জোর করে ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ পালন কেন করাতে চায় বিজেপি সরকার?
Har Ghar Tiranga: হেগড়েওয়ার,, গুরু গোলওয়ালকর বা সাভারকারকেও যে বিজেপি স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে প্রমাণ করতে চায় তা বেশ স্পষ্ট।
১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ তারিখের মধ্যরাতে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন, "যখন সারা বিশ্বের মানুষ নিদ্রান্বিত থাকবেন, তখন ভারতবর্ষ একটা নতুন জীবন এবং স্বাধীনতা পাবে। ইতিহাসে এই ধরনের মুহূর্ত হয়তো কমই আসে কিন্তু আসে। যখন পুরাতন থেকে নতুন এক অধ্যায়ের দিকে যাত্রা শুরু হয়।" সেই স্বাধীন ভারতের পঁচাত্তরতম বার্ষিকী পালন করা হলো তিন বছর আগে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই উৎসবের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’। নিদান দেওয়া হয়েছিল, প্রতি ঘরে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, তার ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিতে হবে, যার আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হর ঘর তিরঙ্গা’। অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যাঁদের ঘর নেই বা যাঁদের ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা কীভাবে পতাকা তুলবেন? কেউ কেউ বলেছেন, যে সঙ্ঘ পরিবার দীর্ঘদিন এই জাতীয় পতাকাকে ব্রাত্য করে রেখেছিল, তারা কী করে এখন সবাইকে জাতীয় পতাকা তুলিয়ে দেশপ্রেমিক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে?
মাঝে দুটো বছর এই ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ পালন কিঞ্চিৎ স্তিমিত থাকলেও, এই বছর আবার জোর কদমে সরকারি স্তর থেকে নতুন ভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এইসব তো রাজনৈতিক কচকচানি। প্রতি ঘরে তিরঙ্গার বার্তার মধ্যে কি কোনও সামাজিক সমীকরণের বিষয়ও আছে? এটি কি সমষ্টির চেতনা থেকে ব্যক্তি চেতনায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া নাকি ইতিহাসের ধারণাকে বদলানোর চেষ্টা?
আরও পড়ুন- বীর সাভারকার কি সত্যিই ছিলেন ‘বীর’?
ছোটবেলায় স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালিত হতো সমষ্টিগত ভাবে। প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা পতাকা তুলতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, গান্ধি, নেহরু, ভগৎ সিং, সুভাষদের অবদান সম্পর্কে বলতেন। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হতো। বাড়ি ফেরার পথে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা ছোট কেক বা মিষ্টি। এমনকী পাড়ার ক্লাবগুলোতেও এই ধরনের অনুষ্ঠান হতো। এই ধরনের অনুষ্ঠানে একটা সমষ্টিগত আনন্দ পাওয়া যেত, এইভাবেই ধীরে ধীরে সবাই বড় হয়ে উঠতেন, ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে মিশে যাওয়ার শিক্ষা পেতেন। কিন্তু ইদানিং স্বাধীনতা
দিবসে সেই ধারণাগুলোই কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন সামাজিক মাধ্যমে আমরা সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকি। সেখানে নিজের ঘরে জাতীয় পতাকা তোলা ছবি আপলোড করা, কতজন 'লাইক' করলেন, কে কী 'কমেন্ট' করলেন, তা কি সমষ্টির চেতনা থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে দেওয়ার চক্রান্ত? অনেকে বলতে পারেন, জাতীয় পতাকা শুধু তো কেন্দ্রীয় শাসকদলের সম্পত্তি হতে পারে না, এই পতাকায় সবার অধিকার। অনেকে বলতে পারেন, যখন এনআরসি বিরোধী আন্দোলন হচ্ছিল তখন তো জাতীয় পতাকাকে কেন্দ্রের শাসকদলের হাত থেকে কেড়ে নেওয়ারই লড়াই ছিল। সেই পতাকা যদি শাসকের হাত থেকে প্রতিটি সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছয়, তাতে ক্ষতি কী?
নোটবন্দির সময়েও এই কেন্দ্রীয় সরকার সমষ্টির চেতনা ভেঙে দিয়েছিল, সবাই ব্যক্তিগতভাবে ব্যাঙ্ক এবং এটিমের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কেউ সমষ্টিগতভাবে ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। যখনই বলা হয়েছে আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, গ্যাসের সংযোগ বা রেশন কার্ডের সংযোগ করাতে হবে, প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে নিজের সমস্যা সমাধানে ছুটেছেন, কেউই সমষ্টিগতভাবে এই নির্দেশগুলোর বিরোধিতা করেননি। কোভিডের সময়ে যতই প্রচার করা হোক না কেন, রোগীকে নয় রোগকে দূরে রাখুন, মানুষ ভয়ে পাশের বাড়ির শুধু নয়, পাশের মানুষকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আপনজনকে ফেলে পালিয়ে গেছে। যাঁরা কোভিডের চিকিৎসা করছেন সেই মানুষদের ঘর ভাড়া দিতে দ্বিধাবোধ করেছেন। সামাজিক মাধ্যম যেমন মানুষকে একলা করেছে, তেমনই সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত মানুষকে আরও একলা করে, সামাজিক মাধ্যমের দিকেই আরও বেশি ঠেলে দিয়েছে। সমষ্টির চেতনা কখন যে শুধু ব্যক্তি চেতনার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে, তা স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পেরিয়ে যেন সব গুলিয়ে গেছে। দেশের সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বলের কথা শুরুই হয় ‘আমরা’ শব্দটি দিয়ে… ‘আমরা ভারতের জনগণ’। তাহলে কি ‘আমরা’ শব্দটিই আর থাকবে না, সবই ‘আমি’-কেন্দ্রিক? ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসবে’ এটাই প্রাপ্তি? রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাসবোধ সব কিছুই গুলিয়ে দিতে চাইছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার?
