যোগীরাজ্যে কেন হারল বিজেপি? বিস্ফোরক সত্য ফাঁস করলেন উত্তরপ্রদেশের নেতারাই
UP BJP Lok Sabha Results 2024: প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজ্যে গত তিন বছরে অন্তত ১৫ টি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে যা বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে।
গড়েই হার কেন? লোকসভা নির্বাচনের একমাসেরও বেশি সময় পর উত্তরপ্রদেশে বিজেপির পরাজয়ের কারণগুলি প্রকাশ্যে আনল দল। বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবর আসছিল; এরই মধ্যে সেই রাজ্যের বিজেপি শাখা লোকসভা নির্বাচনে হারের কারণের বিশদ বিবরণ দিয়ে দলের কাছে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে সরকারি চাকরির জন্য চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের নিয়োগের মতো বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি রাজ্য প্রশাসনে উপরের কিছু নেতার হস্তক্ষেপের মতো বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে, যা দলীয় কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ।
সমাজবাদী পার্টি-কংগ্রেস জোট এবার রাজ্যের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪৩টি আসন জিতেছে। এনডিএ পেয়েছে ৩৬। এই এনডিএ জোটই ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৬৪টি আসন জিতেছিল। রাজ্য বিজেপি নির্বাচনী প্রচারের ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করে একটি বিস্তৃত ১৫ পাতার বিশ্লেষণ জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনের জন্য প্রায় ৪০,০০০ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জেনে নিজেদের মূল্যায়ন করেছে বিজেপি। অযোধ্যা এবং আমেথির মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় কেন হার তা খতিয়ে দেখেছে বিজেপি।
আরও পড়ুন- উত্তরপ্রদেশে বিজেপির হার ‘পরিকল্পিত’! গোপন নথি হাতে নিয়ে যুদ্ধ শুরু যোগীর
সম্প্রতি, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সভাপতি ভূপেন্দ্র চৌধুরী এবং উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য দলের বরিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যে দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে ত্রুটি সংশোধনের অংশ হিসাবে উত্তরপ্রদেশের নেতাদের সঙ্গে আগামীতে আরও আলোচনার পরিকল্পনাও করা হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই নির্বাচনী বিপর্যয়কে 'অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস' বলে দায়ী করেছিলেন। রাজ্যের দলের অন্য নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়েও এরপর জল্পনা তীব্র হতে থাকে। যদিও উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব মৌর্য সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ করে জানান, জনগণের চেয়ে দল ও সংগঠন সবসময়ই বড়।
ওই প্রতিবেদনে বিজেপির এই হারের নেপথ্যে ছয়টি প্রাথমিক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রশাসনিক উচ্ছৃঙ্খলতা, দলীয় কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ, ঘন ঘন প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সরকারি পদে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের নিয়োগের মতো কারণগুলির উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "বিধায়কের কোনও ক্ষমতা নেই। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং আধিকারিকরাই শাসন করেন। এতে আমাদের কর্মীরা অপমানিত বোধ করছেন। বছরের পর বছর ধরে, আরএসএস এবং বিজেপি একসঙ্গে কাজ করেছে, সমাজে শক্তিশালী সংযোগ তৈরি করেছে। কর্মকর্তারা দলীয় কর্মীদের প্রতিস্থাপন করতে পারে না।"
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজ্যে গত তিন বছরে অন্তত ১৫ টি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে যা বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বিরোধীরা মানুষকে বোঝাতে পেরেছে যে বিজেপি সংরক্ষণ তুলে দিতে চায়। চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিয়ে সরকারি চাকরি পূরণ করা হচ্ছে, এটিও বিজেপির ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করছে দলের কাছে।
প্রতিবেদনে কুর্মি এবং মৌর্য সম্প্রদায়ের সমর্থন হ্রাস এবং দলিত ভোট হ্রাসের উল্লেখও করা হয়েছে। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) ভোট হ্রাস এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলে কংগ্রেসের উন্নতিকে অতিরিক্ত কারণ হিসাবে স্বীকার করেছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আর্জি জানিয়েছে যাতে রাজ্য শাখার মতপার্থক্যগুলির অবিলম্বে সমাধান হয় এবং উচ্চ বর্ণ বনাম অনগ্রসর জাতির এই রাজনীতি সংঘাতে পরিণত না হয়। তার জন্য তৃণমূলস্তরে কাজ শুরু করতে হবে। একসময় ওবিসিদের দল হিসাবে পরিচিত ছিল উত্তরপ্রদেশ বিজেপি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের অধীনে উত্তরপ্রদেশ বিজেপি ১৯৯০-এর দশকে লোধ সম্প্রদায়ের সমর্থন দাবি করেছিল কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির অধীনে বিজেপির প্রতি ওবিসিদের সমর্থন সবচেয়ে বেশি বাড়ে।
আরও পড়ুন- অযোধ্যা কেন বিজেপিকে তাড়াল? কী বলছেন রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুর্মি এবং মৌর্য জাতির মানুষ আর বিজেপিকে ভরসা করছে না। মাত্র এক তৃতীয়াংশ দলিত ভোট পেয়েছে বিজেপি এবার। বিএসপি-র ভোট ভাগ ১০ শতাংশ কমেছে, আর কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশের তিনটি অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান উন্নত করেছে যা সারা রাজ্যে সামগ্রিক ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধে দলের নেতাদের নানা সময়ের বিবৃতি দলের সমর্থনকে আরও কমিয়ে দিয়েছে বলেও মনে করছে রাজ্য বিজেপি।
লোকসভা নির্বাচনে, সমাজবাদী পার্টি উত্তরপ্রদেশের ৮০ টি আসনের মধ্যে ৩৭ টি জিতেছে। ২০১৯ সালের থেকে ৫টি মাত্র আসন পেয়েছিল অখিলেশের দল। উত্তরপ্রদেশের এই ফলাফল অবাক করারই মতো। এই বছরের শুরুতে রাম মন্দিরের উদ্বোধন করে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছিল ভোট টানার মোক্ষম তাস খেলে ফেলেছে তারা। অথচ দলের নিজস্ব তথ্য অনুসারে, বিজেপির এবার সবচেয়ে দুর্বল পারফরম্যান্স ছিল পশ্চিম এবং কাশী (বারাণসী) অঞ্চলে, সেখানে ২৮টি আসনের মধ্যে মাত্র ৮টি জিতেছে বিজেপি। ব্রজে (পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে), ১৩টি আসনের মধ্যে ৮টি জিতেছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ঘাঁটি গোরখপুরে, বিজেপি ১৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ৬টি জিতেছে। অওধে (অর্থাৎ লখনউ, অযোধ্যা, ফৈজাবাদ অঞ্চলে) ১৬টির মধ্যে মাত্র ৭টি জিতেছে বিজেপি। কানপুর-বুন্দেলখণ্ডে বিজেপি ব্যর্থ হয়েছে। ১০টির মধ্যে মাত্র ৪টি জিততে পেরেছে গেরুয়া বাহিনী।