেওয়ায় যে সমালোচকেরা ছুরিতে শান দিচ্ছিলেন তাদের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন কামিন্স তাঁর সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখিয়ে। তারপর ফিল্ড সাজানোর সময়ে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগকে কিঞ্চিৎ ফাইন রেখে আর থার্ড ম্যানকে বেশ খানিকটা স্কোয়ার রেখে ভারতীয় টপঅর্ডারের ব্যাকফুট নির্ভর স্ট্রোক প্লে-কে মুশকিল করে তো তুলেছিলেন বটেই, তাছাড়া সার্কেলের ভেতরও ফিল্ডারদের পজিশনিং ঠিক করেছেন নির্ভুল ধারাবাহিকতায়। বাউন্ডারি মারার সব পথ আশ্চর্য সফলভাবে বন্ধ করে ব্যাটসম্যানকে ভাতে মেরে বাধ্য করেছেন ঝুঁকিপূর্ণ শট মারতে। তবে ফিল্ডিং নজরকাড়া করেওছিল অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্টের শুরুতে তাদের এমন ফিল্ডিং মোটেই দেখা যায়নি। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল মিলিয়ে অন্তত গোটা আশি রান বাঁচিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ চাপে পড়ে উইকেট খুইয়ে অল্প রানেই গুটিয়ে গেছে।
ফিল্ডিংয়ের মতোই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংও ধীরে ধীরে ছন্দ খুঁজে পেয়েছে। প্রতিযোগিতার প্রথমদিকে খানিক সংশয়ী এবং সাবধানী অ্যাপ্রোচ দেখিয়েছিল তারা। প্রথম পাওয়ার প্লে-র সুবিধে নিতে পারছিল না সেভাবে। তারপর জড়তা কেটে যেতে পরপর তিন ম্যাচে তুলেছে প্রায় চারশোর কাছাকাছি প্রথম ইনিংস টোটাল। অক্লেশে তাড়া করেছে তিনশোর উপর রান। যেসব ম্যাচে রান তাড়া হিসেব মতো হয়নি, সেসব দিনেও ম্যাচ বেরিয়েছে - দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হিমশীতল স্নায়ুর জোরে আর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ক্র্যাম্প-জর্জরিত গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অত্যাশ্চর্য দ্বিশতকে ভর করে।
আরও পড়ুন- দ্রাবিড় শিখিয়েছেন: যত্ন করে হারতে শেখাটাও জরুরি
ভারত একটাও ম্যাচ হারেনি। অপরাজেয় দল হিসেবে তারা নেমেছিল ফাইনাল খেলতে। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দুটো হারার পর একটানা জিতে এলেও তাদের খেলায় তেমন অভ্রান্ত নিশ্চয়তার কোনও ছাপ ছিল না। তবুও গ্রুপ পর্বে যাদের কাছে হেরেছিল, তাদেরকে নকআউটে হারিয়ে কাপ তুলল টিম অস্ট্রেলিয়া। শুধু গনগনে মানসিক তেজে এই নজির সম্ভব নয়। এর জন্যে লাগে হোমওয়ার্ক, পরিকল্পনা এবং তার সুচারু প্রয়োগ। এই সুচারু প্রয়োগের কারণেই পাওয়ার প্লে-তে দু'বার না ভেবে অফ-স্পিনার ম্যাক্সওয়েলকে লেলিয়ে দেন অধিনায়ক, নিজেকে আক্রমণে আনেন সামান্য দেরিতে আর ফিল্ডিং সাজান এমনভাবে যে খেলা দেখতে গিয়ে সন্দেহ হয় এগারোর চাইতে ঢের বেশি লোক মাঠে প্রহরায় খাড়া কিনা। ভারতের অ্যাপ্রোচ সে তুলনায় বেশ গা-ছাড়া ছিল। ফিল্ডিংয়ে স্পষ্টতই এনার্জি এবং গতির অভাব দেখা গিয়েছে। ফিল্ড প্লেসমেন্টে অধিনায়ক রোহিতও ছিলেন অত্যন্ত গতানুগতিক। তারমধ্যে কে এল রাহুলের উইকেটকিপিং বিশ্বকাপ ফাইনালের উপযোগী মোটেই নয়। যেদিন একটাও অতিরিক্ত রান গলানোর জায়গা নেই, সেদিনই ভারতীয় ফিল্ডিং অন্তত গোটা পঁচিশ রান উপহার দিল অস্ট্রেলিয়াকে।
একান্ত অপ্রতিরোধ্যরূপে প্রতিভাত হতে থাকা ভারতীয় দল আসল ম্যাচে টিমওয়ার্ক সেভাবে দেখাতে পারল কই! অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে নিজেদের দায়িত্ব ছাপিয়ে পারফর্ম করে গেছেন বারবার। প্যাট কামিন্সের এক একটা পিচ কামড়ানো ইনিংস বা সেমিফাইনালে ট্র্যাভিস হেডের জোড়া উইকেটের স্পেলে তারই নিশ্চিত সাক্ষ্য মেলে। এই ম্যাচে তো সেসবের দরকারও পড়ল না। খালি গেমপ্ল্যানের জোরেই ভারতের ঘরের মাঠে তাদের চোখের সামনে থেকে কাপ ছিনিয়ে নিল অজিরা। যে মাঠের এক লক্ষ কুড়ি হাজার দর্শকের গগনভেদী চিৎকারে অস্ট্রেলিয়ার বেহাল দশা হবার কথা ছিল, সেই মাঠ বেশিরভাগ ম্যাচ জুড়েই পড়ে রইল জবুথবু হয়ে। নীলরঙা নিথর গ্যালারির চাপ এসে জমা হল ভারতীয় দলের কাঁধেই। সেই কাঁধে অতীতের বোঝাও ছিল। কুড়ি বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফাইনালের বোঝা আর গত এক দশক জুড়ে নানা আইসিসি টুর্নামেন্টে বড় ম্যাচে ব্যর্থ হবার বোঝা মিলিয়ে ভারত স্নায়ুর চাপ ঠিক সামলে উঠতে পারেনি। অদ্ভুত কয়েকটা শট-সিলেকশন, চোখে পড়ার মতো কিছু মিস-ফিল্ড, মাঝেমাঝেই এলোমেলো লাইন-লেংথ দেখে তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। নিশ্চিত উৎসবের আগমনীতে উদ্বেল, বরণডালা সাজিয়ে বসে থাকা ব্যক্তিপুজোর ভারতবর্ষে, নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে আকাশচুম্বি প্রত্যাশার মধ্যে, ভারতীয় দল ফাইনালের মহামঞ্চে নতুন করে দেখল ফাইনালের মতো ম্যাচে কেমন একাগ্র শরসন্ধানে গোটা অস্ট্রেলিয় টিম একজোট হয়ে চাঁদমারি খসাল। ভারত এবার পারল না। ভারত এবারও পারল না।