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, দেশের সমস্ত মানুষের একসঙ্গে পথ চলার ইতিহাস। সমস্ত ধর্ম এবং জাতির মিলিত ইতিহাস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, জাতির মানুষজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেশের নানান প্রান্তের মানুষের এই লড়াইয়ে বেশিরভাগের স্বপ্ন ছিল, নতুন স্বাধীন ভারতবর্ষ হবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক, সেখানে প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার থাকবে। একমাত্র যাঁরা হিন্দু এবং মুসলমান জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা ছাড়া প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল লক্ষ্যণীয়।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন এবং মানুষজন প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যতই বাম এবং কংগ্রেস প্রভাবিত ঐতিহাসিকেরা বলুন না কেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেননি, তাঁদেরও আসলে যথেষ্ট ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইতে। কিছুদিন আগে বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ রাকেশ সিনহা, একটি লেখায়, আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তাঁর এই আলোচনার কারণ অবশ্য অনেকেই জানেন। যেহেতু ২০২৫ সালে আরএসএস তাঁদের স্থাপনের একশো বছর পূর্ণ করবে, তাই এখন থেকেই যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা শুরু না করা যায়, তাহলে
মানুষের মনে আরএসএস সম্পর্কে যে ভুল ধারণা এতদিন ধরে আছে, তা থেকেই যাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যাবে। সেই কারণেই তাঁরা পাঠ্যসূচিতেও বদল আনার কথা বলছেন। রাকেশ সিনহা লিখেছেন, আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ভূমিকা ছিল, তার তথ্য তিনি পেয়েছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের থেকে। যেহেতু আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা হেগড়েওয়ার, ব্রিটিশ বিরোধী আইন অমান্য আন্দোলনে ১৯৩০ সালে একবার অংশ নিয়েছিলেন, তাই রাকেশ সিনহার কষ্ট কল্পনায় উঠে এল যে আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। হ্যাঁ, এই তথ্য সত্যি যে, ওই আইন অমান্য আন্দোলনের সময়কালে, হেগড়েওয়ার গ্রেফতার হয়েছিলেন, কিন্তু তা হয়েছিলেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে। একটি উদাহরণ ও পাওয়া যাবে না, যেখানে লেখা আছে হেগড়েওয়ারের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে নিজেকে উদ্দীপিত করেছিলেন। উল্টে এমন অজস্র উদাহরণ পেলেও পাওয়া যেতে পারে যেখানে দেখা যাবে, তিনি তাঁর
এবং আরএসএসের হিন্দুত্ব এজেন্ডা নিয়ে মানুষের কাছে ওই সময়ে পৌঁছেছেন।
আরও পড়ুন- ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েমে আরএসএস-এর ভূমিকা
শুধু হেগড়েওয়ার নন, গুরু গোলওয়ালকর বা সাভারকারকেও যে বিজেপি স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে প্রমাণ করতে চায় তা বেশ স্পষ্ট। অথচ সত্যি হচ্ছে, ১৯১০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সাভারকারকে কারাবন্দি করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি এক ব্রিটিশ আমলার হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৪ বছর পরে তাঁর মুক্তি হয়। এই মুক্তির পিছনেও একটা ইতিহাস আছে। তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে বহু চিঠি লেখেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। তারপরেই তাঁর সাজা মকুব হয়। সেইরকম একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, তিনি ব্রিটিশ সরকারের কতটা অনুগত এবং তাঁদের জন্য তিনি সব করতে রাজি। ব্রিটিশরা যেমন বলবে, তেমনটাই তিনি করবেন, এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি চিঠি লিখেছেন, তাও ইতিহাসে উল্লেখ আছে। মুক্তির পরে, তিনি আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কোনও সংগ্রামে অংশ নেননি উল্টে তাঁদের সহযোগিতাই করেছেন।
২০১৪ সালের পর থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ চেষ্টা করে গেছে, কী করে ইতিহাসকে আবার নতুন ভাবে লেখা যায়। কী করে ব্রিটিশদের প্রতি আরএসএসের আনুগত্যের বিষয়টিকে ঢেকে রেখে নতুন প্রজন্মের কাছে অন্য সত্যকে পেশ করা যায়। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ
এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং অর্থাৎ এনসিইআরটিকেও বলা হয়েছে, পাঠ্যসূচিতে বদল আনতে, যাতে স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের ইতিহাস এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতির ছবি, নতুন করে পরের প্রজন্মের শিশুদের মাথায় ঢোকে। সেই জন্যই সাভারকারের জন্মদিনে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন হয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরের পঞ্চম সেমিস্টারের পাঠ্যসূচিতে সাভারকারের প্রবেশ ঘটানো হয়েছে। ‘হর ঘর তিরঙ্গা’র উদ্দেশ্যও যে একই তা সহজেই অনুমেয়। সমষ্টির চেতনা থেকে ব্যক্তি চেতনায় পর্যবসিত করা
এবং ইতিহাসকে বিকৃত করে ভুল ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়াটাই যে উদ্দেশ্য তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